সুন্দরবন রক্ষায় এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নিরক্ষীয় বন আমাজনকে যেমন বলা হয় বিশ্বের ফুসফুস, তেমনি বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনভূমি নামে খ্যাত সুন্দরবনও বাংলাদেশের ফুসফুস। এই ঘন বনাঞ্চল বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগেরও এক প্রতিরোধক। সুন্দরবন একটি গতিশীল ও সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের আধার। এটি বঙ্গোপসাগরের কূল ঘিরে অবস্থিত। এর বড় অংশ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এবং কিছু অংশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি অঞ্চল নিয়ে গঠিত।
কিন্তু দুঃখের বিষয় সুন্দরবনের সেই সুন্দর মুখ ক্রমেই মলিন হয়ে যাচ্ছে। ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন নানাভাবে হুমকির মুখে। প্রতিনিয়ত এর জীববৈচিত্র্য প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে। উধাও হয়ে যাচ্ছে বৃক্ষরাজি, গড়ে উঠছে চোখ ধাঁধানো রিসোর্ট, কোণঠাসা হয়ে পড়ছে বনের প্রাণীরা। সুন্দরবনের সম্পদ লুণ্ঠন করা এবং এর সুনসান স্বর্গীয় নীরবতাকে বিঘ্ন করার ইতিহাস শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকেই। পরিতাপের বিষয়, সুন্দরবনের জাতীয় সম্পদ আজ ধ্বংস হচ্ছে কিছু অসাধু এবং বিবেকহীন মানুষের যোগসাজশে। এর মধ্যে সপ্তাহখানেক আগে আগুনে পুড়ে যায় সুন্দরবনের প্রায় ৭ একর বনাঞ্চল। যদিও ওই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে ফায়ার সার্ভিস বলছে ‘বুশ ফায়ার’। কারণ যাই হোক, সুন্দরবন যে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
গতকাল শনিবার প্রতিদিনের সংবাদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, খুলনার দাকোপ উপজেলার কৈলাশগঞ্জ ও বানিয়াশান্তা ইউনিয়নে সুন্দরবন অভ্যন্তরে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে অন্তত ৩৫টি রিসোর্ট। সামাজিক মাধ্যমে নানা চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে রিসোর্টগুলো পর্যটক টানছে। পর্যটক এসব রিসোর্টে আসছেন, যত্রতত্র ঘোরাফেরা করছেন, উচ্চৈঃস্বরে গানবাজনা ও ডিজে পার্টি করছেন। ব্যবহৃত প্লাস্টিকের বর্জ্য ফেলছেন। বেশ কয়েকটি রিসোর্টে প্রতিদিনই দূরদূরান্ত থেকে পর্যটক আসছেন। তারা বনে ঢুকছেন, জ্বলন্ত বিড়ি-সিগারেট ফেলছেন। এখনো একের পর এক রিসোর্ট তৈরি হচ্ছে। তারা সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছেন। আর এসব কাজ করছেন স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে যোগসাজশে। কাউকে তারা তোয়াক্কা করছেন না। এতে বনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি তৈরি করছে। এসব রিসোর্ট স্থাপনের অনুমোদন নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। এ বিষয়ে দায় এড়াতে একে-অন্যকে দুষছে স্থানীয় প্রশাসন ও বন বিভাগ। বনের পরিবেশ, প্রাণ-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য বিবেচনায় না নিয়ে তৈরি করা এসব রিসোর্ট নানামুখী সংকট তৈরি করছে। সুন্দরবন-সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে একদিকে বন ধ্বংস হবে; অন্যদিকে বনে ঘুরতে আসা সাধারণ পর্যটকদেরও পড়তে হবে বিড়ম্বনায়। সুন্দরবনে ইকো-ট্যুরিজমের নামে যা হচ্ছে, এর মূল্য এক দিন দিতে হবে। এখনই এ বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। একটি নীতিমালা তৈরি করতে হবে, তা না হলে ইকো-ট্যুরিজম আমাদের আশীর্বাদের বদলে অভিশাপ হিসেবে দেখা দেবে।
সুন্দরবনের মধ্যে অবাধ বিচরণের বিষয়ে সুন্দরবন ভ্রমণ আইন-২০১৪ আছে। যেটা সবাই মানতে বাধ্য। কিন্তু সেই আইন কাউকে মানতে বা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও আইন প্রয়োগের কথা জানা যায় না। সুন্দরবনকে রক্ষায় এখনই যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের পাশাপাশি এই বনে মানুষের অবাধ প্রবেশে বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌ-চলাচলও নিষিদ্ধ করতে হবে। সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে যেসব অপরাধ হয়, তা প্রতিরোধে প্রশাসনকে আরো তৎপর হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে বলে আমরা মনে করি।
"