ওমর ফারুক

  ৩১ মার্চ, ২০২৪

মুক্তমত

একজন শিক্ষকের হাতে বহু মানবসম্পদ

১০৪ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীর সামনে হাসতে পারেন। পায়ে ব্যথা নিয়ে বাড়িতে যন্ত্রণায় থেকে ক্লাসে এসে মুচকি হেসে ক্লাস শুরু করতে পারেন। মাথার ফিনফিন ব্যথা নিয়ে সূত্র মিলিয়ে পাঠদান করাতে পারেন। পরিবার-পরিজন রেখে শ্রেণিতে ঢুকে আর একটা পরিবার গঠন করতে জানেন। নিজের স্বপ্ন চূর্ণবিচূর্ণ হলেও লুথারের ‘I have a Dream’ পড়াতে পারেন। নিজে বিরহের উত্তপ্ত আগুনে জ্বলেও বাইরনের ‘She Walks in Beauty’ আলোচনা করতে পারেন। নিজের পকেটে কাবাডি চললেও ‘How to Waste/Save Money’ আলোকপাত করতে পারেন। নিজের জীবনে যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে টেনিসনের ‘The Charge of the Light Brigade’ আবৃত্তি করতে পারেন।

স্ব-স্ব বিস্তারিত অজনা-অচেনা-অদেখা টপিক নিয়ে কথা বলতে বলতে শিক্ষার্থীদের মজা দিতে জানেন। শিক্ষকরা অনেক কিছু আড়াল করতে পারেন মিথ্যা হাসির অন্তরালে! নিজের সহস্র কষ্ট ভুলে গিয়ে স্টুডেন্টকে সাত আসমান ঘুরিয়ে আনতে পারেন। তবে আমরা কী কখনো এমন প্রশ্ন করেছি? স্যার আপনার শরীর কেমন? আপনার মন ভালো? বাড়িতে সবাই সুস্থ ও ভালো আছেন? সকালে নাশতা হয়েছে কী স্যার? আপনার জায়গাজমি নিয়ে সমস্যাটা সমাধান হয়েছে? আপনার দিনকাল সুন্দর যাচ্ছে? স্যার আজ কী আমাদের সঙ্গে দুপুরে একসঙ্গে খাওয়া যাবে? স্যার রাতে কি একসঙ্গে আড্ডা দেওয়া যাবে? আপনার না বলা কথাগুলো আমাদের বলা যাবে? আপনি কীভাবে এতদূর এসেছেন আমাদের শোনাবেন? আপনার অনুপ্রেরণা কী কী, কারা ছিল? আপনি কী আমাদের মন খুলে বলতে পারবেন? আমরা কিছু শিখতে পারব না আপনার জীবন থেকে?

না বলিনি এমন কখনো! স্যার আমাদের আপনার কাছের মনে করে সবকিছু বলতে পারবেন। আমরা আপনারই সন্তান, ভাই, বোন ও পরিবার। আমাদের মানুষ করার জন্য আপনার ছেলেমেয়েকে আদর করতে পারছেন না। আমরা আপনার সন্তানসন্ততি। দিনের বেশির ভাগই সময় আমাদের উজাড় করে দিচ্ছেন। আমাদের দেশের দক্ষ মানবসম্পদে তৈরি করতে কাজ করে যাচ্ছেন। বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলকনিতে হাঁটতে পারার সুযোগ করে দিচ্ছেন। ভিন দেশে হায়ার এডুকেশন করতে তৎপর করছেন। জাতিকে নেতৃত্ব দিতে পারার ক্ষমতা করে দিচ্ছেন। আপনিই তো জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ স্যার। আপনিই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মনের মানুষ স্যার।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক, খ, গ, ঘ পড়িয়েছেন। মকতবে আলিফ-বা পড়িয়েছেন। মন্দিরে জ্ঞান দিয়েছেন। ধর্মীয় এলমে পরিপূর্ণ করেছেন আমাদের। মাধ্যমিকে দুনিয়াকে চিনতে কত কিছু করেছেন। নিজের সন্তানের মতো আদর-যত্ন করেছেন। নিজের ছেলেমেয়ের মতো আঁকড়ে রেখেছেন। কখনো শাসন করে, কখনো বকা দিয়ে ও কখনো বেতের আঘাত করে।

শিক্ষক-শিক্ষিকা একমাত্র শ্রেণি, যারা অন্যের সন্তানের উন্নতিতে হাসেন। অন্যের অগ্রগতিতে হাত তালি দেন। অনেক বছর পর দেখা হলে ভালো কিছু করে বললে বুকে টেনে নেন। চোখের কোনা মুছতে মুছতে বলেন অনেক গর্ব হয় তোদের নিয়ে। বেঁচে থাক বাবা। দোয়া করিস। আমাদের স্যাররা তীব্র শীতে, উত্তপ্ত রোদে, পথঘাট ঢোবা বৃষ্টিতে ও অস্পষ্ট কুয়াশায় ক্লাসে চলে আসতেন। ক্লাসে এসে সবার খবর নিতেন। সবার বাড়িঘরের অবস্থা জেনে নিতেন। কতশত বাধা বিপত্তি পেরিয়ে আমাদের মানুষের মতো মানুষ করেছেন। আমাদের জীবনকে উপভোগ করতে সাহায্য করেছেন। সবুজ গ্রহে টিকিয়ে রাখতে ও থাকতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। আমরা তাদের কতটুকু মনে রাখি? শেষ বয়সে কয়বার স্মরণ করে দেখা করি? কখনো কি জানতে চেয়েছি সেই স্যার কোথায় আছেন? যিনি দুষ্টুমির কারণে বেত্রাঘাত করে পরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন।

বকা দিয়ে পরে আদর করতেন। বেয়াদবি করলে শিক্ষা দিতেন। পিটিতে সুশৃঙ্খল থাকতে মাইর দিতেন। যেই শৃঙ্খলার কারণে আজ আমরা প্রশাসনের হেড হিসেবে নিযুক্ত হয়েছি। দেশের মানুষের পাশে থাকতে পেরেছি। দুনিয়ার বড় বড় পদবিওয়ালারা কোনো না কোনো শিক্ষকের হাত ধরেই এতদূর এসেছেন। যত বড় পদবি থাকুক না কেন, নিশ্চয়ই শিক্ষকের অমায়িক শিক্ষার কারণে আজ মস্ত বড় দায়িত্ব নিয়ে চেয়ারে বসে আছেন। কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে কলম নাচাচ্ছেন। ক্যামেরার সামনে ঘুছিয়ে কথা বলছেন। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বের আনাচে-কানাচে। কাগজ-পত্রিকায় শিরোনাম হিসেবে আসছেন। বড় অনুষ্ঠানের প্রধান মেহমান হচ্ছেন। সবকিছু সেই শিক্ষক-শিক্ষিকা নামের বাবা-মায়ের জন্য। সেই বড় ভাই ও আপু নামের শিক্ষক-শিক্ষিকার জন্য।

তাদের মনে রাখুন। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। তাদের পাশে থাকুন। তাদের খোঁজ রাখুন। শেষ বয়সে হয়তো চেয়ারে বসে টিভির দিকে তাকিয়ে বলছে, হে-হে! সে আমার ছাত্র। আমি পড়িয়েছি তাকে। খুব দুষ্ট ছিল। কিন্তু আজ দেশের রাষ্ট্রপতি! দেশের প্রধানমন্ত্রী। দেশের সেনাপ্রধান! বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন! বড় কোম্পানির প্রধান! এসব বলে চোখের কোনা মুছেছে। একবার কী ভেবেছেন কেমন খুশি হবেন তিনি যদি আপনি-আমি গিয়ে পায়ে ধরে সালাম করে হাসিমুখে বলেন, ‘স্যার আপনার সেই দুষ্ট ছাত্র দেশের সেনাপ্রধান। আপনার সেই স্কুল ফাঁকি মারা শয়তান দেশের রাষ্ট্রপতি। আপনাকে বকবক করে বিরক্ত করা সেই পাজি এখন কোর্টের জাজ!’ বেঁচে থাকুক সহস্র বছর আমাদের শিক্ষাগুরুরা। শান্তিতে থাকুক জীবনের অধিকাংশ সময় অন্যের তরে কাটিয়ে দেওয়া শিক্ষক-শিক্ষিকারা। মহান অধিপতি তাদের সহস্র বছর জিইয়ে রাখুক ভুবনে।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, সরকারি সিটি কলেজ, চট্টগ্রাম

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close