লিয়াকত হোসেন লিংকন, কাশিয়ানী (গোপালগঞ্জ)

  ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

কাশিয়ানীতে গরিবের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরেও লুটপাট

কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে পুরো টাকা উত্তোলন করেছেন ইউএনও

গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলায় চলছে ‘জমি আছে, ঘর নেই’ এমন গৃহহীন মানুষের জন্য সরকারি অর্থায়নে ঘর নির্মাণ। কিন্তু আশ্রয়ণ প্রকল্পের সেই ঘর নির্মাণে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করা হচ্ছে এবং অধিকাংশ সুবিধাভোগীদের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা। এমন অভিযোগ ভুক্তভোগী গৃহহীনদের। গত ৩০ জুনের মধ্যে প্রকল্প শেষ হলেও এখনো শেষ হয়নি নির্মাণকাজ। প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ আওতায় সারা দেশের মতো কাশিয়ানীতে চার কোটি ৭১ লাখ টাকার এই আশ্রয়ণ প্রকল্প চলমান রয়েছে।

উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, আশ্রয়ন প্রকল্প-২ এর অধীনে কশিয়ানী উপজেলায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪৭১টি ঘরের জন্য চার কোটি ৭১ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। সে হিসেবে প্রতিটি ঘরের জন্য এক লাখ টাকা ব্যয় হবে। এতে উপজেলার তিন ইউনিয়নের প্রতিটিতে গড়ে ১৫৭টি করে ঘর নির্মাণ করা হবে। গত ৩০ জুন শেষ হয়েছে প্রকল্পের মেয়াদ। কিন্তু এখনো কোনো ইউনিয়নে নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। তবে কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে ৩ জুনের মধ্যে প্রকল্পের সমস্ত টাকা উত্তোলন করে নিজের হাতে রেখেছেন ইউএনও। এখন পর্যন্ত উপজেলার কুসুমদিয়া ইউনিয়নের কাজ চলছে এবং কোনো কোনো সুবিধাভোগীর কাজ এখন পর্যন্ত শুরুই হয়নি।

আশ্রয়ণ সুবিধাভোগীদের অভিযোগ, ঘর পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন স্থানীয় ইউপি সদস্য ও দালাল চক্র। ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে সম্পূর্ণ নীতিমালা, নকশা ও শিডিউল ছাড়া। এতে একটি ঘর নির্মাণে সর্বোচ্চ ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে।

প্রকল্প নীতিমালা নিয়মানুযায়ী, ঘরের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করতে পিআইসি কমিটি গঠন করে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে (ডিপিএম) কাজ করতে হবে। প্রকল্পের পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির সভাপতি ইউএনও, সদস্য সচিব উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা। কমিটি অন্য সদস্যরা হলেন উপজেলা প্রকৌশলী, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। নির্দেশনা অনুযায়ী গত ৩০ জুনের মধ্যে প্ল্যান, ডিজাইন ও প্রাক্কলন মোতাবেক গুণগত মান বজায় রেখে নির্মাণ কাজ শেষ করার কথা। কিন্তু এখন পর্যন্ত অর্ধেক কাজ সম্পন্ন করতে পারেনি কর্মকর্তারা। এ ছাড়া কাজ সম্পাদনের পর কোনো অর্থ উদ্বৃত্ত থাকলে তা ৩০ জুনের আগে চালানের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হবে। এসব কাজের কোনোটাই সঠিক নিয়মে করা হয়নি।

গতকাল সোমবার উপজেলার কুসুমদিয়া ইউনিয়নে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ১৭৫ বর্গফুট ঘরের নির্মাণ কাজ করছেন কাঠমিস্ত্রী মারুফ মোল্লা, বাদল মোল্লাসহ চারজন। তাদের কাছে কাঠের কথা জানতে চাইলে তারা বলেন, চম্বল কাঠ দিয়ে ঘরের (আড়া, বাতা, আঠন) কাজ হচ্ছে। কাঠের দরজা-জানালা তৈরিতে উন্নত মানের কাঠ ব্যবহার করার কথা থাকলেও ব্যবহার করা হচ্ছে খুবই নিম্নমানের কাঠ। যেখান ব্যবহার করা হয়েছে চম্বল গাছের নিম্নমানের কাঠ। প্রকল্পের নীতিমালায় জানালায় রড ব্যবহার করার কথা থাকলেও ব্যবহার করা হচ্ছে প্লাস্টিকের সিক।

টিনে করা হয়েছে অভিনব প্রতারণা। প্রতিটি টিনের গায়ে ঘসে টিনের নাম্বার পরিবর্তন করো হয়েছে ৩২০ এমএম পরিবর্তে ৩৬০ এমএম করা হয়েছে। দুই ঘষে তুলে দিয়ে স্থায়ী মার্কার কলম দিয়ে হাতে দিয়ে ছয় লিখে দিয়েছেন। এদিকে, উন্মুক্ত ক্রয় পদ্ধতিতে ১৭৫ বর্গফুট আয়তনের একটি ঘর ও ল্যাট্রিন নির্মাণে ২১টি পিলার দেওয়ার কথা। পিলারের উচ্চতা ১২ ফুটের পরিবর্তে ১০ ফুট এবং ১০ ফুটের পরিবর্তে আট ফুট করা হয়েছে। প্রতিটি পিলার তৈরিতে উন্নত মানের গ্রেডের রড ব্যবহারের কথা থাকলেও সেখানে ব্যবহার করা হচ্ছে নন গ্রেডের রড। মেশিনে তৈরির বদলে করা হয়েছে হাতে তৈরি। নিম্নমানের খোয়া ব্যবহার করায় ঘর নির্মাণের আগেই ফাটল ধরেছে।

নীতিমালায় ঘরের মেঝেতে বালু বাবদ পাঁচ হাজার টাকা বরাদ্দ থাকলেও বালু দিতে হচ্ছে সুবিধাভোগীদের। এ বিষয়ে কুসমুদিয়া গ্রামের মিনা বেগম বলেন, ‘বালুর কথা বললে আমাদের বলেন, বালু আপনাদের দিতে হবে বালুর জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। মেঝে বালু ভরাট করতে আমাদের সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়।’

কুসুমদিয়া গ্রামের আরেক ভুক্তভোগী নিজামুল কাজী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর বরাদ্দকৃত ঘর পেতে আমি মো. সৈয়দ মেম্বারকে ১০ হাজার টাকা দিয়েছি। আর ঘরের কাজ শেষ হওয়ার আগেই মেঝের ইট ধসে গেছে আর আমি নিজের টাকায় মেঝে বালু ভরাট করেছি।’

উপজেলার চাপ্তা গ্রামের আশিক শেখ বলেন, ‘বিল্লাল মেম্বার ঘর এনে দেওয়ার কথা বলে গত দেড় বছর আগে আমার এবং আমার দুই মামার কাছ থেকে ১২ হাজার করে টাকা নিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমাদের ঘর এনে দিতে পারেননি। আমি বিষয়টি কাউকে বলতে পারছি না।’ প্রায় একই কথা বলেন কাশিয়ানী সদর ইউনিয়নের পোনা কাদিরপাড়া এলাকার বাসিন্দা নিরালা বেগম।

ঘর দেওয়ার জন্য টাকা নেওয়ার ব্যাপারে মহিন মুন্সীর সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে এখনো কিছু বলা যাচ্ছে না। পরে হিসাব করে বলতে পারব।’

জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ এস এম মাঈন উদ্দিন বলেন, প্রধানমন্ত্রীর দফতরের বরাদ্দকৃত ঘর অক্টোবর মাসের মধ্যে হস্তান্তর করব। আর সঠিক নিয়মে কাজ হচ্ছে।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মো. আলাউদ্দিন অনিয়মের কথা অস্বীকার করে বলেন, কে বা কারা সুবিধাভোগীদের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছেন তা আমরা অবগত নই।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close