এ এফ এম ফৌজি চৌধুরী

  ০৮ এপ্রিল, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

ঈদ হোক সম্প্রীতির উৎসব

ঈদ এমন একটি উৎসব, যেখানে রয়েছে ধনী-দরিদ্র, ফকির-আমীর- সব মানুষের এক কাতারে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা। ধর্মীয় উৎসব, সামাজিক উৎসব, সব ধরনের উৎসবের মধ্যে রোজার ঈদ উৎসব শ্রেষ্ঠ উৎসব। এই উৎসব সর্বজনীন উৎসব। রোজার শুরুতেই হয় ঈদ উৎসব পালনের আয়োজন। চারদিকে যত হাহাকার, যত অভাব-দুঃখ, যত দরিদ্রতা থাক না কেন, ঈদের আনন্দের জন্য মানুষও পাগল। একটি মাস সিয়াম সাধনার পর সমগ্র বিশ্বের মুমিন মুসলমান শাওয়ালের চাঁদ দেখে আনন্দে বিভোর হয়। মানুষের জীবনে ভোগবিলাসিতা চাওয়া-পাওয়ার অন্ত নেই। এই অসীম চাওয়া-পাওয়ার ভোগ লালসাকে চরিতার্থ করার সুদীর্ঘ এগারোটি মাস পর আসে শাওয়ালের চাঁদ। মানুষের লাগামহীন জীবনকে সংহত করে, সংযত করে, শুদ্ধ করে ঈদের আনন্দে হয় মানুষ বিভোর। এই আনন্দের পবিত্রতা, মাহাত্ম্য এবং মহিমা নিঃসন্দেহে অতুলনীয়। দীর্ঘ ত্রিশ দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পানাহারের পর বিরত থেকে ও সংযম পালন করে ঈদের আনন্দ না করে মানুষ পারে না। এই কঠোর সংযম সাধনার বিধান ইসলাম ছাড়া পৃথিবীতে আর অন্য কোনো ধর্মে নেই। আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে যারা রমজান মাসের প্রথম তারিখ থেকে শেষ তারিখ পর্যন্ত রোজা রেখেছেন, তারা সেই দিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে যাবে। নিরন্ন বুভুক্ষু দরিদ্র পথের ফকির দৈনন্দিন জীবনে কি দুঃসহ কষ্ট সহ্য করে, রমজানের রোজাদাররা সেই কষ্ট হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারে। নিজে উপোস থেকে উপবাসীর দুঃখ তারা মর্মে মর্মে বুঝতে পারে। তাই ক্ষুধার্থের মুখে খাবার তুলে না দিয়ে ইফতার করতে তাদের রুচিতে বাধে, সাহরি তাদের মুখে রোচেনা।

এভাবে ক্ষুধাতুর-তৃষ্ণাতুর, অন্নহীন ও বস্ত্রহীনের প্রতি কর্তব্যবোধ জাগিয়ে এবং শারীরিক ও মানসিক সংযম শিক্ষা দিয়ে মুসলমানদের সাধনার পর ঈদুল ফিতর এসে যেন নব জীবনের আনন্দ গান শোনায়। প্রাণের তারে তারে সঞ্চার করে চির জাগরণের অমর মূর্ছনা। সঞ্চারিত করে অন্তরে অন্তরে নতুন এক প্রেরণা। মৈত্রী, ঐক্যবোধ, বিশেষ করে ত্যাগের আহ্বান, মহা-আহ্বান বেজে উঠে প্রতিটি অন্তরে। ঈদের আনন্দের এই মহান সুন্দর ও সৃজনশীলরূপ গৌরবে ও মহিমায় মানুষের বিত্ত এবং চিত্তকে সাহসী ও বলীয়ান করে তোলে। ঈদের আনন্দের ধ্বনি যেন এই ঘোষণাই করে মানুষই শ্রেষ্ঠ। জীবনই প্রধান এবং বাঁচার মতো বাঁচাই কাম্য। এক মাসের উপবাস ভাঙার এই ঈদ উৎসব মানুষের জীবন বিকাশের সবগুলো রীতিনীতি, আইনকানুন উপলব্ধি করার সুযোগ দিয়েছে। আত্মার বিকাশের জন্য এই সুযোগের সৎ ব্যবহার করলে মানুষের মনে কোনো কলুষতা থাকবে না। এই আনন্দ উৎসব কোনো অঞ্চল, স্থান বা গোত্রের উৎসব নয়।

এই আনন্দ উৎসব হচ্ছে উম্মাহকেন্দ্রিক মহাজাতীয় উৎসব, জাতীয় আনন্দ ও জাতীয় খুশি। তাই এর গুরুত্ব অপরিসীম, ব্যাপক ও গভীর। ঈদ উৎসবের মধ্য দিয়েই প্রতিটি মুমিন দিকনির্দেশনা পেতে পারে। রোজা শেষে ঈদের দিন থেকেই রোজার আদর্শে গঠিত জীবনকে আমরা বাস্তবে রূপদান করার কাজে সচেষ্ট হতে পারি। অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে মাসব্যাপী রমজান মাসের রোজা না রাখলে ঈদের খুশির মর্যাদা এবং আনন্দ যথাযথভাবে উপলব্ধি করা যায় না। রোজা এবং ঈদ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। রোজাকে বাদ দিয়ে ঈদের আনন্দের স্বাদ পাওয়া যায় না। রোজা না রেখে ঈদের সার্থকতা নেই। কষ্ট ও সাধনার মাধ্যমে যা কিছু অর্জন করা অনেক বেশি আনন্দের। ঈদের আনন্দ হচ্ছে জাতীয় মহত্ত্ব ও সংহতির প্রতীক। ঈদ আমাদের মিলন ঘটায়। ভ্রাতৃত্ব ও সংহতির শিক্ষা দেয়, সৌন্দর্যবোধ, গৌরবের প্রকাশ ঘটায়। আমাদের স্বকীয়তাকে উজ্জীবিত করে এবং চেতনাবোধ প্রখর করে তোলে। তাই ঈদ আমাদের ব্যক্তিজীবনে, জাতীয় জীবনে বয়ে আনে কল্যাণের সওগাত। ঈদের প্রকৃত রূপ ফুটিয়ে তোলে আধ্যাত্মিকতা। পরিমিত ভোগ, আনন্দ, ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসায় পুরুষ-নারী, যুবক-বৃদ্ধ, দুঃখী-দরিদ্র সবাই এতে অংশ নিতে পারে। অসচ্ছল শ্রেণি যাতে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারে, তার জন্য সচ্ছল শ্রেণি জাকাত আর ফিতরা আদায়ের মাধ্যমে এগিয়ে আসে। জাকাত-ফিতরার মাধ্যমে রোজার যেমন ক্ষতিপূরণ হবে, তেমনি দরিদ্র জনগণের ঈদে ব্যয় নির্বাহে সাহায্য হবে। ঈদ হচ্ছে সামাজিক ও জাতীয় উৎসব। গোটা সমাজ এই ঈদের মাসে সম্পৃক্ত। ইসলামের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভের মধ্যে জাকাত একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। জাকাত অর্থ পবিত্রতা এবং পরিচ্ছন্নতা। নিজের ধন-সম্পত্তি আল্লাহর রাস্তায় তথা গরিব-মিসকিনদের মধ্যে বিতরণ করে সব ধন-সম্পত্তি এবং সেই সঙ্গে তার নিজের আত্মার পরিশুদ্ধি হয়ে থাকে। যে ব্যক্তি অগাধ ধন-সম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও গরিব-মিসকিনদের দান করে না, সেই ব্যক্তি স্বার্থপর। তার আত্মা পঙ্কিল, পবিত্র কোরআনে যতবার নামাজের কথা বলা হয়েছে, ততবারই জাকাতের কথা বলা হয়েছে। জাকাত গরিবদের হক। রোজা রাখা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্যও ভালো। এ মাসে নির্দিষ্ট সময়ে আহার করতে হয়। দিনে দুবার প্রধান আহারের মাঝখানে বারো থেকে ষোলো ঘণ্টার মতো বিরতি দিতে হয়। এর ফলে পরিপাকতন্ত্র শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং মানুষ অনেক রকম পেটের পীড়া থেকে রেহাই পায়। তা ছাড়া ক্ষুধা এবং তৃষ্ণা কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা হয়। এতে মানুষ ধৈর্যশীল হয়ে ওঠে এবং চারিত্রিক দৃঢ়তা অর্জন করে। মেজাজের দিক থেকে নমনীয় ও বিনয় হয়। রমজান মাস আত্মসংযমের মাস, আত্মশুদ্ধির মাস, আত্মত্যাগের মাস। মাগফিরাতের মাস, বরকতের মাস ও সৌভাগ্যের মাস। সারা মাস সিয়াম সাধনার পর আসে ঈদুল ফিতরের আনন্দ। আবার ঈদ এলো। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সাধারণ ছবির মধ্যে ফুটতে শুরু করেছে রঙিন বিভা। ঈদ মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। আনন্দের উৎসব। এ আনন্দ সম্প্রদায় নির্বিশেষে সব মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারার মধ্যেই ঈদ উৎসবের সার্থকতা। মানুষে মানুষে ব্যবধান ঘুচিয়ে দেওয়ার বার্তা বয়ে আনে ঈদ। কিন্তু এ আনন্দের মধ্যেও চারপাশের করুণ বাস্তবতা আমরা ভুলে থাকতে পারি না। ধনী নির্ধনের ব্যবধান ক্রমে বাড়ছে। ঈদের মতো সর্বজনীন উৎসবে চোখে পড়ে শত শত মলিন মুখ। এ অবস্থার নিশ্চয়ই বদল হবে। ঈদের আনন্দে তখন যোগ ঘটবে সব মানুষের। পরিশেষে ঈদের আনন্দ যেন শুধু বিত্তশীল মানুষের ভোগের বস্তুতে পরিণত না হয়, সেদিকে দৃষ্টি রাখা আমাদের সবার দায়িত্ব ও পবিত্র কর্তব্য। সমাজের অবহেলিত ও দুস্থ মুসলিম সম্প্রদায়ও যেন ঈদের আনন্দের কিঞ্চিৎ অংশীদার হতে পারে তার নিশ্চয়তা বিধান আমাদেরই কর্তব্য। কারণ আল্লাহতায়ালা বলেন, বিত্তবানদের সম্পদে অবশ্যই বিত্তহীনের অধিকার ও হক রয়েছে- সে প্রাপ্য নিশ্চয়ই তাদের পৌঁছিয়ে দিতে হবে। তবেই হবে রমজানের সার্থকথা এবং তাতেই ঈদের খুশির আনন্দ সবার মধ্যে ফুটিয়ে উঠবে। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা, ঈদ মোবারক।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close