আমিনুল ইসলাম

  ২৭ আগস্ট, ২০২১

জাতীয় কবির ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

নজরুলের চোখে দারিদ্র্য ও তার কারণ

কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন সর্বোতমুখী এক প্রতিভা। তিনি সাহিত্য সাধনার জন্য বেশি সময় পাননি, মোটে ২০-২২ বছর। তবে এ সময়ে তিনি যা সৃষ্টি করে গেছেন, তা-ই তাকে কবি-কথাশিল্পী-দার্শনিকের পর্যায়ে উন্নীত করেছে। তিনি ছিলেন জীবনবাদী শিল্পী। তার সকল কবিতা, গান-উপন্যাস-ছোটগল্প-অভিজ্ঞান-প্রত্যক্ষ জীবন-অভিজ্ঞতাভিত্তিক। তিনি রোমান্টিক হলেও শেকড়শূন্য কল্পনাবিলাসী ছিলেন না। তিনি সাম্যবাদী, মানবতাবাদী কবি ছিলেন। তিনি সমাজে-পৃথিবীতে বিরাজমান ও ক্রমবর্ধমান ধন-বৈষম্যের বিষয়টির প্রতি যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করেছিলেন। তিনি এই বৈষম্যের অবসান রেখেছিলেন, যেমন চেয়েছিলেন- মানুষে মানুষে কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট জাতপাত-বর্ণ-লিঙ্গধর্ম-ভেদের অবসান।

অর্থনীতিবিদরা বেশ কিছুকাল যাবৎ দারিদ্র্যের নানাবিধ সংজ্ঞা প্রদান এবং সীমা-পারসীমা নির্ধারণ করে আসছেন।

নজরুল তার ‘দারিদ্র্য’ নামক সুবিখ্যাত কবিতায় দারিদ্র্যের বহুমাত্রিক ডাইমেন্শন তুলে ধরেছেন অনন্য নান্দনিক সুচারুতায়। তিনি কবিতার শুরুতে বলেছেন যে, দারিদ্র্য তাকে সত্য কথা বলার দুঃসাহস জুগিয়েছে, অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস দান করেছে। দারিদ্র্যের প্রভাবে তার মুখের কথা, লেখার বাণী ক্ষুরধার তরবারির মতো শানিত হয়ে উঠেছে। এটা সর্বজনীনভাবে সত্য না হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সত্য যে, দরিদ্র মানুষরা নির্ভীকভবে সত্য কথা উচ্চারণ করতে পারেন, তারা ন্যায়ের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন। তাদের কোনো পিছুটান থাকে না। কিন্তু যাদের ধনসম্পদ বেশি থাকে, তারা প্রতিষ্ঠানবিরোধী সংগ্রামে শরিক হতে দ্বিধাগ্রস্ত হোন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে গরিব নজরুল যে ভূমিকা পালন করেছিলেন, জমিদার রবীন্দ্রনাথ তা পারেননি। কারণ, তার পিছুটান ছিল- জমিদারি হারানোর ভয়, সুখের জীবন পরিত্যাগ করার বাধ্যবাধকতা। আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেও ধনবানরা, শিল্পপতি-জোতদাররা অংশগ্রহণ করেননি বলেই চলে। কারণ, তাদের ধনসম্পদ এবং আয়েশি জীবনের পিছুটান ছিল। কিন্তু ছাত্র-কৃষক-দিনমজুরদের সেই পিছুটান ছিল না। তাই মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপকভাবে বেশি। এভাবে দারিদ্র্য মানুষকে ব্যক্তিগত পিছুটান ফেলে মহত্তর ও বৃহত্তর কাজে শরিক হওয়ার প্রণোদনা দান করে, প্রেরণা জোগায়। নজরুল তার ‘দারিদ্র্য’ কবিতার শুরুতেই তাই বলেছেন- ‘হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান,/তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রিস্টের সম্মান/কণ্টক-মুকুট শোভা!-দিয়াছ, তাপস,/অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস;/উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি; বাণী ক্ষুরধার।’

কিন্তু দারিদ্র্যের এই একটিমাত্র গুণ ছাড়া বাকি আর সব দোষ বা নেতিবাচক গুণ। প্রতিটি বাবা-মা চান তার সন্তান যেন দুধেভাতে থাকে কমপক্ষে। কিন্তু সে পথে একমাত্র বাধা দারিদ্র্য। দুধভাত সংগ্রহে রাখার সামর্থ্য গরিব মানুষের থাকে না। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। একজন অনাহারক্লিষ্ট অর্থাৎ দারিদ্র্যপীড়িত মা তার দুধের শিশুকে বুকের দুধ দিতেও ব্যর্থ হন। কারণ, খাদ্যের অভাবে শীর্ণ-জীর্ণ শরীরে বুকের স্তনে মাতৃদুগ্ধ সঞ্চিত হয় না। নজরুল দারিদ্র্যের এই সূক্ষ্ম নিবিড় ভয়াবহ রূপটি প্রত্যক্ষ করেছেন এবং কবিতায় তা ফুটিয়ে তুলেছেন অপরিসীম বেদনাভরা ভাষায়। নজরুলের কবিতা পড়ে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে মধ্য-এশিয়া-আফ্রিকার দুর্ভিক্ষ-পীড়িত, যুদ্ধকবলিত দারিদ্র্য-পীড়িত অনাহারক্লিষ্ট জননী এবং হাড্ডিসার শিশুর অগণিত ছবি। ‘চলে পথে অনশনক্লিষ্ট ক্ষীণ-তনু,/কী দেখি বাঁকিয়া ওঠে সহসা ভ্রু-ধনু,/দু’নয়ন ভরি, রুদ্র হান অশ্রুবান/আসে রাজ্যে মহামারি দুর্ভিক্ষ তুফান/প্রমোদকানন পুড়ে, উড়ে অট্টালিকা/তোমার আইনে শুধু মৃত্যুদণ্ড লিখা!’

এই দুর্ভিক্ষকবলিত মহামারিগ্রস্ত বড় আকারের ছবি মানুষের দৃষ্টিগোচর হয় সহজেই। সংবাদপত্র টেলিভিশন চ্যানেলগুলো তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থে এবং সাংবাদিকরা তাদের পেশাগত স্বার্থে হলেও এসব ছবি নিয়ে কাভার স্টোরি বানিয়ে প্রচার করেন। কিন্তু বিচ্ছিন্ন বা ব্যক্তিগত দারিদ্র্য অঙ্কুরে বিনষ্ট করে দেয় বহু জীবন- সবার অগোচরে, সবার অলক্ষ্যে। ওইসব ব্যক্তিগত দারিদ্র্যের ভয়াবহ রূপ এবং তার দংশনে মৃতপ্রায় মানুষের ছবি তোলে না কেউ, সেসব ছবি কাভারেজ পায় না মিডিয়ায়। নজরুল ছিলেন সর্বহারাদের কবি, শোষিত-বঞ্চিতদের কথাশিল্পী, সর্বশ্রেণির মানুষের সুখ-দুঃখের অংশীদার। তিনি সমাজের নিম্নশ্রেণির মানুষের সঙ্গে মিশেছেন গভীরভাবে নিবিড়ভাবে। দারিদ্র্যের জাঁতাকলে পড়ে তাকে কাজ করতে হয়েছে রুটির দোকানেও। ফলে তিনি বৃহত্তর দুর্ভিক্ষ যেমন দেখেছেন, ততোধিক গভীর দৃষ্টি নিয়ে দেখেছেন সমাজের আনাচে-কানাচে পড়ে থাকা দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষদের। কবি জসীম উদ্দীন ‘আসমানী’ কবিতায় দারিদ্র্যের ভয়াবহ প্রতিক্রিয়ার ছবি আঁকতে গিয়ে বলেছেন- ‘পেটটি ভরে পায়নি খেতে বুকের ক’খান হাড়/সাক্ষী দিতে অনাহারে ক’দিন গেছে তার।’

নজরুল তারও আগে দারিদ্র্যের আরো নিবিড় রূপ লক্ষ করেছেন- যেখানে দারিদ্র্যের কবলে পড়ে শুকিয়ে যায় মায়ের স্তন, সন্তান পায় না বেঁচে থাকার মাতৃদুগ্ধ। ‘সহসা চমকি উঠি! হায় মোর শিশু/জাগিয়া কাঁদিছ ঘরে! খাওনিক কিছু/কালি হতে সারাদিন তাপস নিঠুর/কাঁদ মোর ঘরে নিত্য তুমি ক্ষুধাতুর!/পারি নাই বাছা মোর, হে প্রিয় আমার,/দুই বিন্দু দুগ্ধ দিতে! -মোর অধিকার/আনন্দের নাহি নাহি! দারিদ্র্য অসহ/পুত্র হয়ে জায়া হয়ে কাঁদে অহরহ/

আমার দুয়ার ধরি।’

কথায় বলে, অভাব দুয়ারে দাঁড়ালে ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালায়। শূন্য হাতে কোনো কিছুই করা যায় না। সুখও আসে না শূন্য ঘরে। ঘরে থাকা সুখ ঘরশূন্য হওয়া মাত্র দৌড় দিয়ে পালায়। অভাব মানেই অতৃপ্তি, অ-সুখ, অশান্তি। দরিদ্র রাষ্ট্রসমূহে অপরাধ সংঘটিত হয় বেশি। বিরাজ করে অস্থিরতা। দরিদ্র পরিবারেও অশান্তি ও ঝগড়া-বিবাদ লেগে থাকে নিত্য। মানুষের সুখী হওয়ার জন্য প্রাচুর্যের দরকার হয় না। তবে সচ্ছলতার প্রয়োজন হয় অপরিহার্যভাবেই। পেটে ভাত না থাকলে মিষ্টি কথা শুনে ভালো লাগে না। ক্ষুধাক্লিষ্ট প্রাণে কোনো শান্তি দিতে পারে না মধুর সংগীতও। বলা হয় যে, বাসরঘর হচ্ছে সবচেয়ে সুখের স্থান, বাসররাত হচ্ছে সবচেয়ে মধুর সময়। কিন্তু দারিদ্র্য প্রবেশ করলে একটি দাম্পত্য জীবনে, বাসররাতে শুরু হওয়া মধুর জীবনের সহসায় ছেদ পড়ে। ক্ষুধাপীড়িত শরীরে মধুর মিলনের স্বাদ আস্বাদন করা অসম্ভব। মানুষের সংসারে দারিদ্র্যের ভয়ংকর ও সর্বনাশা প্রভাবের কথা উপস্থাপন করতে গিয়ে নজরুল তার দারিদ্র্য ভাবনাকে নান্দনিকতার শিখর স্পর্শ করিয়েছেন। তিনি বলেছেন- ‘দারিদ্র্য হচ্ছে দুর্বাষা ঋষি, যে ক্ষমাহীন এবং যার চোখ যেখানেই পড়ে সেখানেই অশান্তির আগুন জ্বলে ওঠে। সে আগুনে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যায় সব শান্তি-সুখ-স্বপ্ন।’

দারিদ্র্যের দৃশ্যমান প্রতিক্রিয়াগুলো সমাজবিজ্ঞানী এবং অর্থনীতিবিদরা লক্ষ করেন এবং এসব নিয়ে তারা নানা গবেষণাকর্ম প্রকাশ করে থাকেন। এসব করে তারা খ্যাতি, যশ, অর্থ, প্রতিপত্তি, পুরস্কার লাভ করে থাকেন। কিন্তু দারিদ্র্যের শারীরিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া ছাড়াও একটি ভয়ংকর প্রতিক্রিয়া হচ্ছে দারিদ্র্য মানুষের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের পথে তা মারাত্মক বাধা হিসেবে কাজ করে। প্রতিভা এবং উচ্চাশা থাকা সত্ত্বেও অর্থের অভাবে অন্যকথায় দারিদ্র্যের কারণে বহু প্রতিভাধর মানুষের প্রতিভার অকাল-মৃত্যু ঘটে। বেঁচে থাকার জন্য দুমুঠো অন্ন জোগাড় করতেই যাকে ব্যয় করতে হয় সমস্ত সময় ও সামর্থ্য, তার পক্ষে তো নান্দনিক সৃষ্টির সাধনা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। সুন্দরের স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত করতে পারেন না তিনি। অধিকন্তু দারিদ্র্য মানুষের চিন্তার পরিবর্তন ঘটায় তাকে অন্নমুখী ভাবনায় তাড়িত করে। তা ছাড়া দারিদ্র্য মানুষের নান্দনিক চেতনাতেও পরিবর্তন ঘটায়। রোমান্টিক কবি-শিল্পীরা যেভাবে আকাশচারী হোন, দারিদ্র্যজর্জরিত একজন কবির পক্ষে তা সম্ভব হয়ে উঠে না। তিনি আকাশে উড়তে গিয়ে ফিরে আসেন মাটির কাছে, জীবনের মাঝে। অধিকাংশ সময় মানুষের মেধার রস শুকিয়ে যায়, দারিদ্র্যের খরতাপে। কত যুবক-যুবতী লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন দারিদ্র্যের চাপে পড়ে, তার হিসাব লিখে রাখেননি কেউ।

দারিদ্র্য মানুষের প্রতিভা বিকাশের পক্ষে বিরাট অন্তরায়। দারিদ্র্য মানুষের সুখের শত্রু। দারিদ্র্য মানুষের ভালো কাজের পথে অলঙ্ঘনীয় অন্তরায়। মানুষের মেধা, মননশীলতা, সৃজনশীলতার ওপর দারিদ্র্যের এই মারাত্মক প্রভাবের বিষয়টি কোনো অর্থনীতিবিদের গবেষণায় ধরা পড়ে না। অমর্ত্য সেনদের চোখ পড়ে না এখানে। কিন্তু নজরুল তার গভীর নিবিড় সূক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে এ জায়গাগুলো দেখেছেন এবং কবি-শিল্পী-ভাস্কর প্রভৃতি সৃজনশীল মানুষের কাজ কোনো কিছুকে বহুকৌণিক সৌন্দর্যে উপস্থাপন করা, পুরাতন সুন্দরের শরীর নতুন, আলো ফেলে তাকে নতুন সৌন্দর্যে পুনঃসৃষ্টি করা। আর এটা করতে হলে প্রয়োজন হয় নিরুপদ্রব সময়। একাগ্রচিত্তে গভীর ভাবনায় ডুব দিয়ে সৃজনশীল মানুষ তুলে আনেন সৌন্দর্যের আশ্চর্য কোটা। কিন্তু দারিদ্র্য মানুষকে নিত্য জ্বালাতনের মধ্যে রাখে বলে সেই একনিষ্ঠ গভীর মনোনিবেশ ঘটানোর সময় হয় না। তাই গরিব শিল্পীর পক্ষে অমরার অমৃত সাধনা করার সময় ও সুযোগ হয় না বললেই চলে। কপালে ‘বেদনার টীকা’ নিয়ে তাকে ‘কাটাকঞ্জে বসে’ মালিকা গেঁথে যেতে হয়। সৃজনশীল মেধা এবং সৃজনশীল চর্চার ওপর দারিদ্র্যের এই অভিঘাতকে চিহ্নিত করেন নজরুল তার ‘দারিদ্র্য’ কবিতায়।

একজন সৃজনশীল মানুষের জন্য দারিদ্র্য হচ্ছে সাপের মতো। সে প্রতি মুহূর্তে দংশন করে সৃজনশীল মানুষের মন, মেধা, চিন্তা, চেতনা এবং সাধনাকে। সৃজনশীল মানুষ তার প্রতিভাকে পূর্ণ বিকশিত করার পুরো সামর্র্থ্য ও সময় পান না। দারিদ্র্য তাকে সে সুযোগ দেয় না। অভাব-অনটন যার নিত্যসঙ্গী, সে শিল্পের সাধনায়, নন্দনচর্চায় মনোনিবেশ করার সামর্থ্য ও সময় পান না। একদিকে অভাব-অনটনের যন্ত্রণা, অন্যদিকে নিজের সৃজনশীলতাকে যথোপযুক্তভাবে বিকশিত করে তোলার ব্যর্থতা, দারিদ্র্যগ্রস্ত সৃজনশীল ব্যক্তিকে সব সময় কষ্ট দেয় দেহে মনে সর্ব-অস্তিত্বে। তাই নজরুল দারিদ্র্যকে সাপের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন- ‘গাহি গান, গাঁথি মালা, অঙ্গ করে জ্বালা/দংশিল সর্বাঙ্গে মোর নাগ নাগ বালা।’

দারিদ্র্যগ্রস্ত জীবন দুর্বিষহ। অস্তিত্ব ঘিরে নানাবিধ যন্ত্রণা। জীবন হয়ে যায় শূন্য। এই শূন্য জীবন বড়ই দুর্বিষহ। এ ধরনের জীবন বয়ে চলা বড়ই কঠিন। উৎসব আসে পৃথিবীতে; দরিদ্রের ঘরে তা প্রবেশ করে না। ঋতু বদল হয় প্রকৃতিতে; দরিদ্রের মনে লাগে না বসন্তের রং। সিংহাসনে বসে নতুন রাজা; অভিষেক উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে রাজ-প্রাসাদ; কিন্তু দরিদ্রের ঘরে শুধু নাই নাই কান্না।

দারিদ্র্যকে নিজের চোখের জল নিজেই পান করতে হয়। তার জন্য থাকে না কোনো শরবৎ, কোনো উৎসবের মদ। তার জন্য গ্লাসভর্তি বিষের পানীয় আর চারপাশে নাই নাই হাহাকার ।

নজরুল বিশ^াস করতেন প্রকৃতির প্রতিটি বস্তুতে বা উপকরণে সব মানুষের সব প্রাণীর সমান অধিকার বিধাতা প্রদত্ত। কিন্তু কিছু কিছু মানুষের সীমাহীন লোভ-লালসা সমাজে সৃষ্টি করে ভয়ংকর ধন-বৈষম্যে। তিনি এটাকে অন্যায় বলেছেন এবং এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। তার ভাষা শানিত এবং আক্রমণাত্মক। পুঁজিবাদই সভ্যতার নামে যে অমানবিক শোষণ-নিপীড়ন তিনি তাকে নির্মমভাবে কশাঘাত করেছেন। তিনি দারিদ্র্যের মূল কারণ চিহ্নিত করেছেন শাশ্বত সফলতায়। কবি তার শেষ অভিভাষণে (যদি আর বাঁশি না বাজে) বলেছিলেন- ‘হিন্দু-মুসলমানে দিন-রাত হানাহানি, জাতি-জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র্য, ঋণ, অভাব। অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষাণ-স্তূপের মতো জমা হয়ে আছে। এই অসাম্য, এই ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম।’ সুতরাং দেখা যাচ্ছে, নজরুলের অর্থনীতিবিষয়ক জ্ঞান ছিল খুবই পরিষ্কার। তিনি তার একাধিক কবিতায় এবং গানে দারিদ্র্যের কারণ যে মূলত শোষণ-নিপীড়ন, তা পরিষ্কার করে বলেছেন। ‘বিচারক! তব ধমদ- ধর,/ছোটদের সব চুরি করে আজ বড়রা হয়েছে বড়।/যারা যত বড় ডাকাত-দস্যু জোচ্চোর দাগাবাজ/তারা তত বড় সম্মানী গুণী জাতি-সঙ্ঘেতে আজ।/রাজার প্রাসাদ উঠিছে প্রজার জমাট রক্ত-ইটে,/ডাকু ধনিকের কারখানা চলে নাশ করি কোটি ভিটে।/দিব্যি পেতেছে খল কলওলা মানুষ পেষানো কল/আখপেষা হয়ে বাহির হতেছে ভুখারী মানুষদল।’ (চোর ডাকাত/সাম্যবাদী)

নজরুল যখন এই কবিতা লেখেন, তখনকার তুলনায় আজকের খোলাবাজার অর্থনীতির যুগে ধনবৈষম্যে অনেক বেশি প্রকটতর হয়ে উঠেছে। সেই সময়ে দুর্নীতবাজ, লুটেরাদের অন্তত সমাজ ঘৃণার চোখে দেখত। কিন্তু এখন শুরু হয়েছে নির্লজ্জ ধন-পূজা, বিবেকহীন পুঁজি-উপাসনা। সমাজতন্ত্রের পতনের পরে পুরো পৃথিবী পড়েছে বিবেকহীন চরম পুঁজিবাদী শোষণের এবং শাসনের কবলে। এখন শোষণের বিরুদ্ধে কথা বলার কেউ নেই। নজরুল তার দূরদর্শী চোখ দিয়ে অগ্রিম এই অবস্থা দেখতে পেয়েছিলেন।

‘পেতেছে বিশ্বে বণিক-বৈশ্য অর্থ-বেশ্যালয়/নিচে সেথা পাপ-শয়তান- সাকি গাহে যক্ষের জয়।’ (পূর্বোক্ত)

তিনি আরো পরিষ্কার করে বলেছেন, একশ্রেণির মানুষের ভোগবাদী জীবন এবং সীমাহীন লোভ আরেক শ্রেণিকে সম্পদহীনতায় অন্য কথায় দারিদ্র্যে নিপতিত করছে। কারণ পৃথিবীতে সব মানুষের প্রয়োজন অনুপাতে সম্পদ থাকলেও সবার লোভ পূরণের মতো অশেষ সম্পদ নেই। ফলে একশ্রেণির মানুষ বেশি বেশি পরিমাণে সম্পদ কুক্ষিগত করলে আরেক শ্রেণির মানুষের ভা-ারশূন্য হতে বাধ্য। লোভী মানুষের সঞ্চিত সম্পদে ভরে উঠছে ব্যাংকের ভোল্ট, আর আরেক শ্রেণির মানুষের ঘরে জমে উঠছে নিঃস্বতার হাহাকার। এরা দখল করছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা। এরা নিজেদের উন্নীত করছে স্বঘোষিত উচ্চশ্রেণিতে। অর্থলিপ্সা, শোষণ আর ভোগবাদ এই তিন অশুভ কাজের মধ্যে মাতাল হয়ে থাকে এই ধনিকশ্রেণি। নজরুল এদের অভিশাপে অভিশপ্ত করেছেন। ‘সোনা যারা যারা পায়, তাহারাই হয় সোনার পাথর-বাটি/আশরফি পেয়ে আশরাফ হয় চালায়ে মদের ভাঁটি!/মানুষের রূপে এরা রাক্ষস রাবণ-বংশধর/পৃথিবীতে আজ বড় হইয়াছে যত ভোগী-বর্বর।/এদের ব্যাঙ্ক ‘রিভার-ব্যাঙ্ক’ হইবে দুদিন পরে/বোঝে না লোভীরা, ভীষণ মৃত্যু আসিছে এদেরি তরে।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close