রুখসানা কাজল

  ০২ ডিসেম্বর, ২০২২

ধারাবাহিক উপন্যাস- ৩

বায়োস্কোপ

এ মুহূর্তে ইনুকে থামতে বলার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পায় না সে। বরং থমকে থাকা আধা জড় শরীরটাকে নাড়িয়ে দুহাত বাড়িয়ে হুইলচেয়ারটাকে টেনে কাছে আনতে চায়। কিন্তু দেখে, হাতের নাগালের বাইরে পুরোনো আলনার কাছে চলে গেছে চেয়ার। হয়তো খেলতে খেলতে গুস্তাভ কখন ঠেলে নিয়ে গেছে ওখানে। পূরবী বুঝতে পারে, হাজারবার চেষ্টা-কসরত করলেও চেয়ারটাকেও হাতের নাগালে আনতে পারবে না। এবার তাই ইচ্ছে করেই ও ফ্লোরে শুয়ে পড়ে। এ ছাড়া আর উপায় কী! অচল, অশক্ত খোঁড়া পায়ের জ্যান্ত পূরবী। হুইলচেয়ারের কাছে পৌঁছাতে গেলে ওকে তো গড়িয়েই যেতে হবে।

ফ্লোরে শুয়ে পড়ার আগে পূরবী চেঁচিয়ে জানিয়ে দেয়, ‘গুস্তাভ! গুস্তাভ! এই যে আমি! এই তো এখুনি আসছি বাবা।’

খাওয়ার টেবিলের একটি পায়ের সঙ্গে ওড়না দিয়ে বাঁধা গুস্তাভ। পূরবীর ডাক শুনে ছুটে আসতে চেয়েও পারে না প্রাণীটা। লেজের ওপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। কিন্তু বাঁধন খুলতে পারে না। বসে পড়ে। আবার এগোয়। সর্বশক্তি জড়ো করে পা দিয়ে ওড়না ছেঁড়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে ছোট্ট কুকুরটা। কিছুতেই পারে না। সামনের পা দুটো এগিয়ে দিয়ে ছোটার চেষ্টা করে। গলায় টান পড়ায় তাও পারে না। শেষ পর্যন্ত টেবিলের পায়া ঘুরে ঘুরে কাঁদে। নিরুদ্ধ অভিমানের অসহায় কান্না। বড় মেয়ে গীতির উপহার দেওয়া মল্টিজ মিক্সড আদুরে ছোট্ট কুকুর গুস্তাভের কান্নায় চুঁইয়ে পড়ে অবোধ অভিমানের অস্পষ্ট ধারা।

পূরবীর দীর্ঘ চুল ফ্লোরে ছড়িয়ে পড়েছে। গুস্তাভকে ডাকতে ডাকতেই সে গড়াতে থাকে। দুটো গড়ান দিয়েই বুঝতে পারে, পেরেছে। হ্যাঁ পেরেছে সে। যদিও ব্যথায় কুঁচকে যাচ্ছে কোমরের নিচ। আগুনের মতো ঝলসে উঠছে হাড়গুলো। দুচোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লেও কাঁদে না পূরবী। হুইলচেয়ারের পা ধরে টেনে আনে কাছে। প্রায় অবশ পায়ের নিচে জড়িয়ে গেছে ম্যাক্সি। কাঁপা কাঁপা রুগ্ণ হাত দিয়ে ম্যাক্সি ছাড়িয়ে কোনো মতে উঠে বসে ফ্লোরে। কেমন দম আটকে যাচ্ছে। প্রথমে এক হাত এরপর প্রায় অশক্ত অন্য হাতটি দিয়ে বুক চেপে ধরে শক্ত করে। সামান্য এটুকু পরিশ্রমে বুকের ভেতর হাঁপ ধরে গেছে। হুইলচেয়ারের হাতলের ওপর মাথা ঠেকিয়ে ছোট ছোট নিঃশ্বাস নেয় কিছুক্ষণ। ঘেমে নেয়ে গেছে গলা-পিঠ-বুক। পীড়িত স্তনের নিচে আর বুকের মধ্যভাগ ভিজে সপসপ্? করছে। পূরবী এবার বড় করে কয়েকবার শ্বাস নেয়। পেট ফুলিয়ে নাক-মুখ দিয়ে বাতাস ছাড়ে।

বুকের খনির অস্বচ্ছ খাঁজের ভাঁজে এভাবে কয়েকবার শ্বাস পাঠাতে চেষ্টা করে। তারপর মাথা তুলে কিছুটা স্বাভাবিক নিঃশ্বাস ছেড়ে হাঁপায় পূরবী। ম্যাক্সির নীল রঙের ভেতর শুকনো পদ্মের মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে ওর রুগ্ণ মুখ। ব্যথাও পেয়েছে কম নয়। এবার হুইলচেয়ারের ধাতব পা ধরে আস্তে আস্তে তাতে উঠে বসে। ঘন ঘন শরীর কাঁপছে। ধাতস্থ হতে গা এলিয়ে দেয় চেয়ারে। খানিকক্ষণ সময় নিয়ে রেস্ট করে। তারপর হাতলের বোতাম টিপে ছুটে যায় ডাইনিং রুমের দিকে। পরিশ্রান্ত ক্লান্ত অস্ফুট গোঙানির সুরে সস্নেহে ডাক দেয়, ‘গুস্তাভ! গুস্তাভ! এই তো সোনা বাবা আমার। এই যে দ্যাখ আমি এসে গেছি বাবা।’

এভাবে বন্দি গুস্তাভকে দেখে রাগ হয় পূরবীর। প্রচণ্ড রাগ। ইচ্ছে করে দলনেত্রীর পুরোনো সেই গলায় ইনুকে ডেকে তোলে কাঠগড়ায়। সমালোচনার প্রশ্নে নীতিবিদ্ধ করে ইনুর কাছে জবাবদিহি চায়, ‘কমরেড ইনাম, সংক্ষেপে জবাব দিন, গুস্তাভ কি খুব বড় অপরাধ করে ফেলেছে? কিংবা, বলুন তো দেখি, কি এমন গুরুতর কারণ থাকতে পারে যার জন্য এই এতটুকু একটি ছোট্ট প্রাণীকে এ রকম নিষ্ঠুর নির্মমভাবে মারধর করতে হবে? কমরেড আত্মসমীক্ষার পাঠচক্রে আমরা কি ধৈর্য এবং সহিষ্ণুতার পাঠ গ্রহণ করিনি? হঠাৎ করে ক্ষেপে গিয়ে এমন কিছু করা কি দলীয় নেতা এবং কর্মীদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল না? আপনি কি সেসব পাঠ একেবারেই ভুলে গেছেন।’

কিন্তু গলার ভেতর পুরোনো সেই কণ্ঠকে আর খুঁজে পায় না পূরবী। বহু বছর ধরেই ওর স্বর নেমে গেছে বিড়ম্বিত সুর-তালের লয়ে। তা ছাড়া এসব কথা শুনে পজিটিভ রি-অ্যাক্ট করার তো মন-মানসিকতা অনেক আগেই নিঃশেষ হয়ে গেছে ইনুর। বরং পূরবীকে নিয়ে খানিক সস্তা হাসি-তামাশা করে আবার মজাক মশকরা শুরু করবে! একলা ফ্ল্যাটে একা একা পূরবী আর নিতে পারে না ইনুর করা এই শ্লেষের শ্লেষ্মাযুক্ত ঠাট্টা-মশকরাগুলো। সম্পর্কের দায়বদ্ধতারও তো একটা সীমা থাকে!

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close