রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২১ মার্চ, ২০২৪

মতামত

শিশুর শিক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত হোক

শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সচেতনতা সৃষ্টির জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বছরে একাধিকবার বিভিন্ন নামে শিশু দিবস পালন করা হয়। এর পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নিজেদের মতো করে পালন করে জাতীয় শিশু দিবস। আন্তর্জাতিকভাবে অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার বিশ্ব শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহ পালন করা হয়। জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী ২০ নভেম্বর বিশ্ব শিশু দিবস হিসেবে পালন হয়। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক শিশু দিবস পালিত হয় ১ জুন। এছাড়া ১১ অক্টোবর বিশ্বে আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস পালিত হয়। শিশুদের জন্য এ রকম আরো কয়েকটি দিবস রয়েছে। এর বাইরে বিশ্বের দেশগুলো তাদের গুরুত্বপূর্ণ কোনো কোনো দিনকে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালন করে থাকে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের জুনের দ্বিতীয় রবিবার পালন করা হয় শিশু দিবস। আবার পাকিস্তানে শিশু দিবস হলো ১ জুলাই, ৪ এপ্রিল শিশু দিবস উদযাপিত হয় চীনে। অন্যদিকে ব্রিটেনে শিশু দিবস পালন করা হয় ৩০ আগস্ট, জাপানে ৫ মে ও পশ্চিম জার্মানিতে ২০ সেপ্টেম্বর। তবে সব দেশেই শিশু দিবস পালনের উদ্দেশ্য একটাই, দেশের শিশুদের অধিকার ও তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ফের একবার সচেতনতার বার্তা দেওয়া।

শিশুদের ভালোবাসে না, আদর দেয় না এ রকম প্রাণী পৃথিবীতে বিরল। মানবসভ্যতায় শিশুর প্রতি ভালোবাসা প্রকট। এর পরও শিশুরা অধিকার বঞ্চিত হয়ে আসছে। কারণে-অকারণে, অভাব-অনটনে, ইচ্ছা-অনিচ্ছায় বা সচেতনতার অভাবেই প্রতিটি মানুষের আশপাশে, ঘরে-বাইরে, শিক্ষা-দীক্ষায়, চলাফেরায়, খেলাধুলায় আমাদের শিশুরা তাদের অধিকার পাচ্ছে না। শিশুদের ঘিরে আছে নানা বৈষম্য। একটি শিশুকে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে প্রথমেই শিশুর পারিবারিক ও সামাজিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্বব্যাপী শিশুদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য ১৯২৪ সালে জেনেভায় এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের মাধ্যমে ‘শিশু অধিকার’ ঘোষণা করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৯ সালে জাতিসংঘে শিশু অধিকার সনদ ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশ এই সনদে স্বাক্ষর করে। বর্তমান আইনে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। শিশু অধিকার সনদে ৫৪টি ধারা ও ১৩৭টি উপধারা আছে। এই উপধারাগুলোতে বলা হয়েছে, শিশুদের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বৈষম্য করা যাবে না।

সমাজকল্যাণমূলক কাজ এবং আইনের ক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য হবে শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ। রাষ্ট্রসমূহ শিশুদের পরিচর্যা ও সরকার শিশুদের সেবা এবং সুবিধাদি প্রদান করবে। শিশুদের মৌলিক অধিকার যেমন- শিক্ষা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি অধিকারগুলো নিশ্চিত করবে। শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ। অধিকাংশ শিশুই গ্রামের দরিদ্র পরিবারের সন্তান। পারিবারিক অসচ্ছলতা কাটাতে শ্রমজীবী শিশুদের প্রচণ্ড স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে শ্রমিকের কাজ করতে হচ্ছে। চিকিৎসকদের মতে, শিশুরা দীর্ঘদিন ধরে হোসিয়ারি শিল্প কারখানার মতো ধূলিময় পরিবেশে কাজ করলে তাদের শ্বাসকষ্ট ও ব্রংকাইটিস রোগ হতে পারে। এ ছাড়া ওয়ার্কশপের মতো কারখানায় মেটাল ডাস্টের মধ্যে যদি শিশুরা কাজ করে তবে ফুসফুসের ক্যানসারও হতে পারে। ২০০৬ সালের বাংলাদেশ শ্রম আইনের ১ থেকে ১৪ এবং ১৯৭৫ সালের শিশু আইনে বলা হয়েছে, শূন্য থেকে ১৬ বছরের শিশুদের ভারী কাজ করানো যাবে না। কিন্তু কোথাও এই আইন মানা হচ্ছে না। শিশুরা বড় হবে, এক দিন স্কুল পাস করে কলেজে ভর্তি হবে। তারা শিক্ষিত হবে। জ্ঞান অর্জন করবে। মানবিক মূল্যবোধ বাড়বে। তখন একটা পরিবর্তন হয়তো আসতে পারে।

আইনে বলা আছে, ১৮ বছর পর্যন্ত সবাই শিশু। তাহলে ১৮ বছরের আগে কাউকে কাজে নিয়োগ করা বন্ধ করতে হবে। আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তবেই হয়তো এক দিন আমাদের সমাজ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন সম্ভব হবে। শিশুরা পবিত্রতার প্রতীক ও নিরন্তর আনন্দের উৎস। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় দেশের শিশুদের সুরক্ষা চ্যালেঞ্জের মুখে। বিবিধ সংবাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, শিশুরা সহিংসতা, শিশুশ্রম, শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এতে বিপন্ন হয় একটি শিশুর ভবিষ্যৎ। শিশুদের প্রতি যেকোনো ধরনের হিংসা, শোষণ, নিগ্রহ, যৌনাচার, পাচার ও বাল্যবিয়ে থেকে রক্ষা করাই হচ্ছে শিশু সুরক্ষা। শিশু আইন ২০১৩-এর আলোকে আইনের সংস্পর্শে আসা শিশু এবং সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সুরক্ষার জন্য বিবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করছে। এ ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের একটি অনন্য উদ্যোগ সমাজভিত্তিক শিশু সুরক্ষা কার্যক্রম, যার নাম সমাজভিত্তিক শিশু সুরক্ষা কমিটি বা সিবিসিপিসি। গ্রাম ও নগরপর্যায়ে দেশের সর্বত্র সমাজসেবা অধিদপ্তর ও ইউনিসেফ যৌথ উদ্যোগে এ কার্যক্রমের বাস্তবায়ন চলছে। বর্তমানে ওয়ার্ডভিত্তিক সিবিসিপিসি গঠনের মাধ্যমে এই নব উদ্যোগের যাত্রা শুরু হলেও তেমন সুফল এখনো দেখা যায়নি।

দেশের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে জাতিসংঘের উদ্যোগ শুরু হয় ১৯৯৯ সালে। বিশেষত পথশিশুদের সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে ইউএনডিপির সহায়তায় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় সমাজসেবা অধিদপ্তর এআরআইএসই নামক প্রকল্প গ্রহণ করে। পরে ২০০৭ সালে ইউনিসেফের অর্থায়নে ঝুঁকিগ্রস্ত শিশুদের সুরক্ষার জন্য পিসিএআর প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় ২০১২ সাল থেকে ইউনিসেফের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় সিএসপিবি শীর্ষক প্রকল্পের বাস্তবায়ন চলছে। যার অন্যতম লক্ষ্য শিশুদের প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন ও অবহেলা হ্রাসের উদ্যোগ গ্রহণ করা। সর্বত্র শিশুবান্ধব সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের উন্নয়ন এবং ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশের উন্নয়ন করা। আজকের শিশু দেশের ভবিষ্যৎ রূপকার। শিশুরাই ভবিষ্যৎ পৃথিবীর নেতৃত্ব দেবে। দেশের প্রত্যেক শিশুকে ভবিষ্যতের উপযোগী আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা সবার নৈতিক দায়িত্ব। একমাত্র যোগ্য নাগরিকরাই পারে দেশকে সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছাতে।

এ দেশের সুবিধাবঞ্চিত ও ঝুঁকিগ্রস্ত শিশুদের সুরক্ষায় জাতিসংঘের ভূমিকা প্রশংসনীয়। আমাদের দেশে ইউনিসেফ ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের যৌথ উদ্যোগে সমাজভিত্তিক শিশু সুরক্ষা কার্যক্রমের উদ্যোগ শুরু হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় সমাজের সব পক্ষের অংশগ্রহণ জোরদার হোক। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের অধিকার সুনিশ্চিত হোক। আমাদের মনে রাখতেই হবে, শিশু-কিশোর খোকা কালক্রমে যখন বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি হলেন তখনো শিশু-কিশোরদের ভোলেননি। বঙ্গবন্ধু শিশু-কিশোরদের বড় ভালোবাসতেন। বঙ্গবন্ধু শৈশবে বা কৈশোরে স্বাধীনতা ভোগ করেছেন, বাঁধনহারা আনন্দে দিন কাটিয়েছেন। ঠিক একইভাবে বাংলাদেশের শিশু-কিশোররা যাতে হেসেখেলে মুক্তচিন্তায় মুক্ত মনে বেড়ে ওঠার সুযোগ ও পরিবেশ পায় সে কথা তিনি ভাবতেন। প্রতিটি শিশুই তার পিতা-মাতার কাছে বড় আদরের। এখানে জাত-পাত, ধনী-গরিবের ভেদাভেদ নেই। বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘শিশু হও, শিশুর মতো হও। শিশুর মতো হাসতে শেখো। দুনিয়ার ভালোবাসা পাবে।’ আসলে বঙ্গবন্ধু ছিলেন শিশুর মতো সরল একজন, তার হাসিও ছিল শিশুর মতো; আর তাই সারা পৃথিবীর ভালোবাসা তার জন্য। বঙ্গবন্ধু শিশু উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছিলেন। তা হচ্ছে; শিশুকল্যাণের জন্য মায়েদের সম্পৃক্ত করে প্রতিষ্ঠা করেন মা ও শিশুকল্যাণ অধিদপ্তর। শিশুর সার্বিক উন্নতি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় শিশু একাডেমি। এ দুটো প্রতিষ্ঠান-সংক্রান্ত ভাবনা-পরিকল্পনা বঙ্গবন্ধুর সব সময়ই ছিল। শিশুর শিক্ষাকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে ১৯৭৩-এ ৩৭,০০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়।

বাংলাদেশের সে সময়ের সার্বিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সিদ্ধান্তটি ছিল সাহসী ও যুগান্তকারী। ১৯৭৪-এর ২২ জুন শিশু আইন জারি করা হয়। এ আইন শিশু অধিকারের রক্ষাকবচ। ১৯২০-এর ১৭ মার্চ যে শিশুটির জন্ম হয়েছিল সে আজীবন ছিল শিশুর মতো সরল। ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালন করা হয়। বঙ্গবন্ধু শিশুদের অত্যন্ত আদর করতেন, ভালোবাসতেন শিশুদের সঙ্গে গল্প করতেন, খেলা করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন আজকের শিশুরাই আগামী দিনের দেশ গড়ার কারিগর। আজকের তরুণ প্রজন্ম এই মহান নেতার আদর্শ থেকেই দেশ গড়ার অনুপ্রেরণা লাভ করবে। যারা বাংলাদেশকে বিশ্বাস করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে তাদের মাঝেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকবেন। আজকের শিশুরাই আমাদের আগামীর ভবিষ্যৎ। এজন্য শিশুদের যথাযথ শিক্ষা ও মানসিক বিকাশ ঘটাতে হলে তাদের সেভাবে বেড়ে উঠতে দিতে হবে। অনেক শিশু দরিদ্রতার কারণে তাদের সেই মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হয়। বাধ্য হয়ে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে নিষিদ্ধ শিশুশ্রমে জড়িয়ে পড়ে। যে বয়সে ওদের লেখাপড়া করার কথা সে বয়সে দরিদ্রতার কারণে বিভিন্ন কলকারখানা, হোটেল, ওয়ার্কশপ, দোকানপাট ইত্যাদিতে অমানসিক পরিশ্রমে লিপ্ত থাকে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি উন্নয়নশীল দেশ। এখানে বাস ১৭ কোটি মানুষের। এ বিশাল জনগোষ্ঠীর ৪০ শতাংশ অর্থাৎ ৬ কোটিরও বেশি শিশু। তাই শিশুদের মৌলিক অধিকারগুলো ফিরিয়ে দিয়ে তাদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর কর্ম ও রাজনৈতিক জীবন অসামান্য গৌরবের। তার এ গৌরবের ইতিহাস থেকে প্রতিটি শিশুর মাঝে চারিত্রিক দৃঢ়তার ভিত্তি গড়ে উঠুক এটাই জাতীয় শিশু দিবসের মূল প্রতিপাদ্য। সর্বোপরি আজকের শিশুরাই আগামীর সক্ষম নাগরিক। তাই শিশু-কিশোরদের চারিত্রিক দৃঢ়তার পাশাপাশি স্বাস্থ্য-পুষ্টির দিকে নজর দিয়ে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ নিশ্চিত হোক- এটাই সবার প্রত্যাশা।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close