আলমগীর খোরশেদ

  ২২ মার্চ, ২০২৪

গ্রামীণ ঐতিহ্য

টাঙ্গাইল শাড়ি

‘শাড়িতে নারী

সৌন্দর্যের যত আধার

টাঙ্গাইল শাড়ি পরে তুমি

মন-প্রাণ নিয়েছো আমার।’

‘শাড়ি’ শব্দটিতে ভেসে উঠে কোনো নারীর উজ্জ্বল মুখ। তিনি হতে পারেন মমতাময়ী মা, প্রিয়তমা, অর্ধাঙ্গিনী। আদিকালে মানুষ পাহাড়ের গুহায়, জঙ্গলে, গাছের কোটরে বাস করত। ক্রমে সভ্যতার আলোয় আলোকিত হয়ে পরিধানে গাছের পাতা, বাকল থেকে বেরিয়ে এসে তুলা চাষ করে, তুলা থেকে সুতা আর সুতা থেকে কাপড় বানাতে শিখে মানুষ পৌঁছে গেছে স্মার্ট টেকনোলজির দ্বারপ্রান্তে। শাড়ি বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশের নারীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক।

সিন্ধু সভ্যতায়, খৃস্টপূর্ব ২৮০০-তে তুলার চাষ শুরু হয়। নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে রচিত চর্যাপদে শাড়ির কথা পাওয়া যায়। নারীর আটপৌরে পোশাক হলো শাড়ি। দিনের আট প্রহর ধরে পড়ে থাকা শাড়ি বা কাপড়টা আরামদায়ক হতে হবে, না হলে আটপৌরে শাড়ি হবে কী করে? কুচি করে শাড়ি পরাটা আসে কলকাতার জোঁকা সাঁকো ঠাকুর পরিবারের নারীদের থেকে। ধারণা করা হয়, সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে তাঁতশিল্পের প্রচলন শুরু হয়। ১৮৪০ সালে বস্ত্রশিল্প যখন ধ্বংসের মুখে, তখন ঢাকায়, ময়মনসিংহে ছত্রিশ রকমের কাপড় বোনা হতো। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে হিন্দু তাঁতি ও যোগী এবং মুসলমান জোলারা তাঁতে কাপড় বোনা শুরু করে। ফার্সি শব্দ জুলাহ বা জুলাহা থেকে জোলা শব্দের উৎপত্তি। কাপড় বুনতে সুতার গোলা বা বলকে জুলাহ বলে।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বৃহত্তর ময়মনসিংহের টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর, জঙ্গলবাড়ি, পাকুন্দিয়ায় কাপড়ের কল বসায়। টাঙ্গাইল ও বাজিতপুরের শাড়ির পাড়ে নান্দনিক নকশি থাকায় শাড়িগুলো বিদেশেও রপ্তানি হতো। তখন কিশোরগঞ্জ ও টাঙ্গাইলে তৈরি ‘তানজেব’ নামক শাড়ি কাপড়টি ঢাকার মসলিন কাপড়ের সঙ্গে পাল্লা দিত। কিশোরগঞ্জের তানজেব আর বাজিতপুরের মসলিন কাপড় দিল্লির রাজ দরবারে সমাদৃত ছিল। বাংলার নবাব মুর্শিদ কুলী খান মোগল সম্রাটদের জন্য মসলিনের তেরি উপঢৌকন পাঠান। আর তা টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের তৈরি ছিল। ওলন্দাজরাই কিশোরগঞ্জের সদর ও বাজিতপুরে কুঠি নির্মাণ করে। সুলতানি আমল, মোগল আমল, ঈশাখাঁর আমল, ইংরেজ আমলের বণিকরা মসলিন ও বাহারি শাড়ির পাইরে নান্দনিক ডিজাইন কাপড়ের চাহিদা বা প্রসার ঘটায়। ইতিহাসবিদ ড. আবদুল করিম জঙ্গলবাড়ির মসলিন কাপড় ও তাঁতিদের দক্ষতার কথা লিখে গেছেন। বিশ্বপরিব্রাজক ইবনে বতুতা ও হিউয়েনসাং তাদের বর্ণনায় সিরাজগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও টাঙ্গাইলের শাড়ির কথা, তাঁতিদের দক্ষতা, কারকার্যময়তার কথা উল্লেখ করেছেন।

বসাক সম্প্রদায়ের তাঁতিরাই হলো আদি তাঁতি। এদের পূর্বপুরুষরা ছিল যাযাবর শ্রেণির। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দেশভাগের সময় বাংলাদেশ-ভারত পরস্পর দেশ ছেড়ে আশ্রয় নেয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও বসাক শ্রেণির কারিগর তাঁতিরা মুর্শিদাবাদসহ টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, নরসিংদীতে ঘাঁটি করে। পূর্ববাংলা তথা বাংলাদেশের টাঙ্গাইলেই টাঙ্গাইল শাড়ির জন্ম। পরে কে কোথায় চলে গেল, কোথায় নতুন করে টাঙ্গাইল শাড়ি তৈরি করে ওই দেশের পণ্য বলছে, এটা গ্রহণযোগ্য নয়। ১৯২২ সালে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু পাবনায় আসেন। সে সময় পাবনায় সাতটি হোসিয়ারি শিল্প পরিদর্শন করেন। মুগ্ধ হয়ে এই শিল্পকে বস্ত্রশিল্পের মা বলে আখ্যায়িত করেন।

বসে বসে তাঁতের কাজ করা হয় বলে এই তাঁতিদের বসাক বলা হতো। বসাক শ্রেণির পল্লীর তাঁতিরা বংশানুক্রমে হাজার বছর ধরে তাদের শাড়ির তৈরির কাজ অব্যাহত রাখেন। সুতা দিয়ে দক্ষতার সঙ্গে আরামদায়ক, মার্জিত, নান্দনিক ডিজাইন করা শাড়ি তৈরি করে গেছেন। টাঙ্গাইল শাড়ির প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল তার সুন্দর পাইর। কটন শাড়ির পাশাপাশি সফ্টসিল্ক ও হাফসিল্ক শাড়ির জনপ্রিয়তা পায়। টাঙ্গাইলের শাড়ির ডিজাইন, শৈল্পিকতা যেকোনো নারীর ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায়। আধুনিক নারীর রুচি, পছন্দ ও বৈচিত্র্যের পরিবর্তন ঘটেছে। তাঁতিরা সুতির শাড়ি, দেবদাস, আনারকলি, জামদানি, সুতি জামদানি, জরির পাড়, নিলাম্বরী, ময়ুরকণ্ঠী, হাজারবুটি, মনিপুরী, বালুচুরি, শান্তিপুরি, আধা রেশমি তৈরি করে। মাধবীলতা মরবী, তেরবী, কুঞ্জলতা ও লতাপাতা পাইরের শাড়ির তৈরি করে পরিবর্তন এনেছেন। টাঙ্গাইল শাড়িতে অঞ্চল, মোটিফ, ডিজাইন কাজ করে তাঁতির মনের, পারিপার্শ্বিকতার ওপর। তাঁতের শাড়ি বানাতে দড়ি, কাঠের ম্যারিচি এবং খুঁটি দিয়ে তৈরি শাটল পিট তাঁতে বোনা হয়। টাঙ্গাইল শাড়ির খ্যাতি হয়েছে এর সুক্ষ্ম বুনন ও মিহি কাপড়ের কারণে। টাঙ্গাইল শাড়ির জন্য কৃতিত্বের দাবিদার একমাত্র বসাক তাঁতিরা। বসাক তাঁতীরাই ঢাকাসহ সারা দেশে মূলত ঢাকা, ধামরাই, চৌহাটি, টাঙ্গাইলে বসবাস করত। তা ছাড়া কিশোরগঞ্জ, কাগমারি, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল মহকুমার বিভিন্ন প্রসিদ্ধ জায়গাতেও ছিল বসাকরা। হস্তচালিত তাঁতের শাড়িগুলো তুলার সুতা থেকে তৈরি হতো। পূর্ব বাংলার বসাক সম্প্রদায়ের তাঁতিরা পশ্চিমবঙ্গের তাঁতিদের তাদের তাঁতকেন্দ্রে শ্রমিক হিসেবে নিযুক্ত করেন। এভাবে পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিকরা শাড়ির বুনন, নকশা তৈরি কৌশল রপ্ত করে। ওরা পূর্ববঙ্গে বিয়ে করে আত্মীয় হয়ে একাকার হয়ে বা সংমিশ্রণ ঘটায়। বাংলাদেশ বিভক্ত হওয়ার আগে ব্রিটিশ আমলের শেষদিকে ঢাকা, বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ি, বাজিতপুর, পাবনায় বসাক তাঁতিরা ছিল সংখ্যাঘরিষ্ট।

সম্পদ ঐশ্বর্যে ভরপুর ছিল পূর্ব বাংলা মানে আমাদের বাংলাদেশ। পাল বংশ, সেন বংশ, সুলতানি আমল, ব্রিটিশ শাসন, বারবার আক্রমণ হয়েছে এ দেশে। হাজার বছরের ঐতিহ্য তাঁতের শাড়ি, সঙ্গে মসলিন, তারপর টাঙ্গাইল শাড়ি এসেছে তার নিজস্ব মহিমা, সুনাম ও তাঁতিদের কৃতিত্ব নিয়ে। জামদানির পর বস্ত্রখাতে টাঙ্গাইল শাড়ি যেন এক মাইলফলক। দেশের নাম ছড়িয়ে পড়ে বিদেশেও। গুণ, মান, মূল্য, আরামদায়ক, রুচি ও ডিজাইন টাঙ্গাইল শাড়িকে পৌঁছে দিয়েছে ভৌগলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে। মসলিনের পর জামদানি, বালুচুড়ি, টাঙ্গাইল শাড়ির নাম সবার মুখে মুখে। টাঙ্গাইল শাড়ি দামে তুলনামূলক সস্তা, পড়লে সুন্দর লাগে নারীকে, এই শাড়ি পরার পর শাড়ি থেকে খসখস একটা শব্দ আসে, যেন কেউ কানে কানে বলে দেয়- ‘ভুলো না আমায়’।

টাঙ্গাইলের নদী, চর, গজারি বন, বেঁচে থাকায় সব কিছুর সঙ্গে মিশে আছে টাঙ্গাইল শাড়ি, বাঙালি জাতির গর্ব হয়ে। টাঙ্গাইল বাইশ মৌজার অধিকাংশ লোকই ছিল বসাক সম্প্রদায়ের। ওরাই ছিল মসলিন বানানো তাঁতিদের বংশধর। বয়নশিল্পের যোদ্ধা। টাঙ্গাইল শাড়ির গ্লোবাল আইডেনটিটি নিয়ে ভারত ভুল তথ্য দিয়েছে। জিআই দেওয়া হয় এলাকাভিত্তিক। বাংলাদেশে টাঙ্গাইল শাড়ির আদি ইতিহাস লুকিয়ে আছে। টাঙ্গাইল শাড়ির সূতিকাগার জেলা বৃহত্তর ঢাকা, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, বাজিতপুর, পাবনা, নরসিংদী ও টাঙ্গাইল।

জানা যায়, তখন হাতে তাঁত চালানোর যুগ প্রায় শেষ, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায় সরকারি বয়ন স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১৮ সালে। টাঙ্গাইল শাড়ির পাইরে হাতে বুটি তোলা হয় জমিনে। পাইরে জ্যামিতিক ধরনের নকশা করে করা হতো। গুপ্ত যুগেও কালিদাসের কবিতায় শাড়ির কথা উল্লেখ আছে। ভারত, বাংলাদেশের নারীরা শাড়িকেই তাদের প্রধান পোশাক হিসেবে আবহমান কাল থেকে ধরে রেখেছে। বাংলাদেশের ঐতিহ্য হিসেবে টাঙ্গাইল শাড়ি মিশে আছে প্রতিটি বাঙালি নারীর হৃদয় কোণে। বসাক সম্প্রদায়ের তাঁতিদের জীবন, তাদের তৈরি শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে দুঃখ, কষ্ট, হাসি-কান্না, মিলন বিরহ লুকিয়ে আছে, যা শরীরে পেঁচিয়ে থাকা সুখী নারীরা বুঝবে কি করে? টাঙ্গাইল শাড়ির ভ্রুণ বাংলাদেশে, তা এখন যেখানে বা যেদেশেই তৈরি হোক বা বেড়ে উঠুক না কেন, তা এক স্কুলগামী বাচ্চারাও বুঝবে। হাজার বছর বেঁচে থাকুক আমাদের ঐতিহ্যের টাঙ্গাইল শাড়ি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close