তাপস হালদার

  ১৬ এপ্রিল, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

‘ইন্ডিয়া বয়কট’ বিএনপির রাজনৈতিক স্ট্যান্ট

ইন্ডিয়া বয়কট প্রচারণা নিয়ে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে বিএনপি। দলটির যুগ্ম মহাসচিব ও মুখপাত্র রিজভী আহমেদ ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে নিজের গায়ের চাদর ছুড়ে ফেলে দেন এবং সঙ্গে থাকা নেতাকর্মীরা চাদরটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়।

এ ঘটনায় প্রমাণ হলো রিজভী সাহেব এত দিন ভারতীয় চাদর গায়ে জড়িয়ে ছিলেন। যদিও তার পাঞ্জাবি ও পাজামা কোথাকার সেটা এখনো জানা যায়নি। বিএনপির অন্য সিনিয়র নেতারা ভারত বর্জনকে রিজভী সাহেবের ব্যক্তিগত মত বললেও তারা ইনিয়ে-বিনিয়ে বক্তব্যকে সমর্থন করে যাচ্ছেন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করার পরই প্রকাশ্যেই ভারত বিরোধিতায় নামে বিএনপি। শুরুতে তাদের জোটের কিছু ভুইফোঁড় নেতা ইন্ডিয়া বয়কট স্লোগান তুললেও পেছন থেকে মদদ দিয়েছে বিএনপি। কিন্তু এবার সরাসরি ভারত বিরোধিতায় নেমেছে দলটি।

বিএনপি মনে করে নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা সরকারের ওপর যে চাপ সৃষ্টি করেছিল তারপরও আওয়ামী লীগ নির্বাচন করতে পেরেছে ভারতের সমর্থনে। নির্বাচন ইস্যুতে যখন পশ্চিমা বিশ্ব আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর স্যাংশনসহ বিভিন্ন ধরনের হুমকি-ধমকি দিয়েছিল, তখন বিএনপি জোট বিদেশিদের আশায় একপ্রকার দিবাস্বপ্ন দেখেছিল।

কিন্তু ভারতের স্পষ্ট বক্তব্য ছিল, ‘নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়, বাংলাদেশের জনগণই ঠিক করবে কারা দেশ পরিচালনা করবে।’ এরপরই পশ্চিমাদের দৌড়ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যায়। বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার আশাভঙ্গ হয়। বিএনপি জোটের ধারণা, ভারতের দৃঢ় অবস্থানের কারণে পশ্চিমাদের চাপ উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় এসেছে। ভারতের সমর্থনের কারণে নির্বাচন প্রক্রিয়া সহজ হয়েছে সত্য, কিন্তু আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার নিয়ামক ছিল দেশের জনগণ।

বিএনপি মুখে যতই ভারত বিরোধিতা করে থাকুক, বাস্তবে দেখা গেছে বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনের আগে ভারত সরকারের আনুকল্য পেতে অনেক দৌড়ঝাঁপ করেছে। কিন্তু বিএনপি একটি সাম্প্রদায়িক দল ও জঙ্গিগোষ্ঠীর মদদদাতা হওয়ার কারণে বারবার ভারত তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ২০০১ সালে ভারতের সমর্থনে বিএনপি ক্ষমতায় এসে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী ও জঙ্গিদের করিডর করার সুযোগ দিয়েছে। উলফাদের কাছে পাঠানো দশ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধারের পর স্পষ্ট হয়ে যায় পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতায় ভারতকে অস্থিতিশীল করতে চায় বিএনপি-জামায়াত জোট। এরপর থেকে আর বিএনপিকে বিশ্বাস করতে চায় না ভারত।

বিশ্বায়নের যুগে একটি দেশ থেকে আরেক দেশকে পৃথক রাখা যায় না। পুরো বিশ্বই একটি পরিবার। আর ভারত তো বাংলাদেশের সবচেয়ে নিকট প্রতিবেশী। বাংলাদেশের তিন দিক ঘিরে ভারতের ভৌগোলিক অবস্থান। এমন একটি বৃহৎ দেশের সঙ্গে পণ্য বর্জনের আহ্বান রাজনৈতিক ভণ্ডামি ছাড়া কিছু নয়। বাংলাদেশে ভারত বিরোধিতা নতুন কিছু নয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই এ দেশে ভারত বিরোধিতা ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি চলছে। আর বিএনপি তো জন্মলগ্ন থেকেই ভারতবিরোধী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী একটি সাম্প্রদায়িক দল। পাকিস্তানপ্রীতি-সাম্প্রদায়িকতা দলটির মূল ভিত্তি। ভারত বিরোধিতাই তাদের রাজনৈতিক পুঁজি।

পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে দীর্ঘকাল জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়া ভারতীয় জুজু তৈরি করে নির্বাচন করে ক্ষমতায় এসেছে। ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়া বিভিন্ন জনসভায় ভারতীয় জুজু ও সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক কার্ড ব্যবহার করেছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ ভারতের দালাল, এরা ক্ষমতায় গেলে ভারতের কাছে দেশ বিক্রি করে দেবে। দেশ ভারত হয়ে যাবে। দেশে কোনো মসজিদ থাকবে না, সব মসজিদ মন্দির হয়ে যাবে। মসজিদ থেকে আজানের পরিবর্তে উলুধ্বনি প্রচারিত হবে’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

বাংলাদেশের পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে চীনের পরই ভারতের অবস্থান হলেও গুরুত্বের দিক থেকে ভারতই প্রথম। কারণ নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের বাজার অনেকটাই ভারতের ওপর নির্ভরশীল। ভোক্তা বাজারে যেটা সহজ দামে পাবে সেটাই কিনবে, এখানে পণ্য কোথা থেকে এসেছে সেটা বিবেচ্য নয়। ভারত থেকে গত বছরে ১৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়েছে, যা মোট আমদানির প্রায় ২০ শতাংশ। পার্শ্ববর্তী দেশ হওয়ার কারণে পণ্য আমদানিতে ২০-৪০ শতাংশ ব্যয় কম হয়। সড়কপথে আনা যায় বলে কম হয় পরিবহন ব্যয়। এই কারণে চাল, ডাল, চিনি, পেঁয়াজ, আদা, রসুনসহ ভোগ্যপণ্য সাশ্রয়ী মূল্যে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড গার্মেন্টশিল্পের কাঁচামাল তুলার অধিকাংশই ভারত থেকে আমদানি করতে হয়। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের ওয়েবসাইটের তথ্য মতে, ভারত থেকে গত অর্থবছরে ৯৭ ধরনের পণ্য বাংলাদেশ আমদানি করেছে। তালিকায় প্রথমেই রয়েছে তুলা, সুতাসহ পোশাক খাতের কাঁচামাল। দ্বিতীয়ত তেল ও অন্যান্য খনিজ জ্বালানি এবং তৃতীয়ত খাদ্যশস্য। ভারত যদি কোনো পণ্য রপ্তানি বন্ধ করে দেয়, এখানে ক্রাইসিস হবে, পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। পেঁয়াজ কিংবা চিনি যখন ভারত রপ্তানি বন্ধ করে দেয়, তখনই বাংলাদেশে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। যারা ভারতীয় পণ্য বর্জনের জিগির তুলেছে তারা সুপরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের বাজারকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা করছে। বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাজারে পণ্যের দাম স্বাভাবিকভাবেই বেশি। এমন সময় ভারতের সঙ্গে পণ্য আমদানি ও বর্জনে বাধা সৃষ্টি করে বাজার অস্থিতিশীল করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার অপচেষ্টা করছে বিএনপি।

বাংলাদেশের বিরাটসংখ্যক মানুষ ভালো মানের সাশ্রয়ী চিকিৎসার জন্য ভারতে যায়। ভারত বর্জনের জুজুর কারণে ভিসাব্যবস্থা কঠিন করলে অনেক মানুষ চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হবে। প্রতি বছর ঈদ, পূজাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পোশাক কেনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্তদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু থাকে ভারতের কলকাতা। দেশের বাজারগুলোও ছয়লাব হয়ে যায় ভারতের পোশাকে। ভারতের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র, সিরিয়ালের নায়ক-নায়িকাদের নামে তৈরি এসব পোশাক কিনতে ভিড় লেগে যায়।

বিএনপি নেতাদের দ্বিচারিতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা যথার্থই বলেছেন, ‘বিএনপি নেতাদের বলব, আপনাদের বউদের আলমারিতে যে কয়টা ভারতীয় শাড়ি আছে সব এনে যেদিন ওই অফিসের সামনে পোড়াবেন সেদিন বিশ্বাস করব যে, আপনারা সত্যিকার ভারতীয় পণ্য বর্জন করলেন। ভারত থেকে আমরা গরম মসলা, আদা-রসুন, পেঁয়াজ আমদানি করি, মিজোরাম থেকে মসলাপাতি আসছে। বিএনপি নেতাদের কারো পাকের ঘরে যেন এই ভারতীয় মসলা দেখা না যায়। তাদের রান্না করে এসব খেতে হবে মসলাবিহীন।’ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর একজন বিএনপি নেতাকেও চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। তার মানে হলো, সবাই ভারতীয় পণ্যই ব্যবহার করছে, আর মুখে শুধু ফাঁকা আওয়াজ ছাড়ছে।

বিগত ১৫ বছরে বিএনপির একটি গ্রুপ ভারতের আনুকল্য পেতে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আবার দলেরই আরেকটি গ্রুপ ভারত বিরোধিতায় থাকে মুখর। ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশন আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিএনপি নেতারা দলে দলে উপস্থিত হয়েছিলেন। আবার বিএনপির ইফতার পার্টিতে ভারতীয় কূটনীতিকদের দাওয়াত দিয়েছে। বিএনপির এটা দ্বিচারিতা। ওপরে ভারত বিরোধিতার গর্জন, তলে তলে তোষণ। বিএনপির ইন্ডিয়া বয়কট কিংবা ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহ্বান রাজনৈতিক স্টান্টবাজি ছাড়া কিছু নয়।

লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য

সম্প্রীতি বাংলাদেশ

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close