আমিনুল ইসলাম হুসাইনী

  ১২ আগস্ট, ২০২২

গল্প

আগুন দরিয়া

রোমেলের মন খারাপ। প্রচণ্ড রকমের মন খারাপ। অবশ্য তাতে কারো কিছু যায় আসে না। তার থেকে সামান্য দূরে ছাতার ভেতর নির্বিঘেœ প্রেম করে যাচ্ছে দুটি ছেলেমেয়ে। রোমেলের মন খারাপের কারণ জানতে তাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ জাগে না। শহরের মানুষগুলোই এমন। একই ছাদের নিচে বসবাস করেও কেউ কারো খোঁজ রাখে না।

বিএম কনটেইনার ডিপোর অদূরের এই সবুজ বনে রোমেল এসেছিল রোদ মরা বিকেলে। না, প্রিয় কোনো মানুষের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করতে নয়, এসেছে বিষণ্নতার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলতে। রোমেল কত করে বলল, ছয় বছর অপেক্ষার পর বাবা হতে যাচ্ছি স্যার। দুটো দিনের জন্য ছুটি দিন। বাড়িতে পুরুষ মানুষ নেই। হালিমার যদি কিছু একটা হয়ে যায়!

কিন্তু না, রোমেলের এমন আকুতিও সুপারভাইজার হামিদ আলীর মন গলাতে পারেনি। ছুটি তো দেয়ইনি, উল্টো রোমেলের হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করেছে। বলে কি না, ছেলে গেলে ছেলে পাবে, কিন্তু চাকরি চলে গেলে, সে চাকরি আর ফিরে পাবে না।

রোমেল সীতাকুণ্ড ‘বিএম কনটেইনার ডিপোতে চাকরি করে বছর চারেক হবে। তার লাইনের সুপারভাইজার হামিদ আলী। খুবই বদমেজাজি মানুষ। তার কথার অবাধ্য হলেই চাকরি খেয়ে নেয়। মানুষের পেটে লাথি মেরে এই অমানুষগুলো কী এমন মজা পায়?

বাতাসের তিরিতিরে ঢেউ, ঢেউয়ের গায়ে বিছিয়ে দেওয়া বনফুলের গন্ধে কেটে যায় পুরো একটা বিকেল। কখন যে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার আবছায়া নেমে এসেছে, রোমেল তা বুঝতেই পারেনি। রোমেলের মতো আরো যারা এখানে সময় কাটাতে এসেছিল, তারা চলে গেছে বেশ আগেই। শুধু রোমেলই একা বসে থাকে, বিষণ্নতার লোবান মেখে। রোমেলের সংবিৎ ফিরে মাগরিবের আজানে। ঘড়ির কাঁটায় তখন ছয়টা পঁচিশ। রোমেল বিমর্ষ চেহারায় ডিপোর দিকে পা বাড়ায়। সাতটা থেকে তার ডিউটি। ডিউটিতে না গেলে চাকরি চলে যাবে। এই বাজারে চাকরি চলে যাওয়া মানে ভয়াবহ কাণ্ড।

রাত ন’টায় রোমেলের মোবাইলে কল আসে। রিসিভ করতেই হালিমার বেচাইন কণ্ঠ, কী হয়েছে তোমার?

কই কিছু হয়নি তো!

তাহলে ফোন ধরছো না কেন? কখন থেকে কল করে যাচ্ছি, রিসিভ করার নামণ্ডগন্ধ নেই।

রোমেল এতটাই বিষণ্ন হয়ে পড়েছিল যে, হালিমার দেওয়া সাতটা কলের একটাও শুনতে পায়নি। হালিমা আবার জিজ্ঞেস করে, তোমার কী মন খারাপ?

না, মন খারাপ না।

তাহলে গলাটা এমন ভারী ভারী শোনাচ্ছে কেন?

গলাটা বসে গেছে।

এজন্যই আমি আসতে চাইনি। নিশ্চয় ফ্রিজে ঠাণ্ডা পানি খেয়ে খেয়ে সর্দি বাঁধিয়েছো! ডাক্তার দেখিয়েছো? কী ওষুধ দিলেন?

রোমেল হাসে। মেঘ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা চাঁদের মতো ফকফকা হয়ে ওঠে তার মুখপ্রচ্ছদ। বলে, আরে অত উতলা হওয়ার মতো কিছু হয়নি। নাপা খেয়ে নিয়েছি। সেরে যাবে ইনশাআল্লাহ।

আমি চলে আসব?

মাথা খারাপ! ডাক্তার কি বলেছে মনে নেই?

বিয়ের ছয় বছর পর হালিমা মা হতে যাচ্ছে। এই ছয়টি বছর হালিমাকে কত কথা যে শুনতে হয়েছে! রোমেলের মায়ের সঙ্গে পাড়াপড়শিরাও নানান কথা শোনাত। হালিমা তাদের কথা শুনে নির্জনে চোখের পানি ফেলত আর আল্লাহর কাছে মৃত্যু কামনা করত। রোমেলকে এক দিন বলেও ছিল, তুমি বরং আরেকটা বিয়ে করো। বাবা ডাক শোনার স্বপ্নকে কবর দিয়ো না।

হালিমার কথা শুনে পদ্মা ভাঙনের মতো রোমেলের বুক ভাঙে। বলে, তুমি তো জানো না তুমি কে? তুমি হলে আমার জীবনসূর্য। তুমি ছাড়া আমার পৃথিবী অন্ধকার।

রোমেলকে ছেড়ে হালিমা বাবার বাড়ি আসতে চায়নি। রোমেলই জোর করে পাঠিয়েছে। চট্টগ্রামে তার আত্মীয়স্বজন কেউ নেই। হালিমার দেখাশোনা কে করবে? তা ছাড়া মেয়েরা পোয়াতি হলে সাধারণত বাবার বাড়িতেই থাকে। এটাই রীতি। রোমেল হালিমাকে জিজ্ঞেস করে, বাবু আমার কথা জিজ্ঞেস করে?

হালিমার মুখে ঠোঁটটেপা হাসি। বলে, করে তো।

কী বলে?

আব্বু খুব পচা। আমাকে আম্মুকে রেখে চট্টগ্রামে পড়ে আছে। শোনো আম্মু, আব্বুকে বলে দেবে তার সঙ্গে আমার আড়ি, আড়ি, আড়ি।

পেটে থেকেই এত অভিমান?

হালিমা হাসে। বলে, তোমার ছেলে না? অভিমান তো করবেই। আমার সঙ্গে কি রকম অভিমান করতে মনে আছে?

রোমেলের মনে পড়ে, একবার নবম শ্রেণির ছাত্র নাইমের সঙ্গে হালিমা হেসে হেসে কথা বলায় রোমেল কি তুলকালাম কাণ্ডটাই না করেছিল! সেদিন রোমেলের অভিমানী চোখ দুটো হয়েছিল রক্ত কমল। ইচ্ছে করছিল তখনই মরে গিয়ে হালিমাকে সুখী করে দিতে।

অন্য কোনো ছেলের সঙ্গে হালিমা হেসে হেসে কথা বললে যে রোমেলের মাথা খারাপ হয়ে যায়, সে কথা কি হালিমা জানে না? জেনেও কেন এমন করে?

বন্ধুরা এমন প্রশ্ন করলে হালিমা জবাব দেয়, রোমেলকে রাগানোয় যে সুখ; তা অন্যকিছুতে নেই। হালিমার সাফ কথা, লজ্জা যদি হয় নারীর ভূষণ; জেদ তবে পুরুষের অহংকার। যে পুরুষের জেদ নেই, সে পুরুষ ঢোঁড়া সাপ। হালিমা কি ঢোঁড়া সাপের সঙ্গে ঘর বাঁধবে?

এজন্যই রোমেলকে ঝালিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু সেদিনের বাড়াবাড়িটা একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল। নবম শ্রেণিপড়ুয়া একটা জুনিয়র ছেলের সঙ্গে এভাবে হেসে হেসে কথা বলা আর রোমেলের গলায় ছুড়ি চালানো তো একই কথা। সে দৃশ্য দেখার পর রোমেল নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারেনি। ছুটে এসে নাইমের থুতনিতে বসিয়ে দেয় এক ঘুষি। তারপর জল অনেক দূর গড়ায়।

স্কুলের প্রধান শিক্ষক রোমেলকে আচ্ছা মতো পেটান। শুধু কি তাই? ক্লাসভর্তি ছেলেমেয়েদের সামনে কান ধরিয়ে একশোবার ওঠবস করিয়েছেন। রোমেলের এই অপমানে হালিমার হৃদয়ও জ¦লেপুড়ে অঙ্গার হয়। স্কুল থেকে রোমেল সেদিন বাড়ি ফেরেনি। এমন অপমানের জ¦ালা নিয়ে বাড়ি ফেরা যায়?

রোমেলকে খোঁজার জন্য হালিমা এদিক সেদিক ছোটেনি। হারামিটা যে এখন অনিল বাবুর পুকুর ঘাটে বসা, হালিমার তা বেশ ভালোভাবেই জানা আছে।

কার্তিকের মাঝবয়সি রাত। হালকা কুয়াশায় কাছের গাছপালা ঢেকে গেলেও দূরের চাঁদটা দুধেল, ফকফকা। শুক্লা পঞ্চমী গলে গলে পড়ছে হালিমার কালো চুলের ঢেউয়ে। হালিমাকে দূর থেকে দেখেই রোমেল গলা ছাড়ে-

আমি ডুবতে রাজি আছি

আমি ডুবতে রাজি আছি।

তোমার খোলা হাওয়া

লাগিয়ে পালে...

রোমেল মোটেও রবীন্দ্রভক্ত নয়। রবীন্দ্রনাথের ওপর সে ভীষণ বিরক্ত। রোমেলের মতে, রবীন্দ্রনাথ নারীদের নিয়ে যত কবিতা লিখেছে, তার সিকিভাগও পুরুষদের নিয়ে লেখেনি। অন্যদিকে হালিমা রবীন্দ্রনাথে আকণ্ঠ। রবীন্দ্রনাথের কাছে তার সব জিজ্ঞাসার উত্তর মজুদ। রবীন্দ্রভক্ত না হয়েও রোমেল রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার এটাই যে মূল কারণ, হালিমার বুঝতে বাকি থাকে না।

সেদিন অনিল বাবুর পুকুরঘাটে রোমেলকে যে-ই বিষণ্ন মনে বসে থাকতে দেখেছে, সেই তার মন খারাপের কারণ জানতে চেয়েছে। সহানুভূতি দেখিয়েছে।

আর আজ তার পাশের মানুষটাও তার দিকে ফিরে তাকাচ্ছে না। অথচ আজ তার প্রচণ্ড রকমের মন খারাপ। বুকে যেন একটা জগদ্দল পাথর চাপা পড়ে আছে। চেহারাটা হয়ে আছে ফসলবিহীন মাঠের মতো ধূসর-ঝাপসা!

কী হলো? কথা বলছো না কেন? হ্যালো..., হ্যালো শুনতে পাচ্ছো?

রোমেলের সংবিৎ ফিরে। হালিমার প্রশ্নের জবাব দেয়, হুম, শুনতে পাচ্ছি।

আচ্ছা ফোন রাখছি। আর হ্যাঁ, বাসায় গিয়ে আদাজলে গড়গড়া করবে। মনে থাকবে তো?

রোমেল মুচকি হেসে বলে, থাকবে বাবা; থাকবে।

আল্লাহ হাফেজ।

আল্লাহ হাফেজ।

রাত এগারোটা সাত মিনিটের সময় হালিমার মোবাইলে কল আসে। রিসিভ

করতেই রোমেলের কাঁপা স্বর, ইমুটা একটু চালু করো তো।

হালিমা প্রশ্ন না করে ইমুতে ঢোকে। ইমুতে ঢোকার একটু পরেই রোমেলের ভিডিও কল আসে। হালিমা কল রিসিভ করে দেখে আগুনের লেলিহান। যতদূর দেখা যায়, কেবল আগুন আর আগুন। এ যে এক আগুন দরিয়া। সেই দরিয়ায় কূল পায় না রোমেল। রোমেলের ঝলসানো চেহারা দেখে হালিমার কলজে শুকিয়ে যায়। মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোয় না। বহু কষ্টে রোমেল বলে, খুব পিপাসা পেয়েছে। এক ফোঁটা পানি যদি পেতাম! আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো। তোমাদের আল্লাহর কাছে রেখে গেলাম। হঠাৎ বিকট একটা শব্দ, মুহূর্তেই সবকিছু অন্ধকার।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close