শেলী সেনগুপ্তা

  ১৫ মার্চ, ২০২৪

এ সময়ের বাংলাদেশ

আমরা শ্বাস গ্রহণ করছি একটি স্বাধীন দেশে। আমাদের পতাকার রং লাল। ১৯৭১ সালে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, অর্জিত হয়েছে শহীদের রক্তে রঞ্জিত পতাকা। তবে এ কথা বলতেই পারি, এই স্বাধীনতার বীজ বাংলার ইতিহাসে অনেক আগেই প্রথিত হয়েছিল।

একদা আমরা ছিলাম ব্রিটিশ উপনিবেশে, অতঃপর, ৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়ে দুটি দেশ হয়েছিল, একভাগের নাম ভারত এবং অন্যভাগের নাম পাকিস্তান। অখণ্ড ভারত ভেঙেছিল কারো ইচ্ছায় আবার কারো ষড়যন্ত্রে।

তবে এই ভাঙনের সুফল কতটুকু এসেছে, তা আজকের আলোচনার বাইরে। তবে এটাও ঠিক যে, ৭১ সালে স্বাধীনতার বীজ বপনের জমি ৪৭ সালের পর থেকে কর্ষিত হচ্ছিল। কারণ রাষ্ট্র গঠনের জন্য ধর্মের মিলটাই যথেষ্ট নয়, এর সঙ্গে সংস্কৃতি ও ভাষার মিলটুকুও অপরিহার্য, তা একটু সময় নিয়েই এ দেশের মানুষ বুঝতে পেরেছিল। এই উপলব্ধি আরো বেশি ঘনীভূত হয়েছিল একাত্তরের ৭ মার্চ রমনার রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দেন, তার মধ্য দিয়ে।

এবং এটাও ঠিক যে, গণমানুষের মুক্তির ও স্বাধীনতার লক্ষ্যে কোনো জননায়কের এমন আহ্বান আজ পর্যন্ত মানবভাগ্যের পরিবর্তনের সমগ্র ইতিহাসে বিরল। এটি ছিল ক্রান্তিকারী ঘটনার প্রেক্ষাপটে বাস্তবিকই যুগান্তকারী। মার্চের তুঙ্গ মুহূর্তে তার একটি আহ্বান এ দেশের সব মানুষের ক্রোধ-আশা-আকাঙ্ক্ষা সবই তাদের শিখর বিন্দু স্পর্শ করে। সেদিন একটি ভাষণ সবকিছু বদলে দিল। গণমানুষের এত দিনের জমানো ক্ষোভ আগুনের হলকার মতো বের হতে চাইল। এজন্য দরকার ভাষা, আবার এ কথাও ঠিক, ভাষা সব সময় সংহতি চায় এবং সংহতির জন্য দরকার দিকনির্দেশনা। মানুষ বুঝেছিল, অপেক্ষার প্রহর অনেক আগেই শেষ হয়েছে। সেদিনের সেই বিকেলে সেই দৈবকণ্ঠের আহ্বান যেন সেই দিকনির্দেশনাই দিয়ে গেল। মানুষ মরিয়া হয়ে উঠল অশুভলগ্নের পূর্ণগ্রাস থেকে বের হয়ে আসার জন্য। তাই গণমানুষের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা, আকাশের দিকে হাত বাড়ানো, স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা এবং ভয় থেকে অভয়ে উত্তরণের প্রচেষ্টা বাস্তবে পরিণত হয়েছিল জাতির পিতার অনলবর্ষী ভাষণের মাধ্যমে।

সেদিন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল স্বতস্ফূর্ত এবং সরাসরি চেতনায় প্রস্ফুটিত হয়ে হৃদয় থেকে উৎসারিত। অথচ এর মধ্যে ছিল না কোনো অতিকথন, ছিল না পুনরুক্তি কিংবা থেমে যাওয়া। সেদিন বঙ্গবন্ধুর দরাজ কণ্ঠ থেকে ঠাসবুননে সুসংবদ্ধ ধ্বনিসুষমায় শ্রেষ্ঠ ধ্রুপদি গানের দ্রুতলয়ে বের হয়ে আসা কিছু বাণী বাংলার আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে দিয়েছে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর দৃঢ় প্রতীজ্ঞা। সেদিন ইতিহাস মুখর হয়ে উঠেছিল, কণ্ঠ বেয়ে বের হয়ে এসেছিল ইতিহাস বদলের অমোঘ নির্দেশনা। মানুষের মনে জেগেছিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। সেদিন তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করে কাঁটাতারের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার মতো করে ভাষণ দিয়েছিলেন। খুব কম সময়ে, কোনো ঘাটতি না রেখে, যা বোঝানো দরকার তা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। আর যারা বোঝার তারা তা বুঝে নিয়েছিল। সেদিনের বিকেল ছিল মুক্তিসংগ্রামের মানসিক প্রস্তুতির বিকেল। সবাই মানল তিনিই বাংলাদেশের অবিসংবাদী নেতা। সেদিন থেকেই সবাই তার কথা আরো বেশি করে মানতে শুরু করল। এভাবেই স্বাধীনতার কার্যকর রূপায়ণ ঘটে।

তিনি কখনো ব্যক্তিগত ক্ষমতার ইচ্ছুক ছিলেন না, ভেবেছিলেন সামগ্রিক ক্ষমতার কথা। তাই সেদিনের ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই।’ এই অধিকার যেই সেই অধিকার নয়, এটি ছিল মুক্তির অধিকার। তাই তিনি বলেছিলেন, ‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।’ এই কথাগুলোর মধ্যে রয়েছে দীর্ঘদিনের লুকানো আবেগ। এর মধ্যে রয়েছে ১৯৬৬ সালে ঘোষিত ছয় দফা প্রস্তাবের রূপরেখা। সে ছয় দফার আলোকে রচিত হয়েছিল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার। আর এই নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিল আওয়ামী লীগ। তাই সেই বিকেলে তিনি কণ্ঠ ছেড়ে বলতে পেরেছিলেন, ‘এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’ মুক্তির আনন্দে জনগণ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তাদের মুক্তির কারিগরের নির্দেশনাকে সামনে রেখে। তিনি পেরেছিলেন দীর্ঘমেয়াদি নির্দেশনা দিতে। বলতে পেরেছিলেন- ‘আর যদি একটি গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে, সবকিছুই আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি- তোমরা বন্ধ করে দেবে।’ খুবই সাহসী, আন্তরিক ও ইঙ্গিতপূর্ণ কথা- ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি’, বাস্তবেই তা ঘটেছিল, ইঙ্গিতে হুকুম দিয়ে গেছেন তিনি।

বাঙালির জীবনে নানা কারণে মার্চ শক্তি ও প্রেরণার উৎস। ২০০ বছরের পরাধীনতা থেকে মুক্তির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছিল মার্চেই। এ মাসেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে প্রধানত দুটি কারণ ছিল- একটি রাজনৈতিক মুক্তি এবং অন্যটি অর্থনৈতিক মুক্তি। তবে এর সঙ্গে শিক্ষাগত মুক্তি ও সাংস্কৃতিক মুক্তিকেও স্বীকার করে নিতে হয়।

এ কথা ঠিক যে, স্বাধীনতা লাভের অনেক আগে থেকেই আমরা সব ধরনের উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত ছিলাম। ফলে রাজনৈতিক স্বাধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মূল উদ্দেশ্য ছিল।

প্রকৃত পক্ষে সেদিনের ভাষণে বলেছিলেন, ‘এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ’, এই কথার মাধ্যমে তিনি অর্থনৈতিক মুক্তির কথাও বলেছিলেন।

সেই লক্ষ্য সামনে রেখে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের অগ্রগতির জন্য দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক পরিকল্পনার প্রবর্তন করেন। তার অর্থনৈতিক আদর্শ ও কৌশল ছিল নিজস্ব সম্পদের ওপর দেশকে দাঁড় করানো। এজন্য স্বাধীনতা লাভের পরপরই সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে সোনার বাংলা গড়ার সংগ্রামে নিয়োজিত হন। দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে তার দ্বারা গৃহীত উদ্যোগ দ্বারাই পরে অর্থনীতির একটি মজবুত ভিত্তি নির্মাণ করা সম্ভব হয়েছে। তার গৃহীত উদ্যোগে মূল অনুষঙ্গ মানুষ। মানবিক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে তিনি একই সূত্রে দেখতে চেয়েছেন। বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু অবিচ্ছিন্ন, এজন্য ৭ মার্চের বিকেলে তিনি একটি স্বাধীন দেশ পরিচালনার সব দিকনির্দেশনা দিয়ে রেখেছিলেন।

দীর্ঘদিন পর বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেন, মানবিক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন একে অন্যের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত, কারণ মানবিক উন্নয়ন না হলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।

যে কথা জাতির জনক অনেক আগে বলেছেন, সে কথা দীর্ঘদিন পর বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেন। এ কথা বলার মধ্যে জাতির জনকের গভীর দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়, একই সঙ্গে বোঝা যায় চিন্তা এবং চেতনায় তিনি কতটুকু অগ্রগামী ছিলেন।

বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষের কথা গভীরভাবে ভেবেছেন এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তিনি অনেক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ভূমিকা রেখেছেন। শুরু থেকেই তার উদ্দেশ্য ছিল নিজস্ব অর্থনীতির ওপরে দেশকে দাঁড় করানো। কারণ তিনি বুঝেছিলেন নিজের পায়ের নিচের মাটি মজবুত করার কাজ নিজেকেই করতে হয়। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও কৌশলের সুদূরপ্রসারী চিন্তার ধারাবাহিকতায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এটি ছিল একটি কঠিন সিদ্ধান্ত। তবে সিদ্ধান্তটি ছিল সময়োচিত। এতে জনগণের মধ্যে একটি ইতিবচক মনোভাব গড়ে ওঠে। সে সময় বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উদ্বুদ্ধ জনগণের দেশপ্রেম ও ইতিবাচক মনোভাবের ফলে ‘আমরাও পারি’ এই বিশ্বাস জাগ্রত হয়। এই বিশ্বাসকে ভিত্তি করে পদ্মা সেতু সমগ্র দেশের উন্নয়নের একটি বিশেষ ভিত্তি।

তা ছাড়া বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্নপূরণ ও একটি সমৃদ্ধ জাতি গঠনের জন্য বর্তমান সরকার ‘২০২১ ভিশন’ বাস্তবায়ন করে চলছে। বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের উন্নয়নমুখী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মকাণ্ডের ফলে দেশে আর্থিক খাতের সুস্থিতি অনেকটায় বৃদ্ধি পেয়েছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, কৃষিনির্ভর অর্থনীতি থেকে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতিতে উন্নিত হওয়ার। তবে কৃষিকে বাদ দিয়ে নয়, কৃষি থেকে কাঁচামাল জোগানের ইচ্ছাও প্রকাশ করেন তিনি। কৃষির প্রতি জনগণকে আকৃষ্ট করার জন্য ৩২ জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ‘বঙ্গবন্ধু কৃষি পুরস্কার’ প্রদান করেন। জননেত্রী শেখ হাসিনা বুঝেছিলেন- সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হয়, তবে ঐতিহ্যকে বাদ দিয়ে কখনোই নয়। তাই কৃষিনির্ভর অর্থনীতিকে শিল্পনির্ভর করার জন্য কৃষিকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাই কৃষিবিষয়ক ব্যবহারিক শিক্ষা শিক্ষার্থীর পাঠ্যক্রমে রাখা হয়েছে।

বাংলাদেশ মৎস্যসম্পদেও সমৃদ্ধ, প্রতি বছর উৎপাদিত মৎস্যসম্পদ বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। এটিকে যদি বিজ্ঞানসম্মত করা যায়, তাহলে অর্থোপার্জন আরো বৃদ্ধি পাবে।

মৎস্যসম্পদ ছাড়াও হাঁস-মুরগি ও গবাদি পশুর বাণিজ্যিক উৎপাদন প্রক্রিয়া উন্নত করার মাধ্যমে অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখা যায়।

আমরা এখন বলতেই পারি, বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ৭ মার্চ বিকেলে দেখানো স্বপ্নের সঙ্গে, সেদিনের নির্দেশনার সঙ্গে চমৎকারভাবে মিলে যায় বর্তমান বাংলাদেশ পরিচালনা পদ্ধতি।

স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক মুক্তি যে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তার সর্বোৎকৃষ্ট প্রমাণ বাংলাদেশের পোশাকশিল্প। দীর্ঘ ২০০ বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত জনগণ নতুন করে ভাবতে শিখেছে। নিজেদের চিনতে শিখেছে। নিজের ভেতরের শক্তিকে জাগ্রত করে এগিয়ে যাওয়ার চেতনা অর্জিত হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীন জনগণ বিশ্বের প্রথম শ্রেণির তৈরি পোশাক নির্মাতার স্থান দখল করতে সক্ষম হয়েছে। এটি সম্ভব হয়েছে স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষ হওয়ার সৌভাগ্য অর্জনের ফলে।

পরিশেষে বলতে পারি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের পথে অনেক ধাপ এগিয়ে গেছি। এখন দরকার বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর একই সারিতে অবস্থা নেওয়া। সেজন্য সবাইকে দেশপ্রেম, দৃঢ়তা, সততা নিয়ে একযোগে কাজ করতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। এখনই সময় উন্নয়নের পতাকাতলে সবাই সমবেত হওয়া।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close