মুহাম্মদ কামাল হোসেন

  ২২ নভেম্বর, ২০১৯

অর্ধেক হুমায়ূন অর্ধেক আমি

আমি হিমু। আসল নাম হিমালয়। বাবা শখ করে রেখেছিলেন নামটা। তার ধারণা ছিল, ছেলে এক দিন হিমালয়ের মতো উঁচু ও বিশাল হবে। কিন্তু হয়নি। বাউন্ডুলে হয়েছি। কাঁধে একখানা ব্যাগ ঝুলিয়ে হলুদ পাঞ্জাবি পরা ছেলেরা কখনো হিমালয় হতে পারে না। বাবা আমাকে নিয়ে ভুল স্বপ্ন দেখেছেন। এমন স্বপ্ন দেখা তার মোটেও ঠিক হয়নি। কষ্ট পেতে হয়। স্বপ্নভাঙার যাতনায় পুড়তে হয়। আমি কারো অযাচিত কষ্টের কারণ হতে চাই না। ছোট্ট ওইটুকুন পুঁচকে বয়সে যদি কথা বলতে পারতাম, তাহলে নির্ঘাত বলতাম, ‘বাবা, আপনি অফ যান। হিমালয় না রেখে, অন্য কিছু রাখেন।’ অথবা পাড়ার মৌলভীকে ডেকে বিষয়টি আগেই সুরাহা করে নিতাম। তাতেও কাজ না হলে মৃদু ধমক দিয়ে বলতাম, ‘মৌলভী সাব, মানুষের নাম পাহাড়-পর্বতের নামে হবে কেন?’ আশপাশের পরিচিত মহলে আমাকে নিয়ে যথেষ্ট বিরক্তি রয়েছে। বিরক্ত হওয়ারও নিশ্চয় ১০১ কারণ আছে। কিন্তু সমস্যা হলো, দিন শেষে কেউ সেটা পুষে রাখতে পারে না। বাবা অবশ্য সেক্ষেত্রে সবার থেকে একটু ব্যতিক্রম। পুষে রাখেন। ভ্রুকুচকে আমার দিকে কিছুক্ষণ পরপর তাকাবেন অথচ মুখ ফুটে কিছু বলবেন না। এ বিষয়টি আমার আরো বেশি অস্বস্তি লাগে। অস্বস্তি এক ধরনের চুলকানির মতো। এটার মলম নেই। সহজেও সারে না। মা আমাকে বরাবরি এসব ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকে আগলে রাখেন।

আমার বাহিরের পৃথিবী আরো বড়। বেশির ভাগ মানুষ কোনো এক অজ্ঞাত কারণে আমাকে অসম্ভব ভালোবাসে। সেই রহস্যের কূলকিনারা করার ইচ্ছে জাগে না কখনো। জগতের সব রহস্যের সমাধান করতে নেই। রহস্য তখন আর রহস্য থাকে না। রহস্য রহস্য থাকাই ভালো। আমার সিক্সথ সেন্সও নাকি প্রখর। এটা ভাগ্নে শুভ্রর ধারণা। সে মনে করে, আমি দিন দিন মনীষী গোচের কেউ একজন হয়ে যাচ্ছি। আমার অদ্ভুত সব ক্ষমতা রয়েছে। খুব সহজে মানুষকে হিপনোটাইজ করার ক্ষমতা রাখি। অথচ আমি জানি, এসবের কিছু আমার নেই। হিপনোটাইজ করার ক্ষমতা থাকলে সবার আগে রূপাকেই করতাম। তারপর ওর বাবাকে। বিয়েটা ঠেকাতাম। কিন্তু বিয়েটা হচ্ছে। ইদানীং বড় আপা আমার যাতায়াতের ওপর হঠাৎ করে রেড অ্যালার্ট জারি করেছে। বিশেষত তার বাসার ত্রিসীমানায় ঢোকা বারণ। শুভ্রটা নাকি আজকাল অদ্ভুত সব কান্ড-কারখানা করে বেড়াচ্ছে। হিমু মামার মতো হতে চায়। বাসায় দরজা জানালা ও বাতি বন্ধ করে, সারাক্ষণ কী সব আজগুবি এক্সপেরিমেন্টও করে যাচ্ছে। আশ্চর্য হওয়ার মতো ঘটনা বৈকি, কিন্তু আমি আশ্চর্য হতে পারছি না। যেন এটাই হওয়ার কথা ছিল, এমন একটা ভাব করে চুপচাপ বসে আছি। আপা আমার নির্বিকার ভঙ্গি দেখে আরো দ্বিগুণ রেগে যায়। ভেবেছিল, আমিও কপালে চোখ তুলে বলব, ‘বলো কী আপা! শুভ্রটা ভেতরে ভেতরে দেখছি খুব পাজির হদ্দ হয়ে গেছে! ওকে কষে দুটো চড় লাগাও।’ আমি জানি, আপা দরজা বন্ধ করে আয়নার সামনে বসে কিছুক্ষণ কাঁদবেন। ছোটবেলায় বাবা বলেছিলেন, কাঁদলে তোকে অসম্ভব সুন্দর দেখায়। ব্যস তখন থেকে আপা এমনটা করে আসছেন। ‘রথ দেখা আর কলা বেচার মতো, কান্নার সঙ্গে সৌন্দর্যও ফ্রিতে দেখা হচ্ছে। গিনেস বুকে রেকর্ড হওয়ার মতো ঘটনা।

শুভ্রর মতো কিছুটা মাজেদা খালাও। আমাকে বুঝে। সবকিছু খালার ভাল্লাগে। খালার ধারণা, হিমু কখনো ভুল করতে পারে না। ওর ভুল করতে নেই। বুঝে না শুধু রূপা। কখনো বুঝতেও চায় না। অথচ আমাকে সুপারগ্লুর মতো ভালোবাসে। সব সময় নজরদারিতে রাখার চেষ্টা করে। পায়জামা ঢিলা থেকে শুরু করে দাঁড়িগোফ কোনোটিই ওর তীক্ষè নজর থেকে এড়ায় না। এ মুহূর্তে দুজন পাশাপাশি বসে রয়েছি। রূপার মেজাজ ভীষণ রকম চড়ে আছে। নাকের ডগা অনবরত ঘেমে যাচ্ছে। আলামত ভালো ঠেকছে না। মেজাজ খারাপ হলে ওর এমনি হয়। আজও আসতে প্রায় ৩০ মিনিট লেট করে ফেলেছি। কিছুই করার নেই। খালি পায়ে হেঁটে এসেছি। রূপার বোঝা উচিত, হিমুদের সময় জ্ঞান কম থাকে। জগতের এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করা চলে না। সময়কে বরং তার নিজস্ব ধারায় চলতে দেওয়া উচিত।

রূপাকে আজ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে। বিয়ের সময় এলে মেয়েদের সৌন্দর্য হুট করে বেড়ে যায়। রাত পোহালেই বিয়ে। সানাইয়ের সুর এরই মধ্যে বেজে ওঠেছে। অথচ সবার অলক্ষ্যে সে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। সম্পর্কের পাট চুকাতে। রাগ অভিমানের মধ্য দিয়ে অনেক কথাই বলে যাচ্ছে। বেশির ভাগ কথাই আমার কানে ঢুকছে না। কেন বুঝতে পারছি না। কী জানি হয়তো মন চাইছে না এসবের কিছুই শুনতে। রূপার বর্ণনা অনুযায়ী অনেকক্ষণ ধরে আসলামের একটা অবয়ব দাঁড় করানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু পারছি না, বারবার ব্যর্থ হচ্ছি। শুরুতে মূর্তিটার কপালে একটা কাটা দাগ ভেসে ওঠছে। আসলাম রূপার হবু বর। ও নিশ্চয় কোনো চোর, বদমাস কিংবা গুন্ডা প্রকৃতির ছেলে হবে না। ও রকম হলে হয়তো দাগটাগ জাতীয় কিছু একটা থাকত। তবু কথার ফাঁকে রূপাকে জিজ্ঞেস করে ফেলি, ছেলেটার কপালে কোনো দাগটাগ আছে কি না। কোনো উত্তর পাইনি। পাওয়ার কথাও নয়। রূপার রাগ আজ অত সহজে নামবে বলেও মনে হচ্ছে না। জোছনার আলোয় রূপাকে নিয়ে কতক্ষণ হাঁটতে পারলে বরং ভালো হতো। রাগী মেয়েদের তখন আরো সুন্দর দেখায়। দিনের আলোতে জোছনা পাওয়া সম্ভব নয়। রাত অবধি রূপাকে কাছে ধরে রাখাও অসম্ভব। তাছাড়া ও কিছুতেই অপেক্ষা করবে না। রূপাকে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘চলো, আজ রাতে দুজনে চাঁদের আলোতে কিছু হাঁটাহাঁটি করি।’ রাত পোহালে যে মেয়ের বিয়ে, সে নিশ্চয় আমার এই অদ্ভুত প্রস্তাবে রাজি হতে চাইবে না। রূপাকে আজ নীলা বলেও ডাকতে ইচ্ছে করছে। নীল শাড়িতে এবারই প্রথম তাকে দেখলাম। ওর নামটা নীলা হলেই ভালো হতো। কোথাও যেন পড়েছি, নীলা নামের মেয়েরা অসম্ভব সুন্দরী হয়। রূপার বাবা কোনো এক কারণে আমাকে সহ্য করতে পারেন না। সন্দেহের চোখে চশমার ওপর দিয়ে তাকান। বাউন্ডুলে ছেলের সঙ্গে মেয়ের ঘুর ঘুর করা তার মোটেও পছন্দ নয়। রূপার রাগ পড়েনি। আরো কিছু ঝাঁজাল কথাবার্তা শুনিয়ে হনহন করে চলে যায়। পেছনে পড়ে থাকি আমি। ওর গমন পথের দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে থাকি।

সন্ধের পর আজ আর কোত্থাও বের হইনি। ইচ্ছে করছে না। কেমন জানি হালকা শীত শীত লাগছে। বড় আপার বাসায় হুলিয়া জারি এখনো রয়েছে। বিকালে মা বললেন, মাজেদা খালা ফোন করেছিল। জরুরি ডাক পড়েছে বাসায় যেতে। আমার জন্য নতুন কী সব রেসিপি-টেসিপি প্রস্তুত করে রেখেছে। বাসায় গেলে রান্না করে খাওয়াবে। বাতি অফ করে বদ্ধরুমে বসে রয়েছি। শুভ্রটাকে এ মুহূর্তে বারবার মনে পড়ছে। ইতোমধ্যে মা বারকয়েক ডাকাডাকি করে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছেন। ‘জোছনা নামলে রুম থেকে বের হব’ বাক্যটি একটু করো কাগজে লিখে রুমের দরজায় সেঁটে দিয়েছি। মায়ের নজরে পড়েছে বোধহয়, না পড়লেও সমস্যা নেই। বিষয়টা এত গুরুত্বপূর্ণ নয়। আজ অনেকক্ষণ চাঁদের আলোয় একাকী ঘুরে বেড়াব। রূপা থাকলে ভালো হতো। দুজনে হাতে হাত রেখে অন্তত কিছুটা সময় হাঁটতে পারতাম। কিন্তু সেটা আর সম্ভব হচ্ছে না। রাত পোহালেই ওর বিয়ে। এক নতুন জীবনে ডুবে যাবে সে। আমার চারপাশে গাঢ় অন্ধকার, তবু চোখ বন্ধ করে থাকি। ভাবনার আকাশে ডুবে যাই। নাটাই হাতে বিষাদের নীল ঘুড়ি উড়ে বেড়াই। এভাবে কেটে যায় কতক্ষণ জানা নেই। বেশ কিছুক্ষণ ধরে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে মনোসংযোগ ঘটে। ঘুড়িটাকে নামাতে যাব ঠিক তখনই। মনোসংযোগ পুনঃস্থাপন করতে পারছি না। কে হতে পারে দরজার ওপাশে? নাকি শব্দটা ভুল শুনতে পেয়েছি? দরজা খুলে রূপাকে দেখতে পাই। অস্ফুটস্বরে বলি, ‘ও তুমি?’ আমি ভাবলেশহীন। চমকে যাওয়ার কথা আমার। কিন্তু উল্টো চমকে যায় রূপা। ভাবখানা এমন যেন আমি রূপার অপেক্ষায় বসে রয়েছি। কিছুক্ষণ আগে আসলামকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। ওর বিরুদ্ধে জালিয়াতির মামলা রয়েছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন অপরাধের সুনির্দিষ্ট তথ্য আছে পুলিশের কাছে। সে একজন ছদ্মবেশী দাগি অপরাধী। রূপা অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। ‘চলো ছাদে যাই, আজ খুব সুন্দর জোছনা নেমেছে।’ আমি রূপার হাত ধরে এগোতে থাকি। নীল শাড়িতে খোলা এলোকেশি চুলে রূপাকে অপরূপ লাগছে। মুহূর্তে আমাকে নিয়ে ও জোছনা স্নানে মেতে ওঠে। বাতাসে দোল খাওয়া চুলগুলো আমাকে বারবার ছুঁঁয়ে দিচ্ছে মুগ্ধের মতোই। মেয়েটার বিয়ে হওয়ার কথা অথচ হচ্ছে না। সত্যি, জগৎ বড় বিচিত্র ও রহস্যঘেরা। রূপা হাসছে। আনন্দে হাসছে। রাতের নিস্তব্ধতাকে খাক করে বাতাসে অনেকদূর পর্যন্ত হাসির শব্দ ভেসে যাচ্ছে। হঠাৎ হাসতে হাসতে রূপা বলে, ‘আচ্ছা, আসলামের কপালে কাটা দাগ রয়েছে, সেটা তুমি জানলে কী করে? আমি আজই প্রথম দেখলাম, ওর কপালে স্পষ্ট দাগ রয়েছে।’ আজ আর কোনো প্রশ্নোত্তরে যেতে ইচ্ছে করছে না আমার। জগতের সব প্রশ্নের উত্তর দিতে নেই। রূপা পাশে, তবু শুভ্রটাকে ভীষণ মনে পড়ছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close