বান্দরবান প্রতিনিধি

  ০৪ এপ্রিল, ২০২৪

তিন ব্যাংকে সশস্ত্র হানা টাকা-অস্ত্র লুট

বান্দরবানের রুমায় সোনালী ব্যাংকে ডাকাতির ১৫ ঘণ্টার মাথায় ভরদুপুরে ডাকাতি হয়েছে থানচির দুই ব্যাংকে। গতকাল বুধবার দুপুরে থানচির সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংক শাখায় হানা দেয় সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। এ সময় দুটি ব্যাংক থেকে ১৭ লাখের বেশি টাকা লুটের ঘটনা ঘটেছে। এর আগে মঙ্গলবার রাতে রুমা উপজেলায় সোনালী ব্যাংকে হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। ব্যাংকের ভল্ট ভেঙে প্রথমে ২ কোটি টাকা লুটের কথা বলা হলেও পরে সিআইডি জানায়, কোনো টাকা খোয়া যায়নি। ডাকাতরা ভল্ট ভাঙতে পারেনি। তবে ব্যাংকটির নিরাপত্তারক্ষী পুলিশ ও আনসার সদস্যদের ১৪টি অস্ত্র ও গুলি লুটে নিয়ে গেছে সন্ত্রাসীরা। একইসঙ্গে অপহরণ করা হয়েছে সোনালী ব্যাংক রুমা শাখার ব্যবস্থাপক নিজাম উদ্দিনকে। তার খোঁজ এখনো মেলেনি। এসব ঘটনায় সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টকে (কেএনএফ) দায়ী করা হচ্ছে। পার্বত্য এলাকার সব ব্যাংকে সেনাবাহিনীর সদস্য ও পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।

বান্দরবানের রুমায় ব্যাংকে হামলার ঘটনার রেশ চলাকালেই বুধবার দুপুরে থানচি উপজেলার দুটি ব্যাংক থেকে ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা ডাকাতি হয়েছে। দুপুর সাড়ে ১২টায় উপজেলা সদরের সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকের দুই শাখায় এ ঘটনা ঘটেছে। থানচি থানা থেকে ব্যাংক দুটির দূরত্ব ২০০ গজ। উপজেলা পরিষদের দূরত্ব ৩০০ গজ। থানার কাছে দিনদুপুরে ডাকাতির ঘটনায় স্থানীয় লোকজন হতভম্ব। সোনালী ব্যাংক থানচি শাখার ব্যবস্থাপক ফয়সাল হুদা বলেন, অস্ত্রধারী পাঁচ থেকে সাতজন লোক ব্যাংকে ঢোকে। ক্যাশিয়ারের সামনে পাওয়া সব টাকা তারা নিয়ে নেয়। প্রায় ১৫ লাখ টাকা হতে পারে। ব্যাংকের বাইরে অস্ত্রধারী ১০ থেকে ১২ জন ছিল। পরে তারা ফাঁকা গুলি ছুড়ে চলে যায়। সোনালী ব্যাংকের পাশেই কৃষি ব্যাংক থানচি শাখা। এ শাখার ব্যবস্থাপক হ্লা শৈ থোয়াই বলেন, ব্যাংকে চার থেকে পাঁচজন অস্ত্রধারী ঢোকে। তারা এসে চোখের পলকে আমাদের ব্যাংকে ঢুকে সবাইকে জিম্মি করে ফেলে। তিনি বলেন, অস্ত্রধারীরা ক্যাশিয়ারের সামনে থাকা আড়াই লাখ টাকা নিয়ে যায়। পরে তারা ফাঁকা গুলি ছুড়ে চলে যায়।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় মহম্মদ আরমান বলেন, তিনি সোনালী ব্যাংকে টাকা জমা দিতে যান। বের হওয়ার সময় দেখেন অস্ত্রধারী লোকজন ব্যাংকে ঢুকছে। তারা ক্যাশিয়ারের সামনে থেকে টাকা লুট করে নিয়ে যায়। স্থানীয়রা জানান, ব্যাংকে যারা ডাকাতির জন্য প্রবেশ করেছিলেন তার বাইরেও তাদের আরো লোকজন সশস্ত্র অবস্থায় ছিলেন। তারা বাজারের বিভিন্ন পয়েন্টে অস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেন। থানচি বাজারের এক ব্যবসায়ী বলেন, থানচিতে আজ (বুধবার) ছিল সাপ্তাহিক বাজার। উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে লোকজন মালামাল নিতে এখানে এসেছিলেন। বেলা সোয়া ১২টা থেকে সাড়ে ১২টার মধ্যে তিনটি জিপে কয়েকশ লোক আসে। আমরা তিনটি গাড়িতে করে লোকজন আসতে দেখেছি। তার মধ্যে দুটি গাড়ি থেকে নেমে তারা দুই ব্যাংকে যায়। একটি গাড়ি ব্যাংকের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল।

বুধবার সাপ্তাহিক বাজার থাকায় দুই ব্যাংকেই অনেক গ্রাহক ছিলেন জানিয়ে ওই ব্যবসায়ী বলেন, সোনালী ব্যাংকে প্রবেশ করে দলটির সদস্যরা ম্যানেজারকে খুঁজতে থাকে। না পেয়ে ক্যাশ বাক্সে থাকা টাকা নিয়ে যেতে দেখা গেছে। সশস্ত্র দলটির সঙ্গে কয়েকজন নারীও ছিলেন জানিয়ে ওই ব্যবাসায়ী বলেন, ব্যাংক লুট শেষে সশস্ত্র দলটি থানচি বাজারে প্রকাশ্যে ব্রাশফায়ার করে আতঙ্ক তৈরি করে এবং তিনটি জিপে চড়ে চাঁদাপাড়া এলাকার সড়কের দিকে চলে যায়। দলটির লোকজন খাকি পোশাক পরে ছিলেন। আমাদের ধারণা, তারা কুকি-চিন পার্টির সদস্য। থানচি থানার ওসি মো. জসিম উদ্দিন জানান, আজ (বুধবার) দুপুর সাড়ে ১২টায় এ ঘটনা ঘটেছে। একদল সশস্ত্র লোক দুটি গাড়িতে করে এসে পাশাপাশি থাকা কৃষি ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংক শাখায় হামলা চালায়। এ সময় সোনালী ব্যাংক ও থানচি বাজারের আশপাশে ফাঁকা গুলি করেছে সন্ত্রাসীরা।

রুমায় সোনালী ব্যাংকের ভল্ট অক্ষত, লুট হয়নি টাকা : এর আগে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে বান্দরবানের রুমা উপজেলায় সোনালী ব্যাংকে হানা দেয় ডাকাতরা। ব্যাংকের ভল্ট ভেঙে প্রায় ২ কোটি টাকা লুট করার কথা ছড়িয়ে পড়লেও বুধবার সিআইডি জানায়, ডাকাতরা কোনো টাকা নিতে পারেনি। ভল্ট ভাঙতে পারেনি তারা। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিশেষ পুলিশ সুপার শাহনেওয়াজ খালেদ বুধবার বিকেল সাড়ে ৪টায় জানান, মঙ্গলবার রাতে ডাকাতি হওয়া ব্যাংকের ভল্ট অক্ষত আছে। শাহনেওয়াজ খালেদ বলেন, সিআইডির চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার ইউনিটের দুটি দল রুমায় গিয়ে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেছে। পরে ব্যাংকের ভল্ট খুলে সব টাকা গুনে দেখা হয়। দেখা যায়, মঙ্গলবার রাখা ১ কোটি ৫৯ লাখ ৪৬ হাজার টাকার পুরোটা রয়েছে। তিনি বলেন, একসঙ্গে দুটি চাবি দিয়ে ভল্ট খুলতে হয়। কোনো কারণে অস্ত্রধারীরা হয়তো ভল্ট খুলতে পারেনি।

দায়ী করা হচ্ছে কেএনএফকে : স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, রুমা ও থানচির ব্যাংক লুটের ঘটনা ঘটিয়েছে পাহাড়ের সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট-কেএনএফ সদস্যরা। তারা ব্যাংকের নিরাপত্তায় থাকা পুলিশ সদস্য এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) বাসভবনে পাহারায় থাকা আনসার সদস্যদের কাছ থেকে দুটি এসএমজি (লাইট মেশিন গান) ও ৬০টি গুলি, ৮টি চীনা রাইফেল ও ৩২০টি গুলি এবং ৪টি শটগান ও ৩৫টি কার্তুজ নিয়ে গেছে। এছাড়া কেএনএফের অস্ত্রধারীরা যাওয়ার সময় সোনালী ব্যাংক রুমা শাখার ব্যবস্থাপক নিজামুদ্দিনকে নিয়ে যায় বলে স্থানীয় লোকজন বলছেন। বুধবার বিকেল পর্যন্ত তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। এসব বিষয়ে বান্দরবানের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) আবদুল করিম বলেন, দুপুরে থানচিতে ব্যাংকে হামলা হয়েছে বলে আমরা খবর পেয়েছি। আমাদের ধারণা, গতকালের (মঙ্গলবার) গ্রুপটিই এটা করেছে। রুমার ঘটনার তদন্তে কোনো অগ্রগতি এখনো হয়নি।

বান্দরবানে ঘটনাস্থল পরিদর্শন আইজিপির : রুমা সোনালী ব্যাংকে হামলা ও ডাকাতির ঘটনার পর বুধবার সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। তিনি ব্যাংকের পাশাপাশি পাশের মসজিদও পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি ব্যাংক কর্মকর্তা ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন। পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে থানচির ব্যাংক ডাকাতি নিয়েও কথা বলেন আইজিপি। তিনি বলেন, আমরা একটু আগেই বিষয়টি শুনেছি। আমরা সতর্ক ছিলাম বলেই তারা এসে পালিয়ে গেছে। আমরা এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছি। প্রতিটি ঘটনার বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়ে পুলিশপ্রধান বলেন, যারা দৃষ্কৃতকারী তাদের আইনের আওতায় আনা হবে এবং যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বান্দরবানের ব্যাংকগুলোয় কঠোর নিরাপত্তা : রুমা ও থানচির ঘটনার পর বান্দরবান জেলার ব্যাংকগুলোয় কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে লেনদেন হয়েছে। সোনালী ব্যাংকের বান্দরবান জেলা শাখার ব্যবস্থাপক রাজন কান্তি দাস বলেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর সতর্কতা অবলম্বনের নিদেশনা দেওয়া হলে আমরা ব্যাংকিং সময় পর্যন্ত লেনদেন করেছি। লেনদেন কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে হয়েছে। জেলা সদর ও সব উপজেলায় একই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অনেক ব্যাংক হয়তো লেনদেন সীমিত করেছে নিরাপত্তার কথা ভেবে।

কুমারখালীর ইসলামী ব্যাংকের ভল্ট ভেঙে টাকা চুরি : বান্দরবানের ১৫ ঘণ্টার ব্যবধানে দুটি উপজেলার তিনটি ব্যাংকে সশস্ত্র ডাকাতের হানার খবরের মধ্যেই জানা গেছে, কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ইসলামী ব্যাংকের এজেন্ট শাখায় ভল্টের তালা ভেঙে প্রায় ৫ লাখ ২৭ হাজার টাকা চুরির অভিযোগ পাওয়া গেছে। মঙ্গলবার রাতে উপজেলার নন্দলালপুর ইউনিয়নের আলাউদ্দিন নগর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। বুধবার সরেজমিন দেখা যায়, একটি জানালার গ্রিল কাটা। ভল্টের তালা ভাঙা, সিসিটিভির ডিভিআর নেই। অগোছালো আলমারি। উৎসুক জনতা ভিড় করেছে।

এ সময় এজেন্ট ব্যাংকিং শাখার ইনচার্জ মো. শামসুল আলম জানান, তিনি সকাল ৯টায় ব্যাংকে এসে দেখেন জানালার গ্রিল কাটা, ভল্টের তালা ভাঙা। ভল্টে রাখা ৫ লাখ ২৭ হাজার ৬৮৬ টাকা নেই। সিসিটিভির ডিভিইয়ার নেই। আলমারি অগোছালো। তার ভাষ্য, রাতের আঁধারে ব্যাংকে চুরির ঘটনা ঘটেছে। তিনি থানায় মামলা করবেন। কুমারখালী থানার ওসি মো. আকিবুল ইসলাম জানান, চুরির ঘটনাটি রহস্যজনক মনে হচ্ছে। তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। ঘটনার তদন্ত চলছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close