কাজী আবুল মনসুর, চট্টগ্রাম

  ০৭ জুলাই, ২০২২

ট্রানজিট হিসেবে বন্দর ব্যবহারের সুযোগ

ভারতের ৭ রাজ্যের সঙ্গে চট্টগ্রামে বাণিজ্য প্রত্যাশা

চট্টগ্রাম বন্দরকে কাজে লাগিয়ে উন্নতি করার ইচ্ছা ত্রিপুরার। কিন্তু নানা কারণে বন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে উঠছে না। বাংলাদেশ চাচ্ছে ভারতের সাত রাজ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য চট্টগ্রাম বন্দর কেন্দ্রিক হোক। চট্টগ্রাম চেম্বার অনেক আগে থেকে সেভেন সিস্টার রাজ্যগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে চলেছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি ভারতের কাছে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের বিষয়টি খোলামেলাভাবে তুলে ধরেন। ভারতও এ ব্যাপারে সম্মতি প্রকাশ করেছে।

সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্প্রতি ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে ত্রিপুরা ও আসাম উন্নতি করতে পারে বলেও মত ব্যক্ত করেন।

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র জানায়, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য বলে খ্যাত ত্রিপুরা, মিজোরাম, আসাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, অরুনাচল ও মেঘালয়ে বাংলাদেশি যেসব পণ্যের চাহিদা রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রেডিমেড গার্মেন্টস, ফলের রস, ইলিশ, চিপস্, কনফেকশনারি আইটেম, ড্রাই ফিশ, কটন, প্লাস্টিক ফুটওয়্যার, সেন্ডাল, প্লাস্টিক টেবিল, কিচেন ওয়্যার, জামদানি শাড়ি, কাঁচা পাট, মিনারেল ওয়াটার, চনাচুর, সস, মটর ডাল, এমএস রড, সিমেন্ট, ইট, সিআই শিট, আইসক্রিম, ইমার্জেন্সি লাইট, কনডেন্সড মিল্ক ইত্যাদি। পাশাপাশি ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো হতে বাংলাদেশে যেসব পণ্যের চাহিদা রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কয়লা, আদা, পেঁয়াজ, ড্রাই চিলি, পোলট্রি ফিড, ডিম, কাপড়, চিনি, অটো পার্টস, বিভিন্ন ফল, প্রকৌশল পণ্য, টিউবলাইট ইত্যাদি।

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সেভেন সিস্টার খ্যাত রাজ্যগুলোর ব্যবসা-বাণিজ্য না বাড়ার কারণে সীমান্ত পথে ব্যাপক চোরাচালান অব্যাহত রয়েছে। অথচ চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে এ অঞ্চলগুলো সহজে নিজেদের অবস্থান বদলাতে পারে।

সূত জানায়, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে ১১ কোটি ৮১ লাখ ৭৪ হাজার টন পণ্য ওঠানামা হয়েছে এই সমুদ্রবন্দর দিয়ে। এর আগের অর্থবছরে পরিমাণ ছিল ১১ কোটি ৩৭ লাখ ২৯ হাজার টন। আগের বছরের চেয়ে ৪৪ হাজার টন বেশি পণ্য ওঠানামা হয়েছে দেশের প্রধান চট্টগ্রাম বন্দরে। প্রতি বছর পণ্য ওঠানামার হার বাড়ছে। এর মধ্যে ভারতের সেভেন সিস্টার রাজ্যগুলোর ব্যবসা বন্দর কেন্দ্রিক করতে সরকারের উচ্চ মহল থেকে চেষ্টা চলছে। চট্টগ্রাম বন্দরকে ২১ শতকের উপযোগী হিসেবে গড়ে তোলার কাজ অনেক আগে থেকে শুরু হয়েছে। ট্রানজিটের ফলে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের ব্যবসা-বাণিজ্য চট্টগ্রাম বন্দর কেন্দ্রিক হবে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এসব রাজ্যের সঙ্গে মিয়ানমার, ভুটান ও চীনের আন্তর্জাতিক সীমানা রয়েছে। এসব অঞ্চলকে কেন্দ্র করে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারিত হলে সব দেশের ব্যবসায়ীরা লাভবান হবে। চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারে দেশের অর্থনৈতিক চেহারাও আরো পাল্টে যেতে পারে।

চট্টগ্রাম চেম্বারের উদ্যোগে কয়েক বছর আগে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যেও ব্যবসায়ীরা অবৈধ বাণিজ্যের ওপর জরিপ চালায়। তথ্যানুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, ভারত থেকে যে পরিমাণ পণ্য বাংলাদেশে আমদানি হয় তার চেয়েও বেশি পরিমাণ পণ্য অবৈধভাবে দেশে প্রবেশ করে। ঠিক একইভাবে বাংলাদেশ থেকেও অবৈধ পথে ভারতে বিপুল পরিমাণ পণ্য যায়।

এ বিষয়ে আলাপকালে চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালক মাহাফুজুল হক শাহ বলেন, সেভেন সিস্টার রাজ্যগুলোর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে চট্টগ্রাম চেম্বারের যোগাযোগ অনেক দিনের পুরোনো। চট্টগ্রাম চেম্বারের উদ্যোগে এরই মধ্যে ব্যবসায়ীদের নানা বৈঠক হয়েছে। আমরা চাচ্ছি তারা চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ব্যবসা শুরু করুক। বিশেষ করে পর্যটনের ক্ষেত্রেও বিশাল সুযোগ রয়েছে। সেভেন সিস্টার রাজ্যগুলোর চেম্বারের সঙ্গে অনেকবার আলাপ-আলোচনা হয়েছে। তারাও চাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি বাড়াতে। আমাদের রাস্তা আর চট্টগ্রাম বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়ন হলে এটি আরো ত্বরান্বিত হবে। ভারত চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে এ অঞ্চলগুলো উন্নত করতে পারে।’

বাংলাদেশের পরবর্তী দরজা বলে পরিচিত ভারতের সেভেন সিস্টার রাজ্যের অন্যতম অরুনাচল। প্রায় ৮৪ হাজার বর্গকিলোমিটারের এ রাজ্যের প্রধান প্রধান উৎপাদিত ফসল হচ্ছে ধান, ভুট্টা, গম, সরিষা, চিনি ও ডাল। ফলের মধ্যে রয়েছে আনারস, আপেল, কমলা, আঙুর। প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে রয়েছে কয়লা, চুন, পেট্রোলিয়াম পণ্য, পাথর। আসামের আয়তন প্রায় ৭৯ হাজার বর্গকিলোমিটার। প্রধান প্রধান উৎপাদিত ফসলের মধ্যে রয়েছে ভুট্টা, পাট, চিনি, তুলা। চা, রাবার কফির বনায়ন। প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কয়লা, চুন, পেট্রোলিয়াম পণ্য, লোহা, বিভিন্ন পাথর। মণিপুরের আয়তন প্রায় ২৩ হাজার বর্গকিলোমিটার। প্রধান উৎপাদিত ফসল হচ্ছে, ভুট্টা, তেল, বিভিন্ন বীজ, সরিষা, ধান, চিনি, গম। প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে রয়েছে চুনাপাথর ও ক্রোমেট। মেঘালয়ের আয়তন প্রায় ২৩ হাজার বর্গকিলোমিটার। প্রধান শস্য হচ্ছে ভুট্টা, ধান ও পাট। আছে রাবার ও কফির বনায়ন। প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে রয়েছে কয়লা, কাচ, চীনামাটি, আকরিক। মিজোরামের আয়তন প্রায় ২২ হাজার বর্গকিলোমিটার। প্রধান শস্য হচ্ছে ধান ও ভুট্টা। রয়েছে রাবার, চা ও কফির বনায়ন। প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে রয়েছে কয়লা, চুনাপাথর এবং গ্যাস। নাগাল্যান্ডের আয়তন ১৭ হাজার বর্গকিলোমিটার। এখানেও রয়েছে ধান, ভুট্টা, পাট, চিনি, কলা, আনারস, আদা, হলুদসহ বিভিন্ন পণ্যের সমাহার। রয়েছে চুনাপাথর, কয়লাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ। ত্রিপুরার মধ্যেও রয়েছে ধান, চিনি, কলা, কমলাসহ নানা প্রাকৃতিক সম্পদ।

সূত্র জানায়, এরই মধ্যে ত্রিপুরা ও আসাম বন্দর কেন্দ্রিক ব্যবসা নিয়ে অনেক এগিয়ে আছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করও সম্প্রতি ভারতীয় গণমাধ্যমকে এ রাজ্যের সম্ভাবনার বিষয়টি তুলে ধরে আলোচনা করেছেন। দ্য হিন্দু পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে জয়শঙ্কর উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভারতকে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করার বিষয়টি ভারত সরকারও সার্বিকভাবে বিবেচনা করছে। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের যে সুযোগ বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে তাতে ত্রিপুরা, আসামসহ ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close