আব্দুল্লাহ আল মুনাইম

  ২৪ মার্চ, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

তরুণসমাজ ও সংকটময় আগামী

একটি দেশের মূল সম্পদ হচ্ছে তরুণসমাজ। একটি দেশ বা সমাজকে এগিয়ে নিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে মূলত তরুণসমাজ। বলা যায়, একটি দেশের তরুণসমাজ ওই দেশের সম্পদ। তরুণরা স্বপ্ন দেখতে জানে, প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে পারে। গড়ে তুলতে পারে নতুন সম্ভাবনা। তাই তো কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘১৮ বছর বয়স কি দুঃসহ, স্পর্ধায় নেয় মাথা নোয়াবার ঝুঁকি’। তরুণরাই হয় সমাজের সবচেয়ে বেশি উদ্যমী আর কর্মঠ সদস্য।

কিন্তু এই তরুণসমাজ যখন সমাজের জন্য বোঝা হয়ে যায়, তখন সেই সমাজ মুখ থুবড়ে পড়ে। আমাদের এই উন্নয়নশীল দেশকে দ্রুত পরিবর্তনশীল এই পৃথিবীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে হলে তরুণসমাজকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। ভার্চুয়াল দুনিয়া থেকে বেরিয়ে এসে পদচারণে করতে হবে বাস্তব জীবনে। জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২’-এর তথ্য মতে, দেশে জনসংখ্যার প্রায় ৫৭ শতাংশ, বা প্রায় ৯ কোটি ৪০ লাখ মানুষের বয়স ২৯ বছরের কম। এর মধ্যে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সিদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। এ বয়সি জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৭২ লাখ, যা জনসংখ্যার ১০ দশমিক ১০ শতাংশ। বাংলাদেশের জনসংখ্যার চার ভাগের এক ভাগই এখন তরুণ। যাদের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে। সংখ্যার হিসাবে, তরুণ জনগোষ্ঠী এখন ৪ কোটি ৫৯ লাখ। বর্তমানে আমাদের তরুণসমাজ নানা সমস্যায় জর্জরিত।

কিছু অংশ বাদ দিলে দেশের তরুণ সমাজের একটা বড় অংশই আজ নানাভাবে সংকটে নিমজ্জিত। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জায়গায় তরুণরা পাচ্ছে না যথাযোগ্য মর্যাদা, কাজ ও মেধার যথার্থ সম্মান। তরুণ জনগোষ্ঠী সংখ্যায় বিশাল হলেও তাদের কতটা ইতিবাচকভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ২০১৬ সালের শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য বলছে, দেশে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারের হার বেশি। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১০ শতাংশ। অন্যদিকে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সিদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম বলেন, এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে বেকার তৈরির কারখানা। দেশের প্রতিটি অলিগলিতে বিশ্ববিদ্যালয়। যেখান থেকে প্রতি বছর বের হচ্ছে লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী। কিন্তু নেই পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান। তিনি আরো বলেন, আমার বিভাগে আমি অল্প কয়েকজন শিক্ষার্থী চাই যারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়েই কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারবে। আমি চাই তারা দক্ষ জনশক্তি হয়ে গড়ে উঠুক। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সুযোগ নেই বললেই চলে। সেদিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। সরকারের উচিত নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন না করে প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক ল্যাবসহ পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা। যাতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে কাউকে আর বেকার থাকতে না হয়।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতে, তরুণ জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ভারতে ৩৫ কোটি ৬০ লাখ, চীনে ২৬ কোটি ৯০ লাখ, ইন্দোনেশিয়ায় ৬ কোটি ৭০ লাখ, যুক্তরাষ্ট্র ৬ কোটি ৫০ লাখ, পাকিস্তানে ৫ কোটি ৯০ লাখ এবং বাংলাদেশে রয়েছে ৪ কোটি ৭৬ লাখ। এই তরুণরাই বাংলাদেশের সব ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখে চলছিল। কিন্তু বর্তমানে তরুণদের ওপর চালানো এক জনমত জরিপে দেখা যায়, প্রচলিত এই রাজনীতিকে আমাদের দেশের প্রায় ৬০ ভাগ তরুণ ছেলেমেয়ে পছন্দ করেন না। তাদের কাছে রাজনীতির সংজ্ঞাটাই হলো ক্ষমতার ভাগাভাগি আর সুবিধাবাদকেন্দ্রিক দলীয় চর্চা। তারা প্রচলিত রাজনীতিকে এ দেশের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক বলে উত্থাপন করেন। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে তরুণরা যত বেশি পড়ালেখা করছে, তাদের তত বেশি বেকার থাকার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) আঞ্চলিক কর্মসংস্থান নিয়ে এক প্রতিবেদনেও এই চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি পাকিস্তানে ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। বাংলাদেশে এ হার ১০ দশমিক ৭ শতাংশ, যা এ অঞ্চলের ২৮টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। দেশে তরুণদের বিশেষত শিক্ষিত তরুণদের এক বৃহদাংশ বেকার জীবনযাপন করছে এবং সেটা বেড়েই চলছে।

বণিক বার্তার তথ্য মতে দেশের মোট শ্রমশক্তির একটি বড় অংশ তরুণ-তরুণী। তাদের মধ্যে শিক্ষিত তরুণদের প্রায় অর্ধেকইবা ৪২ শতাংশ দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাতে চান। অনিশ্চিত আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ, দক্ষতা অনুযায়ী চাকরির বাজার তৈরি না হওয়া, গুণগত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের স্বল্পতা, উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগের অভাব এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তা শঙ্কার কারণেই তাদের এ আগ্রহ। তবে বিদেশ যাওয়ার পর যদি দেখেন এসব সংকট সমাধান হয়েছে, তাহলে ৮৫ শতাংশই আবার দেশে ফিরে আসার কথা জানিয়েছেন। বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টার (বিওয়াইএলসি) ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের পিস অ্যান্ড জাস্টিস সেন্টারের ‘ইয়ুথ ম্যাটার্স সার্ভে ২০২৩’ শীর্ষক যৌথ সমীক্ষায় বিষয়টি উঠে এসেছে। দেশের আট বিভাগের ৫ হাজার ৬০৯ তরুণ-তরুণীর মাঝে পরিচালিত এ জরিপে দেখা যায়, ৭৫ দশমিক ৫ শতাংশই দেশ ছাড়ার কারণ হিসেবে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তাকে দায়ী করেছেন। ৫০ দশমিক ৯ শতাংশ তরুণ আবার মনে করেন, তাদের যে দক্ষতা রয়েছে দেশে সে অনুযায়ী চাকরি নেই। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই মনে করেন ৪২ দশমিক ৩ শতাংশ তরুণ এবং ৪০ দশমিক ৮ শতাংশ মনে করেন দেশে উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ কম। এ ছাড়া ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কার কারণে দেশ ছাড়তে চাইছেন ৩৩ দশমিক ৯ শতাংশ তরুণ-তরুণী।

বর্তমানে দেশকে এগিয়ে নিতে তরুণদের দক্ষতা এবং প্রবীণদের জ্ঞানকে একত্র করে সমস্ত পরিকল্পনা তৈরি করা উচিত। পরিকল্পনা তৈরির পাশাপাশি সেগুলোর বাস্তবায়নেও অগ্রাধিকার দেওয়া আবশ্যক। তরুণরা যদি তাদের পরামর্শ না দেয় তবে তারা ভুল করার ঝুঁকি নেয়। এই কারণে, তরুণসমাজের বিকাশ দেশের সাধারণ উন্নয়নের রূপরেখা হওয়া উচিত। তরুণরা কেন বিদেশে ভ্রমণ করতে চায়, তার জন্য আরো তদন্তের প্রয়োজন। যেহেতু তরুণদের কাছে দেশের ভবিষ্যতের চাবিকাঠি রয়েছে, তাই তাদের আগ্রহ জাগিয়ে তোলার জন্য তাদের মনে সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষার বীজ বপন করা অপরিহার্য।

আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের তরুণরা অনেক সম্ভাবনাময়। দেশের তরুণদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে দেশ ধাপে ধাপে আরো উন্নতির পথে অগ্রসর হবে। এজন্য তরুণদের মেধার যথাযথ মূল্যায়ন প্রয়োজন। আগামীতে জ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক সমাজ গড়তে তরুণদের অগ্রাধিকার দিয়ে সামনে এগানোর উদ্যোগ নিতে হবে। দেশে কর্মসংস্থানের সুষ্ঠু পরিবেশ বিরাজ করুক, তরুণরা অর্জিত জ্ঞান সমাজে প্রয়োগের অনুপ্রেরণা পাক, সমৃদ্ধি ও উন্নতির পথে তরুণরা আরো ভূমিকা রাখুক, সেটিই আমাদের কাম্য। এ ছাড়া তরুণ জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে শিক্ষার গুণগত মান ও দক্ষতা বাড়ানোর পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। তবেই এগিয়ে যাবে আমাদের দেশ।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ও সদস্য বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close