নাজমা মমতাজ

  ২৭ মে, ২০২২

মৈমনসিংহ গীতিকার নারী ও প্রকৃতি

‘নাহি আমার মাতা পিতা গর্ভ সুদর ভাই।/সুতের শেওলা অইয়া ভাইস্যা বেড়াই॥’ (মহুয়া)। ‘ডাল যে নোয়াইয়া ধরে জয়ানন্দ সাথী।/তুলিল মালতী ফুল কন্যা চন্দ্রাবতী॥’ (চন্দ্রাবতী)। মমনসিংহ গীতিকার নারীকে এভাবেই আমরা প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যেতে দেখি।

সাহিত্যে নারীর অবস্থান অতি প্রাচীনকাল থেকে। চর্যাপদের প্রায় সবগুলো পদেই নারীর উপস্থিতি দেখা যায়। এখানে নারী নিরাত্মা দেবীর রূপকে এলেও তৎকালীন সমাজব্যবস্থার প্রতিফলন দেখা যায়- ‘নগর বাহিরে ডোম্বী তোহোরী কুড়িআ।’

মধ্যযুগের সাহিত্য ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’। কৃষ্ণের নামে কাব্যের নাম হলেও পুরো কাব্যজুড়ে রাধার সরব উপস্থিতি- ‘কে না বাঁশি বাএ বড়ায়ি কালিনী নঈকুলে।’ বৈষ্ণব কবিতা তো রাধার প্রেমে টলমল- ‘সই কে বলে পিরীতি ভাল/হাসিতে হাসিতে পিরীতি করিয়া/কান্দিতে জনম গেল।’

মধ্যযুগের ‘অন্নদা মঙ্গলে’ আমরা দেখি, দেবী অন্নদার পা রাখা সেঁওতি সোনার হয়ে গেছে। আর তা দেখে ঈশ্বরী পাটনী বর চাইছে দেবীর কাছে- ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’।

‘মনসা মঙ্গলে’ চাঁদ সদাগরের পুত্রবধূ বেহুলা নেচে গেয়ে দেবতাদের সন্তুষ্ট করে ফিরিয়ে এনেছে স্বামী লক্ষ্মীন্দরের জীবনসহ চাঁদের সাত পুত্র আর সপ্তডিঙা মধুকর। কালীদাস ‘মেঘদূতে’ নারীর পাশাপাশি নদী, পাহাড়, পর্বত- এক কথায় সমস্ত প্রকৃতিকে ব্যবহার করেছেন। মেঘ যাচ্ছে প্রিয়ার কাছে দূত হয়ে- ‘যাও ভাই একবার, মুছাতে আঁখি তার’।

পরবর্তীকালে আমরা রবীন্দ্রনাথকে স্বপ্নালোকের নারীর কথা বলতে শুনি- ‘দূরে বহুদূরে উজ্জয়িনীপুরে/খুঁজিতে গেছিনু কবে শিপ্রা নদী তীরে/মোর পূর্ব জনমের প্রথমা প্রিয়ারে।’

২.

কাজী নজরুল জয়গান গেয়েছেন নারীর। বিশ্বের সব মহান সৃষ্টির পেছনে নারীর অবদানের কথা বলেছেন। বহ্নিশিখার মতো জ্বলে উঠতে বলেছেন- ‘জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা’।

জসিমউদ্দীনের নক্সী কাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট, শরৎচন্দ্রের বড়দি, মেজদি প্রভৃতি রচনার কেন্দ্রীয় চরিত্র নারী। কিন্তু মৈমনসিংহ গীতিকার নারী চরিত্রগুলো অতুলনীয়। আর এসব নারী চরিত্র অঙ্কিত হয়েছে প্রকৃতির পটভূমিতে। মহুয়া পালায় আমরা দেখি, নদের চাঁদ ডুবে মরতে চেয়েছে মহুয়ার প্রেমের গহিন গাঙে- ‘কোথায় পাব কলসী কইন্যা কোথায় পাব দড়ি।/তুমি হও গহীন গাঙ আমি ডুব্যা মরি॥’

তারা প্রকৃতির কোলেই ঘর বেঁধেছিল। কিন্তু সুখে থাকতে পারেনি। হুমরা বেদের আদেশে নদের চাঁদকে না মেরে নিজেই আত্মহত্যা করে মহুয়া। চাঁদকে মারে বেদের দল। আবার প্রকৃতির কোলেই শেষ আশ্রয় হয় চাঁদণ্ডমহুয়ার।

মলুয়া আরেক প্রকৃতি কন্যা। জলের ঘাটে কুড়া শিকারি চাঁদ বিনোদের সঙ্গে প্রেম হয় তার। বিয়েও হয়। বিয়ের পরে জলের ঘাটে সুন্দরী মলুয়াকে দেখে দুশমন কাজী। তার চক্রান্তে মহুয়াকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয় দেওয়ানবাড়িতে। একসময় আব্রা বিয়ে করে বিনোদ। মলুয়া নানান কৌশলে সতীত্ব রক্ষা করে ফিরে এলেও সমাজের ভয়ে বিনোদ তাকে গ্রহণ করতে পারে না। এমনকি সাপে কাটা বিনোদকে ওঝার সাহায্যে ভালো করলেও মলুয়াকে গ্রহণ করতে পারে না বিনোদ। শেষ পর্যন্ত জলে ডুবে আত্মহত্যা করে মলুয়া-

‘পূবেতে গর্জিল দেয়া ছুটলো বিষম বাও।/কইবা গেল সোনার কইন্যা মন পবনের নাও॥’

চন্দ্রাবতী কবি হয়েও লোককাহিনির নায়িকা। বাল্যসঙ্গী জয়ানন্দের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয় চন্দ্রাবতীর। এদিকে জয়ানন্দ এক মুসলমান মেয়ের প্রেমে পড়ে। এবং নিজে মুসলমান হয়ে তাকে বিয়েও করে ফেলে। এ দুঃসংবাদে ভেঙে পড়ে চন্দ্রাবতী- ‘জলে গেল চন্দ্রাবতী, চক্ষে বহে পানি।/হেনকালে দেখে নদী ধরিছে উজানী॥’

অনুতপ্ত জয়ানন্দ ফিরে আসে একসময়। কিন্তু তাকে ক্ষমা করে না চন্দ্রা। হতাশ জয়ানন্দ ফুলেশ্বরীর জলে ডুবে আত্মহত্যা করে। নির্বাক চন্দ্রাবতী নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে হতাশ চোখে জয়ানন্দের লাশ দেখে।

মৈমনসিংহ গীতিকার আরেকটি পালার কেন্দ্রীয় চরিত্র কমলা- ‘জলেতে সুন্দরী কইন্যা, ফুটা পদ্মফুল।/কন্যারে দেখিয়া কারকুন হইল আকুল॥’

কমলার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত কারকুন রঘুপরের জমিদারকে দিয়ে প্রতিশোধ নেয়। কমলার বাপ আর ভাইকে বন্দি করে জমিদার নানা উসিলায়। বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে রঘুপুরেরই জমিদার পুত্র প্রদীপের সঙ্গে পরিচয় হয় কমলার। তার রূপ দেখে মুগ্ধ কুমার। কাহিনি শেষে কমলা প্রদীপের মিলন হয়। আর কারকুনের হয় মৃত্যুদণ্ড।

৩.

কারকুনের মতো আরেক দুষ্ট লোক ‘দেওয়ান ভাবনা’। পিতৃহীন সোনাইর রূপ তাকে আকৃষ্ট করে। মাধবের সঙ্গে সোনাইর বিয়ে হলেও দেওয়ান ভাবনার চক্রান্তে আর সংসার করা হয় না। স্বামী-শ্বশুরকে ধরে নিয়ে গেলে ভাবনার কাছে ধরা দিতে বাধ্য হয় সোনাই। কিন্তু সতীত্ব হারানোর আগেই বিষ খায় সে- ‘আসমান কালা, জমিন রে কালা, কালা নিশা যামিনী।/বিষের কটরা খুলে কইন্যা জনম দুখিনী॥’

মুসলমান নবাবের কাছ থেকে বাঁচাতে কাজের ছেলে মদনের কাছে ‘রূপবতী’ পালার রূপবতীকে বিয়ে দেয় জমিদার বাবা। মেয়ে জামাইকে পাঠিয়ে দেয় বনবাসে- ‘গাও গেরাম নাই কাছে অলচ তলচ পানি।/বনে ডাকে বাঘ ভালুক জলে কুম্ভরিনী॥’

একসময় তারা ফিরে আসে। বাবার সহায় সম্পদের মালিক হয় রূপবতী। কংকের প্রেমে অন্ধ লীলা ব্রাহ্মণ গর্গের কন্যা। সমাজ এবং গর্গের ব্যবহারে কষ্ট পেয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যায় কংক। প্রেমিক কংকের বিরহে অঝোরে কাঁদে লীলা- ‘পূবেতে উদয়রে ভানু পশ্চিমে অস্ত যাও।/ব্রহ্মা- ঘুরিয়া কি গো কংকের দেখা পাও॥’ কংকের বিরহে শেষ পর্যন্ত মারা যায় ‘কংক ও লীলা’ পালার লীলা।

কাজল রেখার স্বামী সূচ রাজাকে নানান কৌশলে নিজের করে নেয় কংকন দাসী-

‘মাও নাই বাপও নাই গর্ভ সোদর ভাই।/আসমানের মেঘ যেমন ভাইস্যা বেড়াই॥’

‘কাজল রেখা’ রূপ কথা হলেও প্রকৃতির অনুষঙ্গে রচিত এ পালাটিও। এবং শেষ পর্যন্ত মিলনান্তক।

‘দেওয়ানা মদিনা’ পালার কেন্দ্রীয় চরিত্র গেরস্ত কন্যা মদিনা। যার সঙ্গে ঘটনাক্রমে বিয়ে হয়েছে বানিয়াচংয়ের দেওয়ান পুত্র দুলালের। কিন্তু সুখ সয়না মদিনার। বড় ভাই আলাল এসে নিয়ে যায় দুলালকে। পুত্র সূরুজকে নিয়ে শুরু হয় তার দুঃখের জীবন। কাঁদতে কাঁদতে মারা যায় মদিনা। মৃত্যুর আগে তার বিলাপ আমরা শুনি- ‘ভরা ক্ষেতের মধ্যে আমার কে দিল আগুনি।’ প্রকৃতির সঙ্গে এভাবেই জীবনে মরণে মিশে গেছে মৈমনসিংহ গীতিকার নারী চরিত্রগুলো।

মৈমনসিংহ গীতিকার নারী চরিত্রগুলোর ‘অরণ্য পুষ্পের মতো পবিত্র’ প্রেমের কথা বলতে গিয়ে ড. আশরাফ সিদ্দিকী তার ‘লোকসাহিত্য’ গ্রন্থে বলেন- ‘নাগরিক সভ্যতার কোনো ধূলি বালি এই পবিত্রতা নষ্ট করতে পারে না। সেখানে বিবাহের চেয়ে বড় হলো প্রেম।’ গীতিকার নারীদের এ প্রেমকে আরো সাহসী করেছে প্রকৃতি। পূর্ববাংলার দুরন্ত প্রকৃতি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close