মিজান রহমান

  ২৮ জানুয়ারি, ২০২৪

ঘরের আগুনে পুড়ছে জাপা

জাতীয় পার্টি (জাপা) আবারও ভাঙনের দিকে যাচ্ছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন-বাণিজ্য, প্রার্থীদের খোঁজখবর না নেওয়া, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত না করাসহ বিতর্কিত ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেওয়ায় দলটির শীর্ষনেতাদের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছেন নেতাকর্মীরা। দফায় দফায় ভুল সিদ্ধান্তের কারণে অভিভাবকহীন হয়ে পড়া জাপায় চলছে গৃহদাহ। দেশের রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে- এ লাগামছাড়া ক্ষোভের আগুনে পানি ঢালবেন কে? কে নেভাবেন ঘর পোড়ানো আগুন?

জাপার এক শীর্ষনেতা প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, নির্বাচনে ভরাডুবি-পরবর্তী দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীর চলমান বিক্ষোভের আবহে চরম অস্থিরতা চলছে জাপায়। দলের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জি এম) কাদের এবং প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদপন্থিদের মধ্যে বিভক্তি এখন স্পষ্ট। নির্বাচন কেন্দ্র করে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে এরই মধ্যে জাপার জ্যেষ্ঠ নেতা ও কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ এবং দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায়কে দলের সব পদণ্ডপদবি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। রওশন এরশাদের নেতৃত্বে পৃথক জাপা গঠনেরও সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে জানান তিনি।

চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের ‘স্বেচ্ছাচারিতার’ প্রতিবাদে গত বৃহস্পতিবার জাপা ঢাকা মহানগরী উত্তরের সহস্রাধিক নেতাকর্মী আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে দল থেকে পদত্যাগ করেছেন। সদ্য অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে নানা ইস্যুতে দলে অস্থিরতা চলমান। এ গণপদত্যাগ সেই অস্থিরতারই বহিঃপ্রকাশ। ১৯৯০ সালে রাষ্ট্রক্ষমতা হারানোর পর থেকে দলটিতে ভাঙা-গড়া চলছে। আবারও ভাঙনের মুখে সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের দল জাপা।

দলটির বর্তমান ও সাবেক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভাঙনের ইতিহাস এ দলে নতুন নয়। সবসময় কোনো না কোনো ইস্যুতে দলটিতে অস্থিরতা লেগেই থাকে। একসময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও দলে ভাঙন ঠেকাতে পারেননি। দিন দিন মূলধারার জাপায় ভেতরের সংকট আরো মাথাচাড়া দিয়েছে। ছোট ছোট দল আর উপদলে বিভক্তি-কোন্দল বাড়ছে দলটিতে। জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাপা মূলধারা হিসেবে পরিচিত। এ ধারায় এখন কয়েকটি উপধারা সৃষ্টি হয়েছে। দেবর-ভাবির মধ্যে নেতৃত্বের কোন্দলে রওশনপন্থিরা পৃথক দল গঠনের চেষ্টায় রয়েছেন। গৃহবিবাদের জেরে এ অংশ এবারের নির্বাচনেও অংশ নেয়নি।

এদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অযোগ্য নেতৃত্ব ও ভুল সিদ্ধান্তের কারণে অভিভাবকহীন হয়ে পড়া জাতীয় পার্টির তৃণমূল নেতাকর্মীদের আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ। দলীয় প্রার্থী ও তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন তিনি। এ উপলক্ষে আজ রবিবার রাজধানীর গুলশানে তার বাসভবনে পার্টির নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়েছে।

১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। বিগত ৩৭ বছর দলটির নানা ক্রান্তিকালে বারবার ত্রাণকর্তা হিসেবে দাঁড়িয়েছেন রওশন এরশাদ। প্রমাণ করেছেন তিনিই জাতীয় পার্টির যোগ্য অভিভাবক। এসব নিয়ে আবারও জাপায় ভাঙনের গুঞ্জন তীব্র। দলটির সদ্য বহিষ্কৃত নেতা ও সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম সেন্টু বলেন, ‘আমরা জাপাকে মরতে দেব না। প্রয়োজনে পৃথক দল করে জাপাকে বাঁচিয়ে রাখব।’

জাপার ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক নূরুল আমিন ব্যাপারী বলেন, এ দলের রাজনৈতিক কোনো ভবিষ্যৎ আমি দেখি না। দ্রুত সময়ের মধ্যে অনেক দলের মতো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক দলে পরিণত হবে জাতীয় পার্টি। তিনি বলেন, এরশাদ ক্ষমতা ছাড়ার পর থেকে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের ‘বি’ টিম হিসেবে কাজ করছে। মূলত আওয়ামী লীগকে সাপোর্ট দিতে গিয়ে আঞ্চলিকভাবে একসময়ের জনপ্রিয় জাপা এখন গৃহপালিত দলে পরিণত হয়েছে। তাই এ দল নিয়ে এখন আর আশার কিছু নেই।

১৯৮২ সালে সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি জাপার আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৯৯০ সালে তার পতনের পর থেকে ক্রমেই ক্ষয়িষ্ণু দলটি। ১৯৯০ সালে ৬ ডিসেম্বর এরশাদ সরকারের পতনের পর থেকে এ পর্যন্ত দলটি ছয়বার ভাঙনের মুখে পড়ে। এরশাদের জীবদ্দশায় পাঁচবার এবং তার মৃত্যুর ২ বছর পর আর একবার ভাঙে দলটি। এর বাইরে মূলধারায় এখন মূলত জি এম কাদের, রওশন এবং নির্বাচনের পর ক্ষুব্ধ অংশ এ তিন ধারা রয়েছে।

১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে দলটি ৩৫টি আসন পায়। ১৯৯৬ সালের সপ্তম সংসদ নির্বাচনে জাপার আসন কমে হয় ৩২টি। এরপর এরশাদের দলে ভাঙন ধরে। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু আলাদা হয়ে যান। ২০০১ সালের নির্বাচনে আগে বড় ভাঙনের শিকার হয় দলটি। নাজিউর রহমান মঞ্জুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) নামে দল গঠন করে। এ অংশের নেতৃত্বে এখন রয়েছেন আন্দালিব রহমান পার্থ।

এরশাদের পুরোনো রাজনৈতিক সহকর্মী কাজী জাফর আহমেদ দলটিতে ভাঙন ধরান। অষ্টম সংসদ নির্বাচনে ৭ শতাংশের কিছু বেশি ভোট পায় দলটি, আসন কমে হয় ১৭টি। পরের তিনটি নির্বাচনে জাপা অংশ নিয়েছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে। দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ যেসব আসনে ছাড় দিয়েছে, শুধু সেখানেই জিতে আসতে পারছেন লাঙ্গলের প্রার্থীরা। এরশাদের মৃত্যুর পর তার সাবেক স্ত্রী বিদিশা জাতীয় পার্টি পুনর্গঠনের ঘোষণা দেন।

জাতীয় পার্টি হিসেবে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিবন্ধন রয়েছে চারটি দলের। এগুলো বিভিন্ন সময় ভাঙনের পর খণ্ড-জাপা। এরশাদের নেতৃত্বাধীন মূল অংশটি লাঙ্গল প্রতীকে ইসিতে নিবন্ধিত। এছাড়া আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জেপি নিবন্ধিত বাইসাইকেল প্রতীক নিয়ে; নাজিউর রহমান মঞ্জুর বিজেপি নিবন্ধিত গরুর গাড়ি প্রতীক নিয়ে; ডা. এম এ মুকিতের নেতৃত্বাধীন কাঁঠাল প্রতীকের বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির নিবন্ধন রয়েছে। কাজী জাফর আহমদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি ও বিদিশার নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিসহ আরেকটি অংশের নিবন্ধন নেই।

জানা গেছে, রওশন এরশাদকে সামনে রেখে আলাদা দল গঠনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন জাতীয় পার্টির একাংশের নেতারা। সেই লক্ষ্য নিয়ে চলছে রওশনপন্থি সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির তৎপরতা। প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে দেশের সব জেলা ও উপজেলায় নিয়মিত যোগাযোগ চলছে। নির্বাচনে দলের ভরাডুবির পর ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের অনেকেই এখন রওশনপন্থিদের সঙ্গে আছে। তারা জি এম কাদেরপন্থিদের বাদ দিয়ে দল পুনর্গঠনের তাগিদ দিচ্ছেন।

দল পুনর্গঠনের বিষয়ে রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব ও সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য সচিব গোলাম মসীহ বলেন, ‘আমরা নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়া থেকে সরে যাইনি। সংগঠিত হচ্ছি। জি এম কাদের যেভাবে দল পরিচালনা করছেন, এতে জাপা ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে। এজন্য আমরা ম্যাডামের (রওশন) নেতৃত্বে এগিয়ে যেতে চাই। আগামী মাসের মধ্যে সম্মেলনের তারিখ ঠিক হবে।’ দল ভাঙার তৎপরতা নিয়ে দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, ‘জাতীয় পার্টিতে ভাঙনের কোনো আশঙ্কা নেই।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close