বাবুল আনোয়ার

  ০৯ জুলাই, ২০২১

মন মোর মেঘের সঙ্গী

মন চলে যায় দূরে। বর্ষায় মেঘ ও বৃষ্টির মোহন আবেশে। অজানা অনুরাগের অন্তহীন নীলে। হৃদয়ে মেঘ ও বৃষ্টির অন্যরকম এক অনুভূতি নানা দ্যোতনায় রং ছড়ায়। কী নাম দেওয়া যায় তার? কীভাবে বলা যায় তাকে? ভালোলাগা, ভালোবাসা না অন্তহীন দহনের গহন অনুভব? কোনোটাই বলা যেন ঠিক হয়ে ওঠে না। বর্ষায় বৃষ্টি পড়ে টাপুর-টুপুর, কখনোবা অবিরাম জলের মুষলধারায়। মাঝে মাঝে রোদ আসে বোধে লাগে চমক। মেঘের সঙ্গে নেচে ওঠে মন। অদৃশ্য মায়াবী ভুবন নীরবে ডাকে। নস্টালিজকতায় স্রোতে ভেসে যায় হৃদয়। আনন্দে, সুখানুভূতির গাঢ় আলিঙ্গনে কখনোবা বিরহ-বিষাদময়তায়। বর্ষা এ রকমই। এ রকম নানাভাবে, নানা রঙে ধরা দেয় বিচিত্র বোধে।

গ্রীষ্মের খররৌদ্রে যখন যাপিত জীবন হাঁপিয়ে ওঠে তখন বর্ষা আসে শীতল, সজীব ধারায়। খাল-বিল, নদী-নালা পূর্ণ হয় জলে। শাপলা, শালুক, পদ্ম ফুলের জলছোঁয়া সৌন্দর্য প্রকৃতিকে করে তোলে অপরূপ। কদম ফুল ফোটে ভালোবাসা-বেদনার অনুরাগে। গ্রামীণ জনপদে আসে ভিন্ন মুখরতা। হাঁটুজলের নদী ভরাজলে বেগবান হয়। কৃষকের ব্যস্ততা বাড়ে। পতিত ভূমি ও চর পলিমাটির উর্বরতায় জেগে ওঠে। রাতের আঁধার চিরে ব্যাঙ, ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক, জোনাকির আলোয় বাঁশবাগানের ওপর চাঁদ ওঠে। পুরোনো-নতুন পথে, প্রান্তরে আগের মতোই। ধ্রুপদি সংগীতের সুরে ভেজা বাতাসে হারিয়ে যায় অভিমানী হৃদয়। স্মৃতি স্মরণে কেউ জেগে থাকে প্রিয় প্রহরে। কেউ আবার বিনিদ্র রাত জাগে কষ্ট ও বেদনায়।

বর্ষা সবার জীবনে সব সময় শুভ বার্তা বয়ে আনে না। বিশেষ করে নদীভাঙন এলাকার মানুষ অবর্ণনীয় কষ্টের মুখে পড়ে। শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়ে।

তবু বর্ষা আসে শ্বাশত বৈভবে। হৃদয়ের আবেগ, অনুভূতির প্রকাশ ঘটে বিচিত্রভাবে। সাহিত্য, সংগীত, শিল্পকলায়। কখনোবা আড্ডা, আলাপচারিতায়, হৃদয়ের একান্ত নিভৃত চরাচরে। বর্ষার রূপ, মাধুর্য, বন্যা, প্লাবনের চিত্র, প্রতিক্রিয়া ও প্রতিফলন শুধু জীবনে নয়, সাহিত্য, শিল্প, কথাসাহিত্য ও সংগীতেও ওঠে এসেছে যুগযুগান্তর ধরে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ও গানে বর্ষার প্রকাশ ও পরিস্ফুটন ঘটেছে তার অন্তহীন অনুভব ও নিজস্ব কুশলতায়। কবির হৃদয় উদ্বেলিত হয় বর্ষার ঝড় বাদলে। তিনি অবলোকন করেন তা গভীর মনোযোগ ও মুগ্ধতায়। অনবদ্যভাবে এর প্রকাশ ঘটে। তিনি বলে ওঠেন ‘নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে/ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।/বাদলের ধারা ঝরে ঝরো-ঝরো,/আউশের ক্ষেত জলে ভরো-ভরো,/কালিমাখা মেঘে ওপারে আঁধার ঘনিয়েছে দেখ্ চাহি রে।’

বর্ষায় অবসরে, ঘরে বন্দি মনে অথবা ভাবনার অন্তহীন দিগন্তে নানা কথা, নানা স্মৃতি ভাসে। হারিয়ে যাওয়া দিন, আবেগঘন মুহূর্তগুলো যেন সুর তোলে। কখনোবা বেদনার ছবি আঁকে। রবীন্দ্রনাথ মানব-হৃদয়ের এ আকুলতা, বিহ্বলতার চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন তার কবিতায়। তিনি যখন বলেন, তখন ভিন্ন অবয়বে নানা ব্যঞ্জনার সৃষ্টি হয়। রবীন্দ্রনাথ অসংখ্য গানে বর্ষার মহিমা তুলে ধরেছেন। এসব গানে জীবনের নানা বোধ অনুরণিত হয়। মন চলে যায় মেঘের মুল্লুকে। মন যেন হয় মেঘের সঙ্গী। বৃষ্টি হয়ে ঝরে সুরের ধারায় ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী/উড়ে চলে দিগ্দিগন্তের পানে/নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণবর্ষণসংগীতে/রিমিঝিম রিমিঝিম রিমিঝিম।’

কাজী নজরুল ইসলামের বর্ষার অনুভূতি তার মতোই ভিন্ন আদলে। কখনো তা প্রেমের গভীর প্রত্যয়ে, কখনোবা বিষাদ ও বিরহের সুরে। বর্ষার আগমন যেমন হৃদয়ে বৈচিত্র্য আনে নানা বৈভবে, তার বিদায়ও তেমনি অনুভবে রেখাপাত করে। নজরুল ইসলামের প্রেমিক কবি-হৃদয়ে তার প্রকাশ ঘটে গভীর বিষাদময়তায় ‘তোমার কপোল-পরশ না পেয়ে পাড়ুর কেয়া-রেণু,/তোমারে স্মরিয়া ভাদরের ভরা নদীতটে কাঁদে বেনু।/কুমারী ভীরু-বেদনা-বিধুর প্রণয় অশ্রুসম/ঝরিছে শিশির-সিক্ত শেফালি নিশি-ভোরে অনুপম।’

বর্ষা ও বৃষ্টির অবিরল জলধারা স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলে। মনে পড়ে সেই মুখ, যা গেছে দূরে বা হারিয়ে হৃদয়ে তার দাগ যেন অম্লান চিরদিনের মতো। কখনো তা ভোলা যায় না। চেতন, অবচেতনে সেই সব স্মৃতি জেগে ওঠে। বর্ষায় তার বেগ আবেগের গভীরে ঝড় তোলে। সে যেন এসব ভুলে না যায়, অন্তত শ্রাবণ রাতে ব্যথিত হৃদয়ে স্মরণ করে অবিস্মৃত মহিমায়। তেমনি গভীর প্রেম ও বিচ্ছেদ-বেদনায় কবি হৃদয় মূর্ত হয়ে ওঠে অবিস্মরণীয় বাণীতে ‘শাওন-রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে/বাহিরে ঝড় বহে, নয়নে বারি ঝরে/ভুলিও স্মৃতি মম, নিশীথ-স্বপন সম/আঁচলের গাঁথা মালা ফেলিও পথ ’পরে।’ এমনতরো অনুভূতি কবি নজরুলের অনেক লেখায় ধ্বনিত হয়।

বর্ষা, মেঘ আর মন যেন অবিচ্ছিন্ন। জাগতিক জীবনে বর্ষা যেমন আসে নানা রকম সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে। তেমনি মানবিক মননেও এর প্রভাব নানাভাবে ক্রিয়াশীল। স্মৃতিময়তা, সুখানুভূতি, বিরহ-বিষাদ হৃদয়কে নানাভাবে নাড়া দেয়। শিহরিত করে। ‘এমনি বরষা ছিল সেদিন/শিয়রে প্রদীপ ছিল মলিন/তব হাতে ছিল অলস বীণ/মনে কি পড়ে প্রিয়?’ পঞ্চাশ দশকে প্রণব রায়ের লেখা মাধুরী চট্টোপাধ্যায়ের গাওয়া এই গানটি সেই আবেগময়তায় অনুরণিত হয়। হৃদয়কে গভীরভাবে স্মৃতিকাতর করে তোলে।

এ জীবনে কত কথা, কত ব্যথা। না বলা আকুলতা। আমরা সব সময় প্রিয়জনের কুশল কামনা করে থাকি। যখন বিরূপ সময় আসে, মন খারাপ হয়। আমরা তখন সহানুভূতি আর ভালোবাসায় হাত বাড়িয়ে দিই। বর্ষার মেঘ মেদুর দিনে সেই শুভকামনা কখনো আবেগঘন হয়ে ওঠে। মন চায় বলতে ‘যদি মন কাঁদে/তুমি চলে এসো, চলে এসো/এক বরষায়/এসো ঝর ঝর বৃষ্টিতে/জল ভরা দৃষ্টিতে/এসো কোমল শ্যামল ছায়।’ (রচনা হুমায়ূন আহমেদ, শিল্পী মেহের আফরোজ শাওন)। মানব-হৃদয়ের হাহাকার ও আকুলতা এভাবে বর্ষায় নানাভাবে প্রতিফলিত হয়। প্রিয়জনের হৃদয়ের হাহাকার মোচনে বৃষ্টিমুখর দিনে কাছে আসার একান্ত বাসনা, ভালোবাসা ধ্বনিত হয় আবেগমথিত বাণীতে। বর্ষার শীতল, কোমল পরিবেশ, মনকে মোহগ্রস্ত করে তোলে। বর্ষা, বৃষ্টিতে মন মেঘের সঙ্গী হয়ে উড়ে যায়, উড়ে যেতে থাকে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close