মোন্তাসির আবিদ সাবির

  ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

মুক্তমত

পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ কি ব্যর্থ

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করে লিগ অব নেশনস। কিন্তু আন্তর্জাতিক এই সংস্থাটির মাত্র দুই যুগ পূর্ণ হওয়ার আগে পৃথিবীর মানুষ প্রত্যক্ষ করে আরো একটি বিশ্বযুদ্ধ। শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয় লিগ অব নেশনস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার প্রেক্ষাপটই জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রতিষ্ঠার ভিত্তি রচনা করেছিল। ১৯৫১ সালের ২৪ অক্টোবর ৫১টি রাষ্ট্রের সনদ স্বাক্ষরের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে জাতিসংঘ। জাতিসংঘ পৃথিবীর স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর সর্ববৃহৎ সংগঠন। বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ১৯৩।

এই বিশ্ব সংস্থার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সেই সঙ্গে মানবাধিকার ও মানুষের মৌলিক স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত করা। মূলত দুটি বিশ্বযুদ্ধ এবং বিশ্বযুদ্ধের কারণে মানুষের জীবনের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার সৃষ্টি হয়েছিল, তার ভয়াবহতা অনুধাবন করেই বিশ্বনেতারা জাতিসংঘের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য পাঁচটি : যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া ও চীন। এই পাঁচটি দেশেরই রয়েছে ভেটো ক্ষমতা, যা প্রয়োগ করে রাষ্ট্রগুলো তাদের স্বার্থবিরোধী যেকোনো প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। এই ভেটো ক্ষমতার কাছে জাতিসংঘ বরাবরই অসহায়। সংস্থাটির সম্ভাবনা বিপুল, কিন্তু সাফল্য অর্জনে তার ক্ষমতা ও সুযোগ সামান্যই।

বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ। এ যুদ্ধে জাতিসংঘের নগ্ন ভূমিকা সংস্থাটির অক্ষমতার প্রশ্নটি আরো জোরালো করেছে। গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে চলছে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন। হামাসকে নিশ্চিহ্ন করার নামে সাধারণ মানুষের ওপর ভয়াবহ হামলা চালাচ্ছে বর্বর ইসরায়েলি বাহিনী। তাদের এই হামলা থেকে বাদ যাচ্ছে না নারী ও শিশু। ইসরায়েলি আগ্রাসনকে শুরু থেকেই সমর্থন দিয়ে এসেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের বাণী আওরানো যুক্তরাষ্ট্রের বিবেককে নাড়া দিচ্ছে না এই গণহত্যা। এই পরিস্থিতিতে যে সংস্থাটির সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখার কথা ছিল, সে জাতিসংঘের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রয়েছে শুধু বিবৃতির ভেতর। নির্বিচারে প্রাণ হারাচ্ছে হাজারো নিরীহ নারী-শিশু আর জাতিসংঘ নীরবে দেখছে বিষয়গুলো কারণ যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশ্যে সমর্থন রয়েছে ইসরায়েলি আগ্রাসনে। আর যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বাইরে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা সংস্থাটির নেই। তাহলে এমন বিশ্ব সংস্থার বর্তমানে প্রয়োজনীয়তা আসলে কতটুকু? ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্ব গড়ার প্রত্যয় নিয়ে গড়ে ওঠা আন্তর্জাতিক সংস্থাটি অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার সাধারণ মানুষের মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন রোধ করতে পারছে কি?

আরেকদিকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য দেশ রাশিয়া ৪ কোটি ৪০ লাখের মানুষের স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশ ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করে ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারিতে। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ইউক্রেন এবং দিন দিন দেশটির পশ্চিমা দেশগুলোর ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে- বিশেষ করে ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের। রাশিয়ার এই সামরিক আগ্রাসনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ইউক্রেন যেন ন্যাটোতে যোগ না দেয়, যাতে করে রাশিয়া ইউক্রেনে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে পারে। দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা এই যুদ্ধে ইউরোপে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় অভিবাসী সংকট তৈরি করেছে। ইউক্রেনের সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে এসেছে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। জাতিসংঘের তথ্য মতে, প্রায় ১১ হাজার বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে এই যুদ্ধে। দুই বছর শেষ হয়ে তৃতীয় বছরে পদার্পণ করেছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ কিন্তু এখনো যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

আজ থেকে প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় আগে শুরু হওয়া সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ এখানো চলমান। গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে শুরু হলেও, বিদেশি শক্তিরা জড়িত হয়ে সর্বাত্মক যুদ্ধের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। শুধু ফিলিস্তিন আর সিরিয়া নয় পুরো মধ্যপ্রাচ্য আজকে সংকটের সম্মুখীন। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নির্যাতন ও নিপীড়নের হাত থেকে বাঁচার জন্য ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট প্রায় ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী এই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনেও জাতিসংঘ ব্যর্থ হয়েছে।

জাতিসংঘ কি আদৌ পৃথিবীর বৃহৎ শক্তিধর দেশগুলোর স্বার্থের বিপক্ষে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে? নাকি বৃহৎ শক্তিধর দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষার জন্য সংস্থাটি ব্যবহৃত হয়ে এসেছে? তারা পারছে না আমাদের জন্য একটা নিরাপদ বিশ্ব উপহার দিতে। তারা পারছে না আগামী দিনের শিশুর জন্য বিশ্বকে বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে। কিন্তু জাতিসংঘের উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ববাদের বিনাশ ঘটিয়ে সবার সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা।

লেখক : শিক্ষার্থী, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close