কাঞ্চন বিধু

  ১৩ মে, ২০২২

রবীন্দ্রনাথের চোখে ২৫ বৈশাখ

রূপাঞ্জন গোস্বামী, তখন মাত্রই পঁচিশ বছরের যুবক, কিন্তু এই তারুণ্যেও তিনি সংকুচিত নিজের জন্মদিন সম্পর্কে।

১৮৮৬ সালের ২৫ বৈশাখ শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে লিখছেন, ‘আজ আমার জন্মদিন। পঁচিশে বৈশাখণ্ডপঁচিশ বৎসর পূর্বে এই পঁচিশে বৈশাখে আমি ধরণিকে বাধিত করতে অবতীর্ণ হয়েছিলুম। জীবনে এখন আরো অনেকগুলো পঁচিশে বৈশাখ আসে এই আশীর্বাদ করুন। জীবন অতি সুখের।’

এইটুকু পড়ে পাঠকের মনে হতে পারে, রবীন্দ্রনাথ নিজের জন্মদিন নিয়ে বেশ সচেতন ছিলেন। কিন্তু এই ধারণা ভেঙে যাবে যদুনাথ সরকারকে লেখা অন্য একটি চিঠিতে। কবি লিখেছিলেন, ‘এই সমস্ত বাহ্য আড়ম্বরের উদ্যোগ আয়োজনে আমি যে কিরূপ সঙ্কোচ অনুভব করিতেছি, তাহা অন্তর্যামীই জানেন।’

রবীন্দ্রনাথ জীবদ্দশায় জন্মদিন উদ্‌যাপন নিয়ে একেবারেই উৎসাহী ছিলেন না। তাই ২৬ বছর বয়সে তার প্রথম জন্মদিন উদ্‌যাপিত হয়। তার পরও কবির জন্মদিন আরো ২২ বছর ঠাকুরবাড়ির অন্দর মহলের আড়ালে ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে কবি তার বিশ্বজোড়া গুণগ্রাহীদের আকুল আবেদন ফেরাতে পারেননি। ভক্তদের কাছে হার মেনেছেন।

কবির জীবদ্দশায় রবীন্দ্রজয়ন্তী প্রথম উদ্?যাপিত হয় ১৮৮৭ সালে, কবির তখন ২৬ বছর বয়স। কবির ভাগনি সরলা দেবীর আত্মজীবনী ‘জীবনের ঝরাপাতা’ বইটিতে লিখেছেন, ‘রবিমামার প্রথম জন্মদিন উৎসব আমি করাই। তখন মেজোমামা ও নতুন মামার সঙ্গে তিনি ৮৯ নম্বর পার্ক স্ট্রিটে থাকেন। অতি ভোরে উল্টোডিঙির কাশিয়াবাগান বাড়ি থেকে পার্ক স্ট্রিটে নিঃশব্দে তার বিছানার কাছে গিয়ে বাড়ির বকুল ফুলের নিজের হাতে গাঁথা মালা বাজার থেকে আনানো বেলফুলের মালার সঙ্গে অন্যান্য ফুল ও একজোড়া ধুতি-চাদর তার পায়ের কাছে রেখে প্রণাম করে তাকে জাগিয়ে দিলুম। তখন আর সবাই জেগে উঠলেন, পাশেই নতুন মামার ঘর। রবির জন্মদিন বলে সাড়া পড়ে গেল। সেই বছর থেকে পরিজনদের মধ্যে তার জন্মদিনের উৎসব আরম্ভ হলো।’

কিন্তু প্রকৃত অর্থে ও সর্বজনীনভাবে প্রথম রবীন্দ্রজয়ন্তী পালিত হয় ১৯১০ সালে, শান্তিনিকেতনে। কবি সেবার উনপঞ্চাশ থেকে পঞ্চাশে পা দিয়েছেন। বিপুল উৎসাহে আশ্রমিকরা রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করেছিলেন ‘আত্মীয়দের উৎসব’ নামে।

রবীন্দ্রজয়ন্তী সাড়ম্বরে প্রথমবার পালিত হয়েছিল ১৯১২ সালে। সে বছর ৫০ পূর্ণ করে ৫১-তে পা দিয়েছেন কবি। রবীন্দ্রজয়ন্তীকে সফল করতে শান্তিনিকেতনের আশ্রমিকদের সঙ্গে প্রশান্ত মহলানবিশের নেতৃত্বে যোগ দিয়েছিলেন কলকাতা থেকে বেশ কিছু গুণিজন। তাদের মধ্যে ছিলেন সত্যেন দত্ত, সুকুমার রায়, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়।

বেদণ্ডউপনিষদ পাঠ করে এবং মালা পরিয়ে কবিকে বরণ করা হয়েছিল। কবির মনের কথা সেদিন অনুচ্চারিত থেকে গেলেও, তা প্রকাশ পেয়েছিল নেপালচন্দ্র রায়ের ভাষণে। নেপালচন্দ্র বলেছিলেন, ‘তোমরা সকলেই গুরুদেবকে ভক্তি কর, কিন্তু তাকে কখনো যেন ঈশ্বরের স্থানে বসিও না।’ সত্যি কবি ঈশ্বর হতে চাননি, তিনি তাই লিখেছিলেন, ‘যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন/সেইখানে যে চরণ তোমার রাজে/সবার পিছে, সবার নীচে, সব-হারাদের মাঝে।’

তিনি সবহারাদের মাঝেই ঈশ্বরকে খুঁজেছিলেন, থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মানুষ তাকে আপন খেয়ালে চলতে দেননি। কারণ তিনি সবার। তিনি যে বিশ্বকবি।

১৯৩১ সাল, মহাসমারোহে উদ্‌যাপিত হয়েছিল কবির ৭০তম জন্মজয়ন্তী, যা আজও বাংলার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। রবীন্দ্রজয়ন্তীর মুখ্য উদ্যোক্তা ছিলেন অমল হোম। উদ্‌যাপন কমিটিতে ছিল চাঁদের হাট।

কমিটির সভাপতি ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু। কমিটিতে সদস্য হিসেবে ছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সুভাষচন্দ্র বসু, প্রশান্ত মহলানবিশ, সি.ভি. রমণ, রাজশেখর বসু, নজরুল ইসলাম, ইন্দিরা দেবী, কালিদাস নাগ, সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ ব্যক্তি।

কবির সংবর্ধনা উপলক্ষে দুটি বই প্রকাশিত হয়েছিল, বাংলা আর ইংরেজিতে। ইংরেজি বইটির নামকরণ করেন রঁমা রঁলা। তিনি নাম দেন ‘ÔGolden Book of Tagore’। বইটিতে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখেছিলেন কবির গুণমুগ্ধ আইনস্টাইন, ন্যুট হামসুন, হ্যারল্ড ল্যাসকির মতো বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিরা।

শুধু বৈশাখে নয়, সে বছর ভরা শীতে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন উপলক্ষে ২৫ থেকে ৩১ ডিসেম্বর কলকাতায় ‘ঠাকুর সপ্তাহ’ পালিত হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেক্ষাগৃহে ও টাউনহলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। টাউনহলে রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি ও লেখার পা-ুলিপি প্রদর্শিত হয়েছিল। ইডেন গার্ডেন প্রাঙ্গণে যাত্রা, কীর্তন, জারি গান, কথকতা, রায়বেশে, দেশীয় খেলাধুলার আয়োজন করা হয়েছিল।

পঁচিশে বৈশাখ ১৯৪১ (৮ মে) কবির জীবদ্দশার শেষ রবীন্দ্রজয়ন্তী। অত্যন্ত অনাড়ম্বরভাবে শান্তিনিকেতনে পালিত হয় বিশ্বকবির জীবনের শেষ রবীন্দ্রজয়ন্তী। শান্তিনিকেতনের ‘উদয়নে’ বসে জীবনের শেষ জন্মদিন উপলক্ষে কবি লিখেছিলেন কয়েকটি লাইন, যা ছিল দার্শনিক কবির জীবনচর্যার নির্যাস- ‘আমার এ জন্মদিন মাঝে আমি হারা/আমি চাহি বন্ধুজন যারা/তাহাদের হাতের পরশে/মর্ত্যরে অন্তিম প্রীতিরসে/নিয়ে যাব জীবনের চরম প্রসাদ,/নিয়ে যাব মানুষের শেষ আশীর্বাদ।’

রবীন্দ্রজয়ন্তীর জন্য জীবদ্দশাতেই অপমানিত হয়েছিলেন বিশ্বকবি। ১৯১১ সালে বঙ্গীয় পরিষদ যখন রবীন্দ্রজয়ন্তীর আয়োজন করে, তখন তার বিরুদ্ধে কলকাতার একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। তারা রবীন্দ্রজয়ন্তীর আয়োজনের বিরুদ্ধে লিফলেট ছাপিয়ে বিলি করেন এবং একটি লিফলেট কবিকেও পাঠিয়ে দেন।

শোকাহত কবি ৪ মে (১৯১১) চিঠি লেখেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে। সেই চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘আজ আমার পঞ্চাশ বৎসর পূর্ণ হইবার মুখে এই আর একটি নিন্দা আমার জন্মদিনের উপহার রূপে লাভ করিলাম এই যে, আমি আত্মসম্মানের জন্য লোলুপ হইয়াছি। এই নিন্দাটিকেও নতশিরে গ্রহণ করিয়া আমার একপঞ্চাশত বৎসরের জীবনকে আরম্ভ করিলাম, আপনারা আশীর্বাদ করিবেন সকল অপমান সার্থক হয় যেন।’

(তথ্য কৃতজ্ঞতা : জীবনের ঝরাপাতা : সরলা দেবী চৌধুরাণী, পুণ্যস্মৃতি : সীতা দেবী, পঁচিশে বৈশাখ : অনুত্তম ভট্টাচার্য, জন্মদিনের মুখর তিথি : সুনীল দাস)

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close