বরকত আলী
মুক্তমত
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রুটিন হোক শিক্ষার্থীবান্ধব
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ২০২২ খ্রিস্টাব্দের স্নাতক (সম্মান) চতুর্থ বর্ষের নিয়মিত-অনিয়মিত পরীক্ষার সময়সূচি গত ২০ মার্চ প্রকাশ করেছে। আগামী ১৯ মে পরীক্ষা শুরু হয়ে চলবে আগামী ১১ জুন পর্যন্ত। পরীক্ষার সময়সূচি এমনভাবে করা হয়েছে যে একটি পরীক্ষা দেওয়ার পর পরবর্তী পরীক্ষার মধ্যে মাত্র এক দিন সময় হাতে পাওয়া যাবে এবং বলা যায় কোনো পরীক্ষার আগেই একদিনের বেশি বন্ধ নেই। এমন রুটিন পাওয়ার পর প্রতিক্রিয়ায় চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষের কথা জানিয়েছে এবং একই সঙ্গে এমন অদ্ভুতুড়ে পরীক্ষার সময়সূচি পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছে।
স্নাতক (সম্মান) শেষ বর্ষের রুটিন অনেকটা তড়িঘড়ি করেই প্রকাশ করেছে বলা যায়, কারণ রুটিনে ২৩ মের পরীক্ষার তারিখ ২০২৫ সালের ২৩ মে হিসেবে দেখা যায়। পরীক্ষার রুটিনে এমন ভুল দেখার পর তা মুহূর্তেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হয় এবং বিষয়টি নিয়ে নেটিজেনরা নানাভাবে ট্রল করতে থাকে। চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষার্থীরা রুটিনে এমন ভুল পেয়ে কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছিল যে অন্ততপক্ষে এই ভুল সংশোধনের জন্য হলেও রুটিন পরিবর্তন করবে জাতীয় বিশ্বিবদ্যালয়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ পরীক্ষার্থীদের আশা ভঙ্গ করে শুধু ২৩ মে, ২০২৫-এর জায়গায় ২৩ মে, ২০২৪, এতটুকু পরিবর্তন করে খুব দ্রুতই নতুন রুটিন প্রকাশ করে। ইতিপূর্বেও অনেক বিজ্ঞপ্তিতে এ রকম ভুল দেখা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর যদি এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল চোখে পড়ে এবং পরে সংশোধন করে পুনরায় প্রকাশ করতে হয়, তা সত্যিই দুঃখজনক। আর এমন অনেক কারণেই জাতীয় বিশ্বিবদ্যালয় সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গত জানুয়ারির ২২ তারিখে মাস্টার্স ২০২১ খ্রিস্টাব্দের পরীক্ষায় কোনো বিরতি না দিয়ে, টানা প্রতিদিন পরীক্ষা এমন একটি রুটিন প্রকাশ করে। সে সময় পরীক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়ার মুখে রুটিনটি পরিবর্তন করে পুনরায় প্রকাশ করে। পরে মার্চ মাসের শুরুর দিকে একইভাবে অনার্স তৃতীয় বর্ষ ২০২২ খ্রিস্টাব্দের পরীক্ষায় দুই পরীক্ষার মাঝে মাত্র এক দিন করে বন্ধ দিয়ে রুটিন প্রকাশ করে। এই রুটিন-ও পরীক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে খুব দ্রুতই পরিবর্তন করে নতুন রুটিন প্রকাশ করে বিশ্বিবদ্যালয়টি। তবে পরীক্ষার্থীদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও অসন্তোষ থাকার পরও বিশ্বিবদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেশনজট কমানোর দোহাই দিয়ে স্নাতক শেষ বর্ষের রুটিন আপাতত পরিবর্তন করা হচ্ছে না জানিয়ে দিয়েছে। দুই থেকে তিন দিন করে বন্ধ দিলে সর্বোচ্চ দেড় মাসের মতো লাগবে চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা শেষ হতে। এই দেড় মাসেই কি সেশনজট মুক্ত হয়ে যাবে- এমন প্রশ্ন পরীক্ষার্থীদের। শেষ বর্ষের রুটিন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির এমন অযাচিত সিদ্ধান্ত ও শেষ বর্ষের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ মোটেই কাম্য নয়।
প্রতিটি শিক্ষার্থীর জীবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষ বা চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। জাতীয় বিশ্বিবদ্যালয়ে চতুর্থ বর্ষেই সবচেয়ে বেশি সাবজেক্ট এবং সর্বোচ্চ ক্রেডিট, যা প্রায় অনার্স প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের গড় ক্রেডিটের সমান বলা যায়। ফলে এই ফলাফল শিক্ষার্থীদের সামগ্রিক ফলাফলেই প্রভাব ফেলবে। এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি পরীক্ষায় এক দিনের ছুটিতে বিশাল সিলেবাস রিভিশন দিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা অকল্পনীয় ব্যাপার। আর শেষ বর্ষে কোনো পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে শুধু এই পরীক্ষার জন্য দীর্ঘ এক বছর অপেক্ষা করতে হবে এবং আশানুরূপ ফলাফল না পেলে পরে পরীক্ষা দিয়ে-ও ফলাফল ভালো করার সুযোগ থাকছে না। ফলে শিক্ষার্থীরা পর্যাপ্ত প্রস্তুতির অভাবে পরীক্ষায় প্রত্যাশিত ফলাফল না পেয়ে চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর দায় কে নেবে?
সারা দেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়টির বোর্ড পরীক্ষা হয় জেলা শহরের কলেজগুলোতে। ফলে অনেক শিক্ষার্থী প্রত্যন্ত অঞ্চল ও দূরদূরান্ত থেকে জেলা শহরে পরীক্ষা দিতে আসে। তাই স্বাভাবিকভাবেই পরীক্ষার দিন পুরোটাই যাতায়াত এবং বিরতিহীনভাবে ৪ ঘণ্টা পরীক্ষা দিতেই শেষ হয়ে যায়। পরীক্ষার পর বাসায় পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়ার পর পুনরায় পরের পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা; যা সত্যিই কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। পরীক্ষা দিয়ে আসার পর পরীক্ষার্থীদের বিশ্রামের জন্যও একটু সময় মিলবে না। যেহেতু পরীক্ষার দিন যাতায়াত ও পরীক্ষা দিতেই শেষ হবে, সে হিসেবে পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য হাতে সময় মিলবে মাত্র ১ দিন, ১ রাত। এই স্বল্প সময়ে পুরো একটা বই রিভিশন দিয়ে পরের দিন গিয়ে আবারও পরীক্ষা দেওয়া, যা অসম্ভব হয়ে পড়বে। আর কম ছুটিতে টানা পরীক্ষা দেওয়ায় শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক চাপ তৈরি হবে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সেশনজটের কবল থেকে শিক্ষার্থীদের মুক্ত করতেই হয়তো এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। আর শিক্ষার্থীবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেশনজটসহ বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে। যার জন্য অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য বিশ্ববিদ্যালয়টি। তবে সেশনজটমুক্ত করতে চতুর্থ বর্ষ বাদে অন্যান্য বর্ষের পরীক্ষা এমন রুটিনে নিলেও খুব সমস্যা হবে না। তারা অকৃতকার্য হলে বা তাদের মান উন্নয়নের জন্য পরবর্তী বর্ষে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ থাকবে, তবে যেহেতু চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের পরে কোনো বর্ষ নেই এবং পরীক্ষা দেওয়ার কোনো সুযোগ থাকছে না, তাই পরীক্ষার মাঝে অন্তত ২ থেকে ৩ দিন বন্ধ রাখলেই পরীক্ষার্থীদের কোনো অভিযোগ থাকবে না।
এমতাবস্থায়, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ স্নাতক (সম্মান) চতুর্থ বর্ষ ২০২২ সালের পরীক্ষার সময়সূচি যতদ্রুত সম্ভব পরিবর্তন করে পরীক্ষার মাঝে অন্তত ২ দিন বন্ধ রেখে পুনরায় সময়সূচি প্রকাশ করবে। এমনটাই প্রত্যাশা সারা দেশের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের। এতে শিক্ষার্থীরা মানসিক চাপমুক্ত হয়ে সতেজ মনে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রত্যাশিত ফলাফল অর্জন করতে পারবে। আশা করছি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের কথা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে।
লেখক : শিক্ষার্থী ও কলাম লেখক
দিনাজপুর সরকারি কলেজ, দিনাজপুর
"