ইলিয়াস ফারুকী

  ২৬ মে, ২০২৩

চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথ

রবিঠাকুর তার চিত্রাঙ্কন প্রতিভাকে ‘শেষ বয়সের প্রিয়া’ বলেছেন

চিত্রাঙ্কনের ক্ষেত্রে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোনোপ্রকার পুথিগত কিংবা প্রথাগত বিদ্যা ছিল না। কিন্তু যার ভেতরে প্রকৃতি নিজেই প্রতিভায় পরিপূর্ণ করে রেখেছে, তাকে কি ঠেকিয়ে রাখা যায়! লিখতে গিয়ে এবং বিভিন্ন লেখা পরিমার্জন করতে গিয়ে যে কাটাকুটির সৃষ্টি হলো, তিনি হয়তো সেখানেও তার অবচেতন মনে শৈল্পিক কিছু খুঁজে পেলেন। সেগুলোকে আনমনে একটি রূপ দেওয়ার চেষ্টা থেকেই তার ভেতর ছবি আঁকার ইচ্ছা প্রবল হয়ে ওঠে। শ্রেষ্ঠতা লাভের পর যে বয়সে মানুষ সাধারণত তৃপ্তিতে ঢেকুর তুলে নিজ সৃষ্টির বন্দনায় লিপ্ত হয়, তিনি পঁয়ষট্টির বেশি বয়সে শুরু করলেন আরেক সৃষ্টির অধ্যায়, চিত্রাঙ্কন। কবিগুরু ‘পূরবী’ রচনাকালে (১৯২৪-২৫) পা-ুলিপির খাতায় তার সব আঁকাআঁকি শুরু করলেন। প্রথমদিকে কলমের স্কেচ দিয়ে শুরু করা হলেও ১৯২৮ থেকে আনমনে শুরু হলো তার কলম স্কেচ এবং অঙ্কনচিত্র, যার সংখ্যা পরে ২৫০০-এর ওপরে ছিল। এগুলোর মাঝ থেকে তার ১৫৭৪টি শিল্পকর্ম এখনো শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত আছে। রবিঠাকুর তার চিত্রাঙ্কন প্রতিভাকে ‘শেষ বয়সের প্রিয়া’ বলে অভিহিত করেছেন।

আগেই উল্লেখ করেছি, লেখালেখির বিভিন্ন পরিমার্জন থেকেই তার চিত্রকর হয়ে ওঠা, তবে এর স্পষ্ট দিক খুঁজে পাওয়া যায় অভিজিৎ রায়ের লেখা ‘ওকাম্পো আর রবীন্দ্রনাথ : কিছু অশ্রুত গুঞ্জন’-এ। অভিজিৎ তার লেখায় ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ভাষায় বর্ণনা করেছেন, ‘ওঁর একটি ছোটখাতা টেবিলে পড়ে থাকত, ওরই মধ্যে কবিতা লিখতেন বাংলায়। বাংলা বলেই যখন তখন খাতাটা খুলে দেখা আমার পক্ষে তেমন দোষের কিছু ছিল না। এই খাতা আমায় বিস্মিত করল, মুগ্ধ করল। লেখার নানা কাটাকুটিকে একত্রে জুড়ে দিয়ে তার ওপর কলমের আঁচড় কাটতে যেন মজা পেতেন কবি। এই আঁকিবুঁকি থেকে বেরিয়ে আসত নানা রকমের মুখ, প্রাগৈতিহাসিক দানব, সরীসৃপ অথবা নানা আবলতাবল। সমস্ত ভুল, সমস্ত বাতিল করা লাইন, কবিতা থেকে বহিষ্কৃত সব শব্দ এমনি করে পুনর্জীবিত হতো এক ভিন্ন রূপের জগতে, আমাদের দিকে তাকিয়ে যেন স্নিগ্ধ কৌতুকে হাসত তারা... এই ছোট খাতাটাই হলো শিল্পী রবীন্দ্রনাথের সূচনাপর্ব।’

অনেকেই লিখেছেন, শিল্পকলায় রবীন্দ্রনাথের আশৈশব টান ছিল। তার পারিবারিক আবহ সম্ভবত এ টানের কারণ। ঠাকুর পরিবারে আগেই এ চর্চা ছিল। ৬ নম্বর জোড়াসাঁকোর ‘দক্ষিণ বারান্দায় শিল্পচর্চায় মগ্ন গগনেন্দ্রনাথ এবং অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেশ-বিদেশ থেকে অনেক শিল্পপণ্ডিত ও বোদ্ধার আনাগোনা ছিল। তার নিজ বাড়িতেই অবনীন্দ্রনাথ, গগনেদ্রনাথ, যামিনী রায় বা রামকিঙ্করের মতো ব্যক্তিরা শিল্পচর্চা করেছেন। তবু তিনি নিজের জীবনের প্রথম ভাগে চিত্রাঙ্কনে তেমনভাবে উৎসাহিত হননি কিংবা নিজের করে নিতে পারেননি। এ কথাও বলা যাবে না যে, চিত্রকলার প্রতি তিনি একেবারেই উদাসীন ছিলেন! কারণ দেখা গেছে, ১৮৭৮-৮২-তে ‘মালতী’ নামে একটি পুথির পাতায় ছবি আঁকতেন।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ১৮৮৯ সালের দিকে তিনি সার্বক্ষণিক পকেট নোটবুক রাখতেন এবং মনের ইচ্ছায় যখন যা ভালো লাগত, তা-ই আঁকতেন। ১৯২৩ সালে ‘রক্তকরবী’র পা-ুলিপির খসড়া পাতায়ও পরিমার্জনের চেষ্টা থেকে আঁকিবুঁকির উদাহরণ রয়েছে। ছাইচাপা আগুন যে একসময় বিকশিত হয়-ই, তাই তো তার ভেতরের সুপ্ত এ কলা তার পরিণত বয়সে ঠিকই ছাইচাপা ভেদ করে বেরিয়ে এসেছিল। তিনি পরিকল্পনা করে যে আঁকতে বসতেন, তা না। শিল্পীত আবেগ এবং কলমের রেখার টানে তিনি হয়তো কিছু একটা শুরু করতেন, যা পরে শিল্পের রূপ গ্রহণ করত।

তার অঙ্কিত ছবির মূল বিষয় ছিল মুখমণ্ডল বা মুখাবয়বের ছবি। তবে রেখাচিত্র আঁকতে আঁকতে তিনি অদ্ভুত এবং কাল্পনিক সব প্রাণীর ছবি এঁকে ফেলতেন। প্রাকৃতিক দৃশ্য, অতিপ্রাকৃতিক এবং কখনো ন্যুড ছবিও এঁকেছেন। তবে মূলত তিনি মুখমণ্ডল বা মুখাবয়বের চিত্রকলার ওপরই বেশি জোর দিয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথ কলমের টানে রেখার পর রেখা, বিন্দুর পর বিন্দু কিংবা মনের মাধুরী মিশিয়ে বিভিন্ন ডিজাইন তৈরি করতেন। তার এ অদ্ভুত এবং অনিশ্চিত অঙ্কন পদ্ধতির মাধ্যমে হয়তো একসময় ক্যানভাসে একটি অবয়ব ফুটে উঠত। সেই চিত্রের ওপর চলত তার পরবর্তী পরিচর্যা। এভাবে তিনি একটি ছবিতে প্রাণসঞ্চার করতেন। এ ধরনের চিত্রকলার অভ্যাসে তিনি ছিলেন অনন্য, যা আর কারো ক্ষেত্রে দেখা যেত না। তার আরো একটি মজার বিষয় ছিল, সঠিক দৈর্ঘ্য প্রস্থহীন তথা মাপহীন ক্যানভাস। চিত্র অঙ্কনের ক্ষেত্রে চিত্রের মহৎ দিকটির চেয়ে ওই চিত্র কতটা চিত্র হয়ে উঠেছে, তার প্রতিই তিনি বেশি যত্নবান ছিলেন।

মূলত কলমকে প্রাধান্য দিয়ে রেখা ও বিন্দুপুঞ্জের সঞ্চিত শক্তি দিয়ে গড়ে তোলা তার নিজের সৃষ্টির প্রতি তিনি নিজেই বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন। ‘ঐ গুলি কেবল রেখাই নয়, ঐগুলি তার থেকেও কিছু বেশি, আমার চিত্রাঙ্কিত স্বপ্ন এক কাব্যিক কল্পনার দর্শন। আমার চিত্র রেখার ছন্দে আবদ্ধ কবিতা।’

তিনি আরো বলেছেন, ‘আমি বিশ্ব সংসারকে কল্পনা করতে পারি রেখার জগৎ সংসার হিসেবে যেগুলো তাদেরকে মূর্ত প্রবাহের অন্তহীন শৃঙ্খলে পর্বত-শ্রেণি ও মেঘমালা, বৃক্ষরাজি, ঝরনাধারা, অগ্নিগর্ভ জ্যোতিষ্ক মণ্ডল, নিরন্তর জীবন স্রোত, নিশ্চুপ মহাকাল নিরবধি মহাশূন্য পেরিয়ে ভঙ্গিমারাজির মহাসংগীত মিলিত হয় যায় রেখাপুঞ্জের আর্তনাদে; যেন তারা আকস্মিক ইচ্ছাপূরণের আকাঙ্ক্ষায় সঙ্গীহিনা বেদেনীর লক্ষ্যহীন ঘুরে বেড়ানো।’

চিত্রকলার জগতে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অভিনব স্রষ্টা, যার সৃষ্টি ছিল অনন্য সাধারণ। তার চিত্রকলার সৃষ্টির ব্যাখ্যা শুধু তিনিই দিতে পারেন, অন্য কেউ নয়। তাই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্র চিত্রকলা জগতের অভিনব সৃষ্টি-অনন্য সাধারণ। তার চিত্রকলা একান্ত রূপে তার নিজস্ব, তার ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যের দ্বারা চিহ্নিত। এ চিত্রকলার হুবহু অনুকরণ কারো পক্ষেই যেমন সম্ভবপর নয়, তেমনি মনের মতো করে সমুচিত ব্যাখ্যা দেওয়া অসম্ভব। কোনো কলা-সমালোচক যে একে কোনো বিশিষ্ট কলারীতি অন্তর্ভুক্ত করে দেখাবেন কিংবা তার নিজস্ব কোনো ধরাবাধা তত্ত্বের সঙ্গে মিলিয়ে এর ব্যাখ্যা দেবেন তারও কোনো সম্ভাবনা নেই।’

তার নিজের চিত্রকলা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে লেখা চিঠিতে বলেছিলেন, ‘আমি কোনো বিষয়ে ভেবে আঁকিনে- দৈবক্রমে একটা অজ্ঞাতকুলশিল চেহারা চলতি কলমের মুখে খাড়া হয়ে ওঠে।’ কবিগুরুর এ কথাই প্রমাণ করে যে, তার চিত্রাঙ্কন সম্পর্কে অবনীন্দ্রনাথ কতটা সত্য বলেছিলেন।

শিল্পী নিজে তার শিল্পকর্মকে শিরোনামহীন রাখলেও, সময় এবং গুরুত্ব অনুধাবনে অবস্থানের এবং শিল্প-কর্মের প্রেক্ষিতে তার শিল্পেরও নামকরণ হয়েছে এবং এগুলোর মাঝে যেগুলো যথেষ্ট দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে যেমন- পূরবী, প্রতিকৃতি, মা ও ছেলে, নারী দৃশ্য, নিসর্গ, বৃক্ষরাজি ইত্যাদি। যেই ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর আবিষ্কারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রশিল্পী হওয়ার এক বিরাট অবস্থান রয়েছে, তারই প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ এবং সহযোগিতায় ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসের বিখ্যাত গ্যালারি পিগ্যালে তার প্রথম চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। প্যারিসের পিগ্যালে প্রদর্শনীর পর তার চিত্রকর্ম নিয়ে অনেক কথাও উঠল। অনেক বন্ধু মুখ টিপে টিটকারির হাসিও হাসল। কিন্তু যিনি অদম্য অজেয় তার কর্মকে যে প্রকৃতিও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে নিজেকে ধন্য মনে করে। তাই মে মাসে প্যারিসের প্রদর্শনীর পরপরই জুনে বার্মিংহাম ও ইন্ডিয়া সোসাইটি, লন্ডনে। জুলাইয়ে বার্লিন ড্রেসডেন, মিউনিখে। আগস্টে কোপেনহেগেন ও জেনেভায়। সেপ্টেম্বরে মস্কো এবং অক্টোবরে আমেরিকার বোস্টনে। ডিসেম্বরে নিউইয়র্ক এবং ফিলাডেলফিয়াতে প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। তার এ ধারাবাহিক চিত্রপ্রদর্শনী মুখ টিপে বাঁকা হাসির লোকদের স্তব্ধ করে দিয়ে তার সাহিত্যকর্মের মতোই শিল্পকর্মও ইতিহাসে নিজেকে ঠাঁই করে নেয়। হয়তো সে কারণেই শিল্পবোদ্ধার স্বর্গভূমি প্যারিস থেকে তার চিত্রের প্রদর্শনী শুরু করে সমালোচকদের মুখে তালা দিয়ে ১৯৩২ সালে কলকাতায় প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিলেন। তার ইউরোপ ও আমেরিকার প্রদর্শনীর পর তখনকার বিখ্যাত কলা বিশেষজ্ঞ এবং চিত্রকর আঁদ্রে কার্পেলেস কিংবা পল ভেলেরি এবং আঁদ্রে জিদের মতো ব্যক্তিরা ঠাকুরের চিত্রকর্মকে ‘আগামী যুগের আর্ট হিসেবে’ অভিহীত করেছিলেন। এমনকি ভারতবর্ষের চিত্রকর নন্দলাল বসুও তার চিত্রকর্মকে ‘অনন্য সাধারণ’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। বলা হয়ে থাকে, ‘রবি ঠাকুরের শিল্পজ্ঞান ছিল না!’ তার শুরু ঝোঁকের বশে হলেও পরে তিনি সহজেই চিত্রকলার কলাকে আত্মস্থ করেছিলেন। তার চিত্রকলার বিষয়বস্তু ছিল তার ভেতরের চেতনা, অনুভব- যা ছিল সহজ-সরল কিন্তু বাঙময়।

রবীন্দ্রনাথ প্রগতীকে কখনো অস্বীকার করেননি। তার সময় ফ্রান্স ও জার্মান বিশ্ব শিল্পকলার নেতৃত্বে। জার্মান চিত্রশিল্পে এক্সপ্রেনিজমের প্রভাব (শিল্পীর অন্তর্হিত অনুভূতির একান্ত ভাবনাকে ফুটিয়ে তোলা) আমরা তার সৃষ্ট শিল্পে দেখতে পাই।

তিনি ১৯২০-৩০ সালের মধ্যে তিনবার জার্মানি ভ্রমণ করেছিলেন, হয়তো তার শিল্পকর্মে এর প্রভাব পড়েছিল। তার অনুভূতি তাকে স্বাধীন চিন্তাশৈলী থেকে চিত্রকলার সৃষ্টিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। হয়তো সেই কারণে ইউরোপীয় চিত্রামোদীরা ঠাকুরের ছবিতে ইউরোপীয় আঁদলই বেশি খুঁজে পেয়েছেন। তাইতো যামিনী রায় তার চিত্রকলা নিয়ে বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ছবি আঁকেন খাঁটি ইউরোপিয়ান ভঙ্গিতে...।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close