নাহিদ হাসান রবিন

  ২০ জানুয়ারি, ২০২৩

গল্প

অবিচার

মাঝ রাতে হঠাৎ হইচই। পুরো গ্রামের লোকজন ছোটাছুটি করে মোল্লাবাড়ির দিকে যায়। চুরির দায়ে তোজাম সরকারকে মোল্লাবাড়ির কাঁঠাল গাছের সঙ্গে রশি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। লজ্জায় হাঁটুর ভেতর মাথা দিয়ে নিচু হয়ে বসে আছে তোজাম। গ্রামের মেম্বার সাহেব কথা বলায় একটুখানি মাথা তোলে তোজাম। চোখ দুটো ফোলা, লাল বর্ণ হয়ে আছে। একটু আগে পানি ঝরেছে বোঝা যাচ্ছে। বাড়িজুড়ে থইথই করছে মানুষ। একেক জনের একেক রকম কথা। তোজাম মাথা তুলছে না। মোল্লাবাড়ির ছোট ছেলেটি একটি লাথি বসায় তোজামকে। মেম্বার সাহেব নিষেধ করায় থেমে যায়। সবার সামনে মেম্বার সাহেব বললেন, তোজামকে কেউ মারবেন না। কাল দিনে বিচার হবে। পরে গ্রামের লোকজনের পরামর্শে তোজামকে মেম্বার বাড়ির কাচারি ঘরে আটকে রাখা হয়। পাহারা দেওয়ার জন্য দুজন লোক দেওয়া হয়।

বিশাল এক ঘোরের মধ্যে রাত কাটে তোজামের। পাহারাদারের কাছ থেকে কয়েকটি বিড়ি চেয়ে নিয়ে রাতভর টেনেছে। মেম্বার সাহেব রাতের খাবার দিলেও, তোজাম তা খায়নি। এ অবস্থায় খাওয়ার কথাও না। এই ঘরে অনেক রাত কেটেছে তোজামের। মেম্বার সাহেবের ছেলে তোজামের বন্ধু। ওরা সবাই মিলে অনেক রাত এখানে কাটিয়েছে। আনন্দণ্ডফুর্তি করেছে। আজ কেউ কাছে আসছে না। কাচারি ঘরের চালার ওপরে বিশাল ছাতিম গাছ। ছাতিম ফুলের সুঘ্রাণ সবাইকে মোহিত করে। তোজামও এই ঘ্রাণ পছন্দ করে। আজ আর এই ঘ্রাণ তোজামের নাকে আসছে না। এমনকি পাশের জঙ্গল থেকে তীব্র আওয়াজে শিয়ালের ডাকও তোজামের কানে আসছে না। বারবারই তোজামের ভেতরটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। তোজাম চুরি করার জন্য মোল্লাবাড়িতে যায়নি। কিন্তু এই গভীর রাতে তোজাম মোল্লাবাড়ির পেছনের কলপাড়ে কেন গিয়েছিল, সাহস করে সেটাও বলতে পারছে না। বলতে না পারার জন্যই তোজামকে চোর নামক অপবাদটি মেনে নিতে হচ্ছে। ভীষণ এক অস্থিরতার মধ্যে রাত কাটে তোজামের।

পরের দিন বেলা ১১টার দিকে পুরো গ্রামের লোকজনের উপস্থিতিতে দরবার শুরু হয়। দরবারে তোজামকে চোর হিসেবে সাজা প্রদান করা হয়। পুরো গ্রামের লোকজনের সামনে কান ধরে ২০ বার ওঠাণ্ডবসা করানো হয় আর মাতব্বর মশাই জুতা দিয়ে ২০টি পিটন দেন। তোজাম এই গ্রামেরই কলেজপড়ুয়া ছেলে। পারিবারিক অবস্থা খারাপ। মোল্লাবাড়ির লোকজনের কাছে তোজামদের পরিবার অনেক তুচ্ছ। তাই চুরির কোনো প্রমাণ ছাড়াই তোজামকে শাস্তি পেতে হলো। গ্রামের লোকজনও মোল্লাবাড়ির লোকজনের পক্ষে। তেলের মাথায় সবাই তেল ঢালে। জোর করেই তোজামকে চোর বানানো হলো।

অশিক্ষিত পরিবারের কলেজপড়ুয়া ছেলে তোজাম। পুরো গ্রামের লোকের সামনে এমন মিথ্যা অপবাদে অপমানিত হয়ে সেই দিনই গ্রাম ছেড়েছে তোজাম। গরিব ঘরের ছেলে হলেও এই গ্রামের অনেক ধনাঢ্য পরিবারের লোকজনের চেয়ে তোজামের আত্মসম্মানবোধ অনেক বেশি। তোজাম মনে করে, এই সম্মানবোধই তার জীবনের একমাত্র সম্বল। অথচ এমন একটি মিথ্যা ঘটনায় তোজামের সেই সম্বলটুকু শেষ হয়ে গেল।

৪৫ বছর আগে তোজাম গ্রাম ছেড়েছে। তখন সে ছিল টগবগে যুবক। আজ তোজাম চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেছে। ঢাকায় একটা কোম্পানিতে চাকরি করত। মিথ্যা অপবাদ নিয়ে গ্রাম থেকে চলে আসার পর আর কখনো তার নিজ গ্রাম চোখে দেখেনি তোজাম সরকার। এমনকি গ্রামের কোনো লোকজনের সঙ্গেও তার দেখা হয়নি। গ্রামের এক বন্ধু একবার কীভাবে কার কাছে তোজামের ঠিকানা নিয়ে তোজামকে চিঠি লিখেছিল। ক্ষোভে, ঘৃণায় তোজাম সেই চিঠির কোনো উত্তর দেয়নি। তোজামের বউ আর সন্তান গ্রামের কথা জানতে চাইলে অনেক দিন তাদের কাছে মিথ্যা কথা বলেছে। সত্য কথাটি নিজের বউ আর সন্তানের কাছেও বলতে পারেনি। বললে তারা হয়তো বিশ্বাস নাও করতে পারে। এসব চিন্তা করেই নিজের ভেতর আটকে রেখেছে কথাটি।

সড়ক দুর্ঘটনায় তোজাম সরকারের বাম পা ভেঙে যাওয়ায় প্রায় এক মাস হলো পঙ্গু হাসপাতালের ভর্তি আছে। আরো অনেক দিন থাকতে হবে। এক দিন তোজাম সরকার খেয়াল করে, তার বেডের কয়েক বেড পরেই এক রোগীর বেডে বয়স্ক এক নারী বসে আছে। রোগীটি নতুন। আজই ভর্তি হয়েছে। তাকে দেখার পরই তোজামের বুকের ভেতর কেমন ধুক করে উঠল। মোটা মতন নারীর সামনের দিকটায় সাদাকালো চুলের মিশ্রণ। তোজাম দেখেই চিনে ফেলেছে, এটা মোল্লা সাহেবের মেয়ে মালতী। তোজামের ইচ্ছা করল বেড থেকে নেমে এখান থেকে পালিয়ে যায়। কিন্তু তার পা অচল, বেড থেকে নামার অবস্থা নেই। অগত্যা নারীর দিক থেকে নজর ফিরিয়ে নেয় অন্য দিকে। এভাবে কতক্ষণ থাকা যায়। নারীটি সারা দিন হাসপাতালেই ছিল। অনিচ্ছাকৃতভাবেই তোজাম অনেকবার ওই দিকে তাকিয়েছে। ভীষণ এক ঘৃণায় তার দিকে তাকাতে ইচ্ছা করছে না। তবু আড় চোখে কয়েকবার তাকিয়েছে, নারীটি সেখানে আছে, নাকি চলে গেছে এটা দেখার জন্য। একটা রুমের ভেতর অনেক লোকের মধ্যে নিজেকে কতক্ষণ আড়াল করে রাখা যায়। তোজাম তবু চেষ্টা করে আড়ালে থাকার। অন্য দিকে কাত হয়ে শুয়ে থাকে।

প্রায় ১৫ দিন হয় ওই নারী প্রতিদিন সকাল থেকে বেশ রাত পর্যন্ত হাসপাতালের এই রুমে থাকে। তোজাম জানতে পেরেছে, নারীর স্বামীর পা ভাঙার কারণে এখানে ভর্তি হয়েছে। সেরে ওঠা পর্যন্ত এখানে থাকবে। তাহলে এটাও নিশ্চিত যে, নারীটি মাঝে মাঝেই এখানে আসবে। যে কারণে ৪৫ বছর গ্রামে যায়নি তোজাম, সেই মালতীর সঙ্গে এভাবে দেখা হবে তোজামের মাথায় ঢোকে না। ওই নারী যদি তোজামকে দেখে ফেলে, তাহলে কি চিনতে পারবে তাকে? তোজামের মুখ ভরা দাঁড়ি। নাও চিনতে পারে। আর চিনলেই কি কাছে আসবে বা কথা বলবে? না তোজাম এসব ভাবতে চায় না। নারীটির চোখে চোখ পড়ুক এটা তোজাম একবারেই চায় না। পাশ ফিরে বালিশে মুখ চেপে নিঃশব্দে কান্না করে।

নিজেকে আর আড়াল করে রাখতে পারল না তোজাম। হঠাৎ এক দিন ওই নারীর চোখে চোখ পড়ে যায়। মুহূর্তেই চোখ ফিরিয়ে নেয় তোজাম। মালতী হয়তো ঠিক চিনতে পারেনি। ৪৫ বছর আগের কথা, তা ছাড়া মুখভরা লম্বা দাঁড়িতে না চেনারই কথা। মালতীর সেরকম কোনো পরিবর্তন হয়নি। বয়সের ছাপ পড়েছে শুধু। তোজাম আড় চোখে অনেকবার তাকিয়ে দেখেছে, মালতী তোজামের দিকে তাকিয়ে আছে।

সন্ধ্যার একটু পর, তোজামের চোখে ভাত ঘুম। এক নারী কণ্ঠের ডাক শুনতে পায় তোজাম। পাশ ফিরে চোখ মেলেই দেখে মালতী তার পাশে বসা। কোনো কথা নেই কারো মুখে। দীর্ঘ সময় চুপচাপ দুজন। এক হাতে তোজামের ডান হাত চেপে ধরে অন্য হাতে চোখ মুছতে মুছতে মালতী বলে, আমার করার কিছু ছিল না, তোজাম আমায় ক্ষমা করে দাও। তোজাম-মালতী কেউ আর কোনো কথা বলতে পারে না। তোজামের বুকে মাথা গুজে দিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে দেয় মালতী।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close