এস এম রাহমান জিকু

  ৩১ মার্চ, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে মাথাপিছু বরাদ্দ বাড়াতে হবে

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা স্তরের অন্যতম একটি বৃহৎ প্ল্যাটফরম। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজের তদারকি করতে গিয়ে অভ্যন্তরীণ শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনায় বাড়তি চাপ পোহাতে হচ্ছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে। সেই চাপ কমাতে ও অধিভুক্ত কলেজগুলোর মান উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৯২ সালের ২১ অক্টোবর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দেশের প্রায় ৩০-৪০ লাখ শিক্ষার্থী নিয়মিত অধ্যয়ন করছেন।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীপিছু বার্ষিক ব্যয় যেন ধারাবাহিকভাবে কমছে। বর্তমানে যা মাত্র ৭০২ টাকা। অর্থাৎ শিক্ষার্থীপিছু মাসে ৫৮ টাকা ব্যয় করছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ বার্ষিক এক প্রতিবেদনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীপিছু ব্যয়সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে আসে। ইউজিসির প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ২০২০ সালে (এক বছর) একেকজন শিক্ষার্থীর জন্য গড়ে ব্যয় করেছে ১ হাজার ১৫১ টাকা, যা পরের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে কমিয়ে ৭৪৩ টাকা করা হয়। আর ২০২২ সালে গড়ে একেকজন শিক্ষার্থীর জন্য ব্যয় করা হয়েছে মাত্র ৭০২ টাকা। অর্থাৎ যা মাসে ৫৮ টাকার সামান্য বেশি (৫৮.৫)।

দেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে যতজন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে, তার মধ্যে প্রায় ৭২ শতাংশই পড়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি-বেসরকারি কলেজগুলোতে। বাংলাদেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ আছে ২ হাজার ২৫৭টি। এসব কলেজে শিক্ষার্থী ৩০ থেকে ৪০ লাখের কাছাকাছি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোতে পড়াশোনার মান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রশ্ন উঠছে। ঠিকমতো ক্লাস না করে পরীক্ষার ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে।

বর্তমানে বাংলাদেশে সরকার অনুমোদিত পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৬৯টি। এর মধ্যে ৪টি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়, ৫৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১১৪টি। তবে শিক্ষার্থীপিছু তুলনামূলক ব্যয়ের তথ্যটি ৫০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে।

ইউজিসির তথ্যে উঠে আসে, সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চেয়ে বিজ্ঞান, চিকিৎসা, প্রকৌশল ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীপিছু ব্যয় সব সময়ই বেশি। বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক কিছু গবেষণাগারে কিংবা হাতে-কলমে শিক্ষা দিতে হয়। অন্যদিকে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও তুলনামূলক কম থাকে। দেশের শিক্ষাবিশষজ্ঞরা বলছেন, যেসব বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীপিছু ব্যয় বেশি করে, সেগুলোর পড়াশোনা ও গবেষণার মান তুলনামূলকভাবে ভালো হবে। আর যারা কম ব্যয় করে, তাদের শিক্ষার মান খারাপ হবে- এমনটাই স্বাভাবিক।

বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় বার্ষিক ৭০২ টাকা একজন শিক্ষার্থীর পেছনে সরকারের বিনিয়োগ নিছক হাস্যকর। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই শিক্ষায় বরাদ্দের হার সবচেয়ে কম, যা কখনোই কাম্য নয় এবং খুবই দুঃখজনক। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার এমন বেহাল দশা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে দেশের শিক্ষাবিশষজ্ঞদের নতুন করে ভাবতে হবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো নিয়ে বারবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাদ দিয়ে যৌক্তিক ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীপিছু বরাদ্দ বাড়াতে হবে। অন্যদিকে দেশের উচ্চশিক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে শিক্ষার্থীপিছু সবচেয়ে বেশি ব্যয় করে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীপিছু ব্যয় করে ৪ লাখ ৬৬ হাজার টাকা, যা এক বছরের ব্যবধানে ৬৩ হাজার টাকা বেড়েছে। যার ফলে এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও গবেষণায়ও তুলনামূলকভাবে এগিয়ে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ বার্ষিক এক প্রতিবেদনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীপিছু ব্যয়সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে আসে। কিছুদিন আগে প্রতিবেদনটি রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করেছে ইউজিসি। মূলত অবকাঠামো উন্নয়ন, রক্ষণাবেক্ষণ ও যন্ত্রপাতি কেনা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ব্যয় দেখানো হয়, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী দিয়ে ভাগ করে শিক্ষার্থীপিছু ব্যয়ের হিসাবটি করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২০২২ সালে গড়ে একজন শিক্ষার্থীর জন্য ব্যয় করেছে ২ লাখ ১৮ হাজার ৫৫৭ টাকা, যা ২০২১ সালে ছিল ১ লাখ ৮৫ হাজার ১২৪ টাকা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীপিছু ব্যয় করা হয় ২ লাখ ১ হাজার ৭৭৮ টাকা, যা ২০২১ সালে ছিল দেড় লাখ টাকা। বুয়েটে শিক্ষার্থীপিছু ব্যয় করা হয় ৩ লাখ ১৪ হাজার ৪৭৭ টাকা, যা এক বছর আগে ছিল ২ লাখ ৯৮ হাজার টাকার বেশি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীপিছু ব্যয় করে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬৭০ টাকা, যা আগের বছর ছিল ১ লাখ ১৯ হাজার ৯২৪ টাকা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীপিছু ব্যয় করে ১ লাখ ৮৬ হাজার টাকা, যা এক বছর আগে ছিল ১ লাখ ৬২ হাজার টাকা। অথচ কোন যুক্তিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীপিছু বার্ষিক ব্যয় কমে মাত্র ৭০২ টাকা হবে?

অবশ্য ইউজিসির এই তথ্যের সঙ্গে একমত নন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মশিউর রহমান। এ বিষয়ে তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, এখানে কলেজগুলোর শিক্ষকদের বেতনের তথ্য কী ধরা হয়েছে? কলেজে প্রতি বছর সরকার যে বরাদ্দ দেয়, তা কী ধরা হয়েছে? কলেজশিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্পের অধীন বিদেশে শিক্ষক পাঠানো হচ্ছে, সেগুলো এই তথ্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে? তার কাছে মনে হয়, সমগ্র বিষয়টি এখানে আসেনি। যদি সেটা না হয়ে থাকে, সেই দায়িত্ব জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এড়াতে পারেন না। ইউজিসি বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই তারা এই পরিসংখ্যান তৈরি করেছে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শাক দিয়ে যতই মাছ ঢাকতে চান না কেন? তাকে স্বীকার করতেই হবে যে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীপিছু ব্যয় তুলনামূলকভাবে অনেক কম। বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কথা তো বাদই দিলাম। সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে তুলনা করলেও তো ধারে-কাছে আসে না জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থীদের পেছনে সরকারের ব্যয়ের একটা সামঞ্জস্য থাকতে হবে। কোনো শিক্ষার্থীর পেছনে ৩ লাখ টাকা আর কোনো শিক্ষার্থীর পেছনে ৭০০ টাকা, এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বাদ দিয়ে হবে না। আমাদের সমাজে আরো অনেক ক্ষেত্রে প্রকট বৈষম্যের দেখা মেলে। কিন্তু শিক্ষার বৈষম্যটি সবচেয়ে পীড়াদায়ক এবং দুঃখজনক। তবে এটা ঠিক, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দ তুলনামূলক অনেক কম। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য করে ব্যয় বাড়ালে নিঃসন্দেহে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানও বাড়বে।

ভালো পড়াশোনার জন্য বিনিয়োগ একটি বড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত শিক্ষার্থীদের পেছনে ব্যয়ের করুণদশার চিত্রই বলছে ভালো মানের পড়াশোনার পর্যাপ্ত সুযোগ ও পরিবেশ কোনোটাই এখানে নেই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীপিছু বার্ষিক ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধিকরণের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়ন, রক্ষণাবেক্ষণ এবং যন্ত্রপাতি ক্রয়সহ শিক্ষার্থীদের বাস্তবানুগ ও কারিগরি দক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোতে পরিবেশবান্ধব শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনায় যথাযথ নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে। তবেই শুধু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরাও দেশের উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবেন।

সর্বোপরি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা ও সমস্যা নিরসনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের অপার সম্ভাবনা নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম কলেজ

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close