নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০৮ এপ্রিল, ২০২৪

পাহাড়ে রহস্যময় নাম ‘নাথান বম’

গ্রেপ্তারে নেওয়া হবে ইন্টারপোলের সহায়তা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ থেকে স্নাতক শেষ করে চাকরির খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন নাথান লনচেও বম। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরির প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে মনোযোগ দেন পর্যটন ব্যবসায়। তবে সেটাতেও ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি। এরপর নিজেই একটি এনজিও গড়ে তোলেন, এরই মধ্যে লিখে ফেলেন গোটা পাঁচেক বইও। এতে পাহাড়ি অঞ্চলে বাড়ে জনপ্রিয়তা। সেই সঙ্গে অর্থের সঞ্চার হওয়ায় কার্যক্রম পরিবর্তন হতে শুরু করে। গঠন করেন সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের কাছে বিভীষিকায় পরিণত হয়েছে এই কেএনএফ। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে এখন পর্যন্ত রহস্যময় নাম নাথান বম!

আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর নেতারা বলছেন, পাহাড়ে এর আগে পাঁচটি আঞ্চলিক সংগঠন রয়েছে। সেগুলো হলো সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ), ২০১০ সালে সন্তু লারমার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে নানা অভিযোগে সুধাসিন্ধু খীসা ও তাতিন্দ্র লাল চাকমার নেতৃত্বে আবির্ভাব ঘটে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা), ২০১৭ সালের নভেম্বরে ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ভেঙে গড়ে উঠে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক)। এছাড়াও রয়েছে মগ লিবারেশন পার্টি।

এরই মধ্যে নতুন করে কেএনএফ নামে নতুন সংগঠনের নাম সামনে এসেছে। গত ২৪ মে সশস্ত্র এই সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। সেইসঙ্গে সাংগঠনিক প্রধান হিসেবে নাথান বমের নাম ঘোষণা করা হয়। বান্দরবানের বম জাতিগোষ্ঠীর কয়েকজন ব্যক্তি এটি গড়ে তুলেছেন বলে জানা গেছে।

কেএনএফের দাবি, পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে কেএনএফ। কুকি-চিন রাজ্য নামে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল চেয়ে তারা বলেছে, ওই রাজ্যে বম, খিয়াং, পাংখুয়া, লুসাই, খুমি ও ম্রোরা থাকবে। সেখানে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরারা থাকবে না।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটি সূত্রে জানা গেছে, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার (এমএন লারমা) গঠিত জনসংহতি সমিতি ভেঙে কয়েকটি গ্রুপের সৃষ্টি হয়েছিল। কেএনএফ সেগুলোর মধ্য থেকে আসা একটি গ্রুপ। এরই মধ্যে সশস্ত্র সংগঠন হিসেবে নিজেদের অবস্থান জানান দিয়েছে।

হঠাৎ করেই কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সশস্ত্র গ্রুপটি ব্যাংক ও অস্ত্র লুট, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর চেকপোস্টে হামলা করে। এরপরই আলোচনায় আসে কেএনএফ। ধারণা করা হচ্ছে, এই হামলার নেপথ্যে রয়েছে কেএনএফের শীর্ষ নেতা নাথান বম। যদিও দুই বছর ধরে তিনি পলাতক রয়েছেন। জানা গেছে, বর্তমানে তিনি ভারতের মিজোরামে অবস্থান করছেন।

গত শনিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বান্দরবান পরিদর্শনে গিয়ে বলেন, নাথানকে গ্রেপ্তারে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের সহায়তা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বাংলাদেশ। তার বিরুদ্ধে থাকা মামলা ও অপকর্মের তথ্য যুক্ত করে শিগগির ইন্টারপোলকে চিঠি দেওয়া হবে। এরপর রেড নোটিস জারির প্রক্রিয়া শুরু হবে। নাথান যাতে বিশ্বের অন্য কোনো দেশে নির্বিঘ্নে পালিয়ে থাকতে না পারেন, এটা নিশ্চিত করতে এ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

কে এই নাথাম বম?

পুরো নাম নাথান লনচেও বম। মাধ্যমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে নাথানের পড়াশোনায় একাধিকবার বিঘ্ন ঘটে। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। এরপর যখন এলাকায় ফিরে যান, তখন পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন করে উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর নেতৃত্বে ছিল জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)। নাথান সেই প্রতিষ্ঠানে কাজ করার জন্য বেশ তদবির করেছিলেন। কিন্তু এই কাজ তিনি পাননি। এটা তাকে বেশ ক্ষুব্ধ করে। নাথানের ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু বলছিলেন, কয়েকজন চাকমা যুবক ওই চাকরি পেয়েছিলেন। নাথান মনে করতেন, তার জাতিগোষ্ঠীর সংখ্যা কম বলে চাকরিটা তাকে দেওয়া হয়নি। চাকমারা সংখ্যায় বেশি, সেজন্য তারা সুযোগ পেয়েছেন। এজন্য নাথান চাকমাদের ওপর কিছুটা বিদ্বেষী হয়ে ওঠেন। সর্বশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ নম্বর আসন বান্দরবান থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোয়নপত্র সংগ্রহ করেছিলেন নাথান বম।

স্থানীয় সূত্র বলছে, নাথান বম রুমা উপজেলার হেডের পাড়ার বাসিন্দা। বয়স আনুমানিক ৪২ বছর। নাথান এক সন্তানের জনক। তার স্ত্রী স্থানীয় এক স্কুলের শিক্ষক।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, নাথান ছাত্রজীবন থেকে বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। প্রথমে যুক্ত ছিলেন সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদে। তবে ভাস্কর্য বিভাগের ছাত্র হিসেবে শিখেছিলেন ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ। পার্বত্য শান্তিচুক্তির পর খাগড়াছড়ি শহরের মহাজন পাড়া এলাকায় লারমা স্কয়ারে এমএন লারমার একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করা হয় ২০০০ সালে। এরপর শিল্পী হিসেবে খ্যাতি বাড়ে। সে সময় হিল আর্টিস্ট গ্রুপেও যুক্ত ছিলেন। পাশাপাশি বম বিষয়ে লেখালেখি করেছেন। কুকি-চিনভুক্ত জাতিগোষ্ঠীর পরিচিতি নিয়ে ‘দ্য বমজৌ’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন। এছাড়া গবেষণামূলক আরো পাঁচটি বই প্রকাশিত হয়। এই কারণে নাথান লেখক হিসেবেও পরিচিত।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, প্রথমে কুকি-চিন ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিও) নামে সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন নাথান। ২০১৬ সালে সশস্ত্র একটি গ্রুপ তৈরি করেন। পরে কেএনডিওর বদলে কুকি-চিন ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার্স (কেএনভি) নাম দিয়ে কার্যক্রম চালান। এরপর ভারতের মণিপুর ও বার্মার চীন রাজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। কেএনভির প্রথম ব্যাচে সংগঠনের শতাধিক সদস্যকে মণিপুরে প্রশিক্ষণে পাঠান। এরপর ১০০ সদস্যকে মণিপুর, বার্মার কারেন ও কাচিন রাজ্যে গেরিলা প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়। ২০২০ সালে কেএনভির নাম বদলে কেএনএফ হয়। তাদের সশস্ত্র উইংয়ের নাম দেওয়া হয় কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় কেএনএফ

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেএনএফ সংগঠনের নামে ফেসবুক পেজ খুলে কার্যক্রম চালাচ্ছে তারা। এছাড়া দেখা গেছে, সাবেক টুইটার এক্স হ্যান্ডেলেও। ফেসবুক পেজে সংগঠনের প্রধান হিসেবে নাথান বমের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। চলতি বছরের মে মাসে সংগঠনের প্রধানের নাম ঘোষণা করে সশস্ত্র হামলার জানান দেয় কেএনএফ। তখন থেকে ফেসবুকে নিয়মিত তাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণের নানা ছবি ও ভিডিও দিয়ে অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে।

কেএনএফ সূত্র মতে, কেএনএফের সশস্ত্র গ্রুপের সদস্য তিন-চার হাজার। যারা পার্বত্য চট্টগ্রাম ও মিজোরামে সক্রিয়। তবে ২৮ মে তাদের প্রস্তাবিত রাজ্যের মানচিত্র ফেসবুক পেজে প্রকাশ করে আলোচনার জন্ম দেয় তারা।

বড়থলি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আতো মং মারমা বলেন, তাদের এসব কর্মকাণ্ডের পর থেকে এলাকার মানুষ আতঙ্কে আছেন। যৌথবাহিনী আছে বলে কিছুটা ভয় কম আমাদের। কিন্তু যৌথবাহিনী চলে গেলে আবার কী করে বসে তারা সে আতঙ্কে আছি।

এসব বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরুপা দেওয়ান বলেন, ‘পত্রপত্রিকায় প্রথম কেএনএফের নাম শুনি। পরে ফেসবুকে তাদের নানা কর্মকাণ্ড দেখতে পাই। হঠাৎ কীভাবে কোথায় থেকে এলো নাথান? তাদের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে, পার্বত্য অঞ্চলকে অশান্ত করতে নতুনভাবে ষড়যন্ত্র করছে। তাদের কোনো দাবি থাকলে আগে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করুক। অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দিয়ে তাদের দমন করা উচিত। স্থানীয় মানুষ যাতে ক্ষতির মুখে না পড়ে সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close