আশরাফুল ইসলাম

  ১০ মার্চ, ২০২৩

সেঁজুতি অথবা বসন্ত বিলাস

রাত দেড়টা। প্ল্যাটফরম-৩-এ দাঁড়িয়ে আছি। ২টার দিকে পৌঁছবে ট্রেন। সন্ধ্যা ৭টায় পৌঁছানোর কথা ছিল। টঙ্গী রেলস্টেশনের কাছে বগি লাইনচ্যুত হয়েছে কোনো একটা ট্রেনের। সে কারণে রাত ১০টা পর্যন্ত ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। সেঁজুতি ভয় পেয়ে কয়েকবার ফোন দিয়েছে। মেয়ে মানুষ, একা কখনো রাতে জার্নি করেনি। ঢাকায় ডিজাইনারদের যে বড়সড় একটা গেট টুগেদার হলো, মূলত সেখানেই অংশ নিতে গিয়েছিল সেঁজুতি। ঘণ্টাখানেক হলো সেঁজুতির ফোন বন্ধ পাচ্ছি। ও বারবার বলছিল ফোনের চার্জ শেষের পথে। আমি যেন স্টেশনেই থাকি।

সেঁজুতি আমার স্ত্রী। বিয়ে করেছি তিন মাস হচ্ছে। মোটামুটি সুখের সময়। হানিমুন বলতে যা বোঝায়, তা হয়নি। দুজনেই ভীষণ ব্যস্ত। আমি একটা সুপার শপের বিক্রয়কর্মী। বেতন বেশি না। মাস্টার্স পাস করেছি দুই বছর আগে। চাকরি বাকরি হয়নি। কয়েক দিন ফুডপান্ডার ডেলিভারি দিয়েছি। রাতের শিফটের ডেলিভারিগুলোতে স্কোর বেশি পাওয়া যায়, উপার্জন বেশি। হঠাৎ করে আমার শ্বাসকষ্টের সমস্যা শুরু হয়। রাতের হিমশীতল বাতাস বুকে বসে গিয়ে ভয়াবহ সমস্যা হয়। সে কারণেই ফুডপান্ডার কাজটা ছাড়তে হলো। বেঁচে থাকার তাগিদে সুপার শপের চাকরিটা নিই। সেঁজুতির সঙ্গে পরিচয় এই সুপার শপে। কসমেটিকসসামগ্রী কিনতে এসেছিল। কার্টে সবকিছু তোলার পর বিল দিতে যেয়ে হঠাৎ করে সে আবিষ্কার করে পার্স আনেনি সঙ্গে। বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে লজ্জায় তার মুখ লাল হয়ে গেছিল। চারদিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছে। আমি ব্যাপারটা লক্ষ্য করি। আমার মনে হলো এই বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে তাকে উদ্ধার করা উচিত। কিছু একটা করতে হবে। হঠাৎ করে আমি তাকে ডেকে বললাম, ম্যাডাম, যে লোশনটা আপনি খুঁজছিলেন সেটা পেয়েছি, একটু এদিকে আসেন। সেঁজুতি কিছুটা ইতস্তত বোধ করে ধীর পায়ে এগিয়ে এলো। সন্দেহ নিয়ে বলল, আমি তো কোনো লোশন খোঁজ করিনি ভাই।

আমি বললাম, লোশন মেইন ফ্যাক্টর না। সম্ভবত আপনি পার্স আনতে ভুলে গেছেন। ব্যাপার না। এ রকম হতে পারে। আমি আপনাকে টাকাটা দিচ্ছি। পরবর্তী যেদিন আসবেন, ফেরত দিয়ে দিয়েন। কিছুটা অবিশ্বাস এবং কিছুটা কৃতজ্ঞতা নিয়ে সেঁজুতি আমার দিকে তাকালো। কিছু বলতে যাবে, তখনই আমি এক হাজার টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দিলাম।

ছলছল চোখে সেঁজুতি বলল, ভাই, আপনি আমাকে বাঁচালেন। আপনার ফোন নম্বরটা দিন প্লিজ। যে নম্বরে বিকাশ/নগদ কিছু আছে। আমি বাসায় গিয়েই পাঠানোর ব্যবস্থা করব।

আমি বললাম, নম্বর নিন। তবে বিকাশ নগদ কিছু খোলা নেই। এত তাড়াহুড়ার কিছু নাই ম্যাডাম। আপনি পরবর্তী দিন ফেরত দিলেই হবে।

একটা মুচকি হাসি দিয়ে সেঁজুতি চলে গেল। তারপর থেকে সারাক্ষণ ওই হাসিটা আমার চোখে লেগে থাকে। কি যেন একটা মায়ায় আটকে গেছি।

পরের একমাস সেঁজুতি আসেনি। ফোনও করেনি। সেঁজুতির সেই মায়াকাড়া মুচকি হাসি ক্রমেই স্মৃতি থেকে মুছে যাওয়ার উপক্রম, তখনই ফোনটা এলো। রাত সাড়ে ১০টা। শপ থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে চায়ের পানি বসিয়েছি। তখন ফোন বেজে উঠল। ট্রু কলারে নাম উঠেছে Sejuti ku.

মনে মনে ধরে নিলাম আমার খুলনা ইউনিভার্সিটির পরিচিত কেউ ফোন করেছে। খুলনা ইউনিভার্সিটির কারো ফোন নম্বর সেভ করার সময় শেষে শঁ লিখি, যাতে সহজে বোঝা যায়। সেঁজুতি নামে তিন-চারটা ব্যাচমেট আছে আমার, তাদের কেউ হবে। কোনো দরকারে হয়তো ফোন করেছে। ফোন ধরে এমন ভাব করতে হবে, যেন তাকে চিনতে পেরেছি। রিসিভ করে বললাম, সেঁজুতি কেমন আছিস? অনেক দিন তোর কোনো খোঁজ নেই।

ওপাশ থেকে নীরবতা।

আবারও বললাম, কীরে কথা কস না ক্যা?

এবার কথা বলল, আমার নাম আপনি জানেন?

কণ্ঠটা তো পরিচিত না। বিশেষ করে ক্যাম্পাসের সেঁজুতি নামধারী আমার যারা ব্যাচমেট, কারো কণ্ঠের সঙ্গে যায় না। সবার কণ্ঠই পরিচিত। কিন্তু এই কণ্ঠটা আগে তেমন শুনেছি মনে পড়ছে না।

আমি এবার একটু নরম স্বরে বললাম, কে বলছেন?

- আমার নাম তো আপনি বলেই দিয়েছেন। সেঁজুতি। আবার ‘কে বলছেন’ বলার মানে কী?

- আমি আসলে কনফিউশনে আছি। আমার ক্যাম্পাসের তিন-চারটা সেঁজুতিকে আমি চিনি। তাদের কণ্ঠের সঙ্গে আপনার কণ্ঠ যায় না। আমি ট্রু কলারে নাম দেখেই আন্দাজে ঢিল ছুঁড়েছি। মেলেনি। ক্ষমা করবেন।

- ঠিক আছে ক্ষমা করলাম। আপনি কোন ক্যাম্পাসের?

- খুলনা ইউনিভার্সিটি।

- আমিও খুলনা ইউনিভার্সিটি। তবে আপনার ব্যাচমেট না। জুনিয়র হবো। সে কারণে কণ্ঠ চেনেননি। তবে আমাদের দেখা হয়েছে সুপার শপে। আপনি এক হাজার টাকা ধার দিয়ে আমার ইজ্জত বাঁচিয়েছেন। আমি কৃতজ্ঞ। ফোন নম্বর নিয়েছিলাম। তারপর ফোন করা হয়নি। আমার আরো একটা উপকার করতে হবে ভাইয়া।

- কী উপকার বলেন।

- আগামীকাল দেখা করে বলতে চাচ্ছি। সিরিয়াস উপকার লাগবে। বিকেলে আপনি সুপার শপ থেকে ছুটি নেবেন। এক দিনের বেতন কাটা গেলে যাবে। আমি পুষিয়ে দেব। আর যেহেতু আমি আপনার জুনিয়র হবো, সুতরাং তুমি অথবা তুই বলতে পারেন। কাল বিকালে কফি লাউঞ্জে একটু বসব। গুরুতর আলাপ আছে। বিকাল ৫টায় আসবেন।

মুখোমুখি বসে আছি সেঁজুতি আর আমি। বহুদিন পর পরিচিত কাউকে দেখলে যেমন ভালো লাগা কাজ করে, আমার তেমন অনুভূতি হচ্ছে। কেন জানি না সেঁজুতি কোনো ভূমিকা না করে বলা শুরু করল, ভাইয়া, আমি একটা বিপদে পড়েছিঁ ক্যাম্পাসের সিনিয়র তিন-চারজন আমার পেছনে লেগেছে। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে তারা আমাকে প্রপোজ করেছে, ইশারা ইঙ্গিতে নানা কিছু বোঝাতে চায়। গুন্ডা টাইপের এসব ছেলের আচরণে আমি বিরক্ত। আমার বাবা-মা কেউ নেই। একটা গাড়ি এক্সিডেন্টে একই সময়ে মারা যায়, সৌভাগ্য অথবা দুর্ভাগ্যক্রমে আমি বেঁচে যাই। আগে থেকেই ফ্রিল্যান্সিং করতাম। এখন আরো দক্ষ। গ্রাফিক্স ডিজাইন করি। আপওয়ার্কে আমার প্রোফাইল ভালো রিচ, আপনি খেয়াল করলে বুঝতে পারবেন। আমি আপনাকে যে কথাটা বলতে চাই, সেটা হলো আপনি আমাকে বিয়ে করে ফ্যালেন। কথাটা ফাইজলামি করে বলছি না। এর আগে আমার কোনো ছোটখাটো বিপদ কিংবা সমস্যায় কেউ এগিয়ে আসেনি। সবাই মজা নিয়েছে, হো হো করে হেসেছে। সেদিন সুপারশপে আমার বিব্রতকর অবস্থা আপনি বুঝেছেন, আমাকে সাহায্য করার জন্য দারুণ টেকনিক করে লোশনের কথা বলেছেন। সেদিন বাসায় যাওয়ার পর আপনার কথা আমি অনেক ভেবেছি। তারপর আপনার সম্পর্কে নিজের মতো করে একটু খোঁজখবর করেছি। আপনি ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। কোনো কাজকেই ছোট করে দ্যাখেন না। স্বনামধন্য ভার্সিটি থেকে মাস্টার্স পাসের সার্টিফিকেট থাকলেও আপনি চাকরি না পেয়ে হতাশ হননি। ফুডপান্ডার ডেলিভারি দিয়েছেন, সুপারশপে কাজ করছেন এখন। আমি আপনাকে শ্রদ্ধা করি। আমার টাকাণ্ডপয়সা আছে বেশ, মার্কেটপ্লেসে আমার কাজের চাহিদা আছে সুতরাং ইনকাম ভালোই। আমি বিশ্বস্ত কাউকে খুঁজছিলাম, যে আমার টাকাণ্ডপয়সার লোভে আমার কাছে আসবে না। ভালোবাসা এবং বিশ্বাস মেশানো দৃষ্টি যে আমার ওপর রাখবে। অনেক ভেবেচিন্তে আপনাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আজই বিয়ে করব, চলেন। বিয়ের ছবি ফেসবুকে দিয়ে গট ম্যারিড স্ট্যাটাস দিতে হবে। তাহলে আমার পেছনে ঘুর ঘুর করা লোভী ছেলেদের মুখে ঝামা ঘঁষে দেওয়া হবে। ওঠেন।

আমি অবাক হয়ে সেঁজুতির দিকে তাকিয়ে রইলাম। অতি আবেগে টিনএজার, নাইন টেনে পড়া ছেলেমেয়ে পাগলামি করে, সেঁজুতি যথেষ্ঠ ম্যাচিউরড, ফ্রিল্যান্সিং করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং যা করবে ভেবেচিন্তেই করবে। আমি শুধু বললাম, অনেক ফরমালিটি আছে তো। আর দেনমোহরের টাকাণ্ডপয়সা...

- দেনমোহরের টাকা আগেই উসুল। যে এক হাজার টাকা ধার দিছিলেন, ওটাই দেনমোহর। শোধ হয়ে গেছে। আমার ব্যাগের ভেতর শাড়ি আছে। ওটা শুধু পরব, আর আপনি তো পাঞ্জাবি পরেই এসেছেন। অসুবিধা নাই। দুই একজন বন্ধুবান্ধবকে ডাকেন, সাক্ষী-উকিল এসব কি ব্যাপারস্যাপার আছে।

আমার কী হলো জানি না। ঘোরের মাথায় সেঁজুতিকে বিয়ে করে ফেললাম। মেসবাড়ি ছেড়ে দিয়ে সেঁজুতির ফ্ল্যাটবাড়িতে উঠলাম। তবে বিয়ের পর থেকে সে রকম একান্ত সময় কাটানো হয়নি। সেঁজুতি সারারাত কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে বসে থাকে, মার্কেটপ্লেসে কাজ করে। আমার জন্য ততটা সময় বের করতে পারে না। দিনের বেলা আমি শপে কাজ করি। একান্ত সময় বলতে কিছু আসেনি। আমি একসময় ভাবতে শুরু করলাম ঝোঁকের বসে কি ভুল সিদ্ধান্ত নিলাম? ফ্রিল্যান্সার একটা মেয়েকে হুট করে বিয়ে করে ফেলাটা বুদ্ধিমানের কাজ হলো?

বাইরে বসন্তের বাতাস। আকাশে গোল চাঁদ। রূপকথার মতো পরিবেশ। এ রকম জোছনায় গৃহত্যাগী হতে হয়। হুমায়ূন আহমেদের বইতে পড়েছি। গৃহত্যাগী জোছনা নামে চমৎকার একটা কবিতাও আছে। আমার হঠাৎ করে মনে হলো আজ বাসায় ফিরে যাব না। সেঁজুতি ২টার দিকে স্টেশনে নামলে ওকে নিয়ে সারারাত রেললাইনে বসে থাকব। অপার্থিব একটা জোছনা আমাদের ঘিরে থাকবে। বসন্তের মাতাল করা বাতাস আমাদের শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দেবে। একটু উষ্ণতার আশায় সেঁজুতি গভীর আবেগে আমাকে জড়িয়ে ধরবে। কী রোমান্টিক দৃশ্য! এক প্রকার হানিমুন বলা যেতে পারে। বসন্তের মিষ্টি বাতাসকে মধু বলা যেতে পারে। আর আকাশের গোল চাঁদটা তো মুন। সুতরাং রেললাইনে বসে হানিমুন। ব্যাপারটা ভাবতেই আমার শরীরে শিহরণ জাগছে।

ট্রেনের হুইসেল শুনতে পেলাম। প্রতীক্ষিত ট্রেনটি ধীরে ধীরে প্ল্যাটফরমের দিকে এগিয়ে আসছে। এই ট্রেনে সেঁজুতি আছে। আমার স্ত্রী। আমার হার্টবিট বেড়ে গেছে। ঠিক যেমন মাধ্যমিকে পড়ার সময় প্রথম ভালোলাগার মেয়েটিকে দেখলে বুক ধড়ফড় করা একটা অনুভূতি হয়, কিছুটা সে রকম।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close