মো. কায়ছার আলী
মতামত
মায়ের ভালোবাসা অপরিসীম
‘মা কথাটি ছোট্ট অতি। কিন্তু জেনো ভাই, ইহার চেয়ে নাম যে মধুর, ত্রি-ভুবনে নাই।’ পৃথিবীতে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে সন্তান জন্ম দেন ‘মা’। একজন মানুষ ৪৫ ইউনিট ব্যথা সহ্য করতে পারে। তার বেশি ব্যথা সহ্য করা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু একজন মা প্রসবকালে ৫৭ ইউনিটের বেশি ব্যথা সহ্য করেন। বিজ্ঞানমতে, এই ব্যথার যন্ত্রণা ১০টি হাড় একসঙ্গে ভেঙে যাওয়ার চেয়েও বেশি যন্ত্রণাদায়ক। পৃথিবীতে এই কষ্ট বা ব্যথা শুধু মাই সহ্য করতে পারেন, অন্য কেউ নন। মাতৃত্বেই সব মায়া, মমতার শুরু এবং শেষ। সন্তান গর্ভে ধারণ করা মাত্রই মায়ের জীবন মৃত্যুর ঝুঁকির মুখে পড়ে যায়। দিন যত বাড়তে থাকে ঝুঁকিও তত বাড়ে। একজন মানুষের ভেতরে আরেকজন মানুষ (কখনো একাধিক) কি অসম্ভব ঘটনা। সন্তান বড় মানুষ হলে ওই মাকে আমরা বলে থাকি রত্নগর্ভা। ‘মা’ এই সুনামের অংশীদার বা ভাগীদার হতেও পারে আবার নাও পারে। ভবিষ্যৎ সব সময়ের জন্য মানুষের নিকট অজানা। সন্তান ভবিষ্যতে বড় মানুষ হবে (প্রতিষ্ঠিত) হবে কি না, ছেলে বা মেয়ে, বোবা বা অন্ধ যাই হোক না কেন, সব সন্তানই তার মায়ের কাছে সাত রাজার ধন। শ্রেষ্ঠ সম্পদ বা মানিক রতন।
সন্তান গর্ভে ধারণ করার পর যদি ওই সন্তানের বাবা মারা যান কিংবা দূরে কোথাও চলে যান তবুও সন্তান জন্মাবে। পৃথিবীর আলোর মুখ দেখবে। কিন্তু মা সন্তান গর্ভে ধারণ, নিরাপদে প্রসব এবং দুই বা আড়াই বছর পর্যন্ত মাকে ছাড়া সন্তান পরিপূর্ণ হবে না। মায়ের দুধই শিশুর জন্য পুষ্টিকর। মায়ের খাবারই সন্তানের খাবার। এ প্রসঙ্গে মার্কিন দার্শনিক ও লেখক ড. ওয়েন ডায়ার বিশ্বাসী অবিশ্বাসীদের নিয়ে চমৎকার একটি আধ্যাত্মিক গল্প লিখেছেন। মায়ের গর্ভে দুই শিশু-একজন অন্যকে প্রশ্ন করছে, ‘তুমি কি ডেলিভারির পরের জীবনে বিশ্বাস করো?’ অন্য শিশুটি বলল, অবশ্যই, সেখানে নিশ্চয়ই ভালো কিছু অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। হয়তো আমরা এখান থেকে পরে, যা হব তারই প্রস্তুতি নিচ্ছি। ননসেন্স, প্রথমজন বলল। ডেলিভারির পরে কোনো জীবন নেই। কোনো ধরনের জীবন হবে তা তুমি জানো কিছু? ‘দ্বিতীয়জন বলল, আমি ঠিক জানি না তবে হয়তো এখানের চেয়ে নিশ্চয়ই আলোকিত হবে সেই জায়গাটি। সম্ভবত
সেখানে আমরা দুই পায়ে হাঁটতে পারব, মুখ দিয়ে খেতে পারব। হয়তো আমাদের অনেক ইন্দ্রিয় থাকবে, যা এখন বুঝতে পারছি না।’
প্রথমজন বলল, পাগল নাকি? হাঁটা অসম্ভব আর মুখ দিয়ে খাওয়া হাস্যকর। অ্যাম্বিলিকাল কর্ড, যা প্রয়োজন সে অনুযায়ী আমাদের পুষ্টি দিচ্ছে। কিন্তু অ্যাম্বিলিকাল কর্ড এত ছোট তাই ডেলিভারির পরের জীবন যৌক্তিকভাবে অযৌক্তিক। দ্বিতীয়জন জোর দিয়ে বলে, আমার মনে হয় সেখানে নিশ্চয়ই এমন কিছু আছে, যা এখানকার চেয়ে ভিন্ন। হয়তো এই অ্যাম্বিলিকাল কর্ডের সেখানে আর প্রয়োজন হবে না। প্রথমশিশু, ননসেন্স, যদি সেখানে জীবন থেকেই থাকে তবে সেখান থেকে আজ পর্যন্ত এখানে ফিরে এলো না কেউ। ডেলিভারি মানে জীবন শেষ। ডেলিভারির পরের অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই নেই। শুধুই অন্ধকার আর নিস্তব্ধতা। দ্বিতীয় শিশু, ঠিক আছে, আমি জানি না, কিন্তু আমার বিশ্বাস নিশ্চিতভাবে আমি আমার মাকে দেখতে পাব। তিনি আমাদের ভালোবাসবেন, যত্ন নেবেন। প্রথম শিশু বলে ওঠে, আরে তুমি কি সত্যিকারে বিশ্বাস করো, মা বলে কেউ আছেন? হাস্যকর! তিনি যদি থাকেন, তবে এখন কোথায়?
দ্বিতীয় শিশু, তিনি সর্বত্র আছেন। আমাদের চারপাশে আছেন। আমরা তার ভেতরে। তার অস্তিত্বের মধ্যেই আছি। তিনি ছাড়া এ পৃথিবীতে আমি আসতাম না। থাকতেও পারতাম না। প্রথমজনের উত্তর, কিন্তু আমি তো তাকে দেখতে পাই না। তাই এটাই যৌক্তিক যে তিনি নেই। দ্বিতীয় শিশু বলে ওঠে, যখন তুমি নিস্তব্ধতার মধ্যে থাকো, একটু চিন্তা করে বোঝার চেষ্টা করো, দেখবে তুমি তার মাঝে থাকো, একটু চিন্তা করে বোঝার চেষ্টা কর, দেখবে তুমি তার উপস্থিতি টের পাবে। শুনবে তার ভালোবাসার কণ্ঠস্বর, বুঝবে তার অস্তিত্ব। আর বিশ্বাসের কথা নয়। কোনো সন্তান কৃতজ্ঞ আর অকৃতজ্ঞ পাঠকরা বিবেচনা করবেন? দুটো সন্তানেরই একজন মা।
আজ বিশ্ব মা দিবস। মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় মা দিবস পালিত হলেও মা দিবস হিসেবে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত ও বহুল প্রচলিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, ইতালি, তুরস্ক, বেলজিয়াম এবং অস্ট্রেলিয়াসহ আরো অনেক দেশে প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার মা দিবস পালিত হয়। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম মা দিবস পালন আলোচনায় আসে। জুলিয়া ওয়ার্ড হো শান্তির প্রতি মানুষের বিবেককে জাগ্রত করার লক্ষ্যে জুন মাসের ২ তারিখ মা দিবস পালনের আহ্বান জানান। তিনি বোস্টনে মা দিবসের আয়োজন করেন। আনা জারভিস ফিলাডেলফিয়া থেকে জাতীয়ভাবে মা দিবস অনুষ্ঠানের প্রচার শুরু করেন। জারভিস তার মায়ের দ্বিতীয় মৃত্যুবর্ষের দিনকে মা দিবস হিসেবে পালনের জন্য গির্জার অনুমতি আদায় করেন। জারভিসের মায়ের দ্বিতীয় মৃত্যুবর্ষ ছিল মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার। সেই থেকে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার মা দিবস প্রতিষ্ঠা পায়। যদিও মা দিবসে মা সম্পর্কে লিখছি, তবে মা কিন্তু এক দিনের জন্য নয়। সারা জীবনের জন্য।
সাম্প্রতিককালের দুটো ঘটনা ২০১৭ সালের ভোরের ডাক পত্রিকায় প্রকাশিত না লিখলে মায়ের মহত্ব বা মা যে কি নিয়ামত তা উপলব্ধি করতে পারব না। প্রথমটি শিরোনাম ‘সন্তানদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই সেই ভিখারি মায়ের’। শেরেবাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের হাসপাতালের চারতলায় অর্থোপেডিক বিভাগের ৪০৩ নম্বর কক্ষে বি-১৩ নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন ছিলেন ৭০ বছরের বৃদ্ধা মা মনোয়ারা বেগম। তিন পুত্র পুলিশ অফিসার ও শিক্ষিকা মেয়ের অবহেলায় ভিক্ষার পথ বেছে নিয়েছিলেন তিনি। তাদের পরিবারে একটি সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ ছিল। বিরোধ থাকতেই পারে। ওই বিরোধের জন্যই তারা তাদের মাকে অবহেলা করেছে। পত্রিকায় খবরটি প্রকাশিত হলে সারা দেশে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়। ভিক্ষা করতে গিয়ে মা মনোয়ারা বেগম পিছলে গিয়ে কোমরের হাড়গুলো ভেঙে ফেলে। তখন থেকেই তিনি বিনাচিকিৎসায় শয্যাশায়ী ছিলেন। সন্তানরা ভুল করলেও মা তাদের ক্ষমার চোখে দেখেন। কারণ তিনি যে মমতাময়ী মা। সবার ওপরে মা। কর্তৃপক্ষ বা গণ্যমান্য ব্যক্তি তাকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি সোজা সাপটা জানিয়ে দেন। তার সব সন্তানই ভালো। কোনো সন্তানের প্রতি তার অভিযোগ নেই। দ্বিতীয় শিরোনাম, ‘ছেলের হাতে মার খাওয়া শতবর্ষী মায়ের জন্য জেলা প্রশাসনের নতুন বাড়ি’। ছেলের সামান্য আঘাতে মা যখন আতঙ্কে আঁতকে ওঠে, তখন সেই মাকেই লাঠির আঘাতে জর্জরিত করেন। ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলার ডাঙ্গীপাড়া ইউনিয়নের স্থানীয় সমাজকর্মী জানান, ভাত খেতে চাওয়ায় বৃদ্ধা মাকে মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দেয় ছেলে বদিরউদ্দীন। ছেলের লাঠির আঘাতে মায়ের বাম চোখ হোঁতলে যায়। পরে খবর পেয়ে জেলা প্রশাসক ওই বৃদ্ধা মাকে জেলা সদর থেকে এসে একটি পরিত্যক্ত ঝুপড়ি ঘর থেকে উদ্ধার করে ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। মাকে নির্যাতনের অভিযোগ ছেলে ছেলে বদিরউদ্দীনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। লাঠির আঘাতে আঘাতপ্রাপ্ত হলেও তখন পর্যন্ত মায়ের ছায়াতলে ছেলেকে আগলে রাখার এক অপরিসীম ভালোবাসা সবাইকে অবাক করে দেয়। কেননা বৃদ্ধা মা তার সন্তানের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ জানাননি বরং ছেলেকে দেখার আকুতি ব্যক্ত করেন। এরই নাম স্নেহময়ী মা। মায়ের মতো আপন কেউ নেই।
ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। অন্যান্য ধর্মেও মায়ের স্থান পার্থিব সবকিছুর ঊর্ধ্বে। তবু অনেক সময় বৃদ্ধ বা অসহায় মায়ের প্রতি সন্তানের দুর্ব্যবহার করতে দেখা যায়। এমনটি শুধু অপরাধ নয়, একজন সন্তান হিসেবে জন্মকলঙ্কও বটে। মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাধ্যমে সন্তাতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশিত হয়। আসুন আমরা সন্তানরা সর্বদা চেষ্টা করি মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে। কেননা আমাদের যা কিছু সবই মায়ের অবদান। মা ছাড়া আমাদের অস্তিত্ব কখনোই কল্পনা করা যায় না। পরিশেষে ভুবনজয়ী এক মায়ের একটি উক্তি লিখে শেষ করছি- নোবেল পুরস্কারের খবর পেয়ে অমর্ত্য সেন তার মাকে সুখবরটি দেওয়ার জন্য ফোন করলে তার চির মমতাময়ী মা তাকে বলেন ‘বাবা তুমি খেয়েছ’?
লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
"