গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির
দৃষ্টিপাত
মাহে রমজানের প্রস্তুতি ও কিছু পরামর্শ
মাহে রমজান একটি মহিমান্বিত মাস। মহান আল্লাহপাক রোজা ফরজ করেছেন। এ মাসে বেহেশতের দরজাগুলো খোলা থাকে আর দোজখের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানকে শেকল পরিয়ে রাখা হয়। এখানে হাজার মাসের উপকারী রাত রয়েছে। যে ব্যক্তি এর মহিমাকে অস্বীকার করল, মূলত সে বঞ্চিত! [আবু হুরাইরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিস]
পবিত্র মাহে রমজান নিয়ে সবারই কিছু না কিছু লক্ষ্য থাকে। নিজের ক্ষেত্রেই বলি, জীবনের অনেক রমজান এসেছে, আবার চলেও গেছে। কত কিছু ইচ্ছা ছিল, বাস্তবে কিছুই করা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু কেন? অনেক ভেবে দেখেছি, এর একমাত্র কারণ দুর্বল পরিকল্পনা। যদিও রমজানের সফলতাদানের মালিক একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা, তবুও শক্ত পরিকল্পনা এবং নিজের গোছানো প্রস্তুতি এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে বলে আমার বিশ্বাস। এখানে প্রস্তুতির কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করব, হয়তো এগুলো আমাদের সবারই কাজে আসবে, ইনশাআল্লাহ!
লক্ষ্য নির্ধারণ : এই রমজানে আমার লক্ষ্য কী? কোরআনের কতটুকু অংশ আমি পড়তে চাই। কতটুকু বুঝে পড়তে চাই। কতটুকু আমল করতে চাই। কোরআনের কতটুকু অংশ এই রমজানে মুখস্থ করা আমার পক্ষে সম্ভব। বাহ্যিক এবং মানসিকভাবে নিজের মধ্যে রমজানের পরে আমি কতটুকু পরিবর্তন দেখতে চাই। কোন কোন বিশেষ বিষয়গুলো সম্পর্কে আমার জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করব এই বিশেষ রহমতের মাসে। কতটা সমাজসেবা করবেন। কীভাবে মানুষের উপকার করা যায় তা নির্ধারণ করতে হবে। এভাবে লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে।
মানসিক প্রস্তুতি : যেকোনো কাজের জন্য প্রথমে প্রয়োজন মানসিক প্রস্তুতি। নিয়তে গরমিল থাকায় অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ কাজও পড়ে থাকে অবহেলায়। রোজার ক্ষেত্রেও এ প্রবণতা চোখে পড়ে। আবার দিনের বেলায় খাবার সামনে দেখে আত্মলালসায় ভোগেন কেউ কেউ। এজন্য লোভ, অহংকার পরিত্যাগ করে মনোবল দৃঢ় করতে হবে।
শারীরিক প্রস্তুতি : রোগ-শোক আমাদের বাঙালির সহজাত প্রবৃত্তি। কেউ কেউ সারা বছরই নানা সমস্যায় ভোগেন। কেউ আবার মৌসুমি অসুখে। তারা ডাক্তারের বরাত দিয়ে রোজা ছেড়ে দেন। এ প্রবণতা আত্মঘাতীই বটে। যা অনেকটা ‘মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলা’র মতো। তাদের জন্য প্রয়োজন শারীরিক সব সমস্যা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা। সে জন্য ভালো ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ গ্রহণ করে সুস্থ-সবল দেহ তৈরি করে নিতে হবে।
শ্রমিকদের প্রস্তুতি : শ্রমিকরা সারা বছরই শ্রমিক। রমজানেও নিশ্চয়ই তাদের কাজ ছাড়ার ফুরসত থাকবে না। তবে ইসলাম এ ক্ষেত্রে কিছু নির্দেশনা রেখেছে। তা হলো, রমজানে ভারী কোনো কাজ না করা। মালিকের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন সহমর্মিতার। দিনমজুরদের জন্য ভালো হয় বাড়তি কিছু রোজগার জমিয়ে রাখা, যাতে রোজার দিনগুলোতে বাড়তি চাপ না আসে।
ব্যবসায়ীদের প্রস্তুতি : রমজান এলেই ব্যবসায়ীরা খুশিতে আত্মহারা হন। সুযোগে মুনাফা করে নেন বছরের দ্বিগুণ। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়িয়ে বাড়তি ফায়দা লোটার ধান্দায় মত্ত থাকেন সব সময়। যে কারণে ভালো সব পণ্য থাকে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। এটি শুধুই অমানবিক নয়, রীতিমতো হিংস্রতাও। এ ব্যাপারে হাদিসে এসেছে কঠোর সতর্কতা। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কেউ যদি কৃত্রিম উপায়ে অর্থাৎ খাদ্য গুদামজাত করে সংকট তৈরি করে, আল্লাহ তাকে কুষ্ঠরোগ দেবেন কিংবা এক দিন না এক দিন তাকে অবশ্যই গরিব বানাবেন।’ অতএব ব্যবসায়ীদের এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া উচিত। দাম বাড়ানোর কারণে যেন কোনো রোজাদার কষ্ট না পান, নিজেরাও যাতে হালাল উপার্জনে রোজা পালন করতে পারেন, সেই খেয়াল রাখতে হবে আমাদের।
সর্বত্র পবিত্রতা রক্ষা করা : রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করা সবার জন্যই কর্তব্য। সবারই খেয়াল রাখা কর্তব্য, নিজের কারণে যাতে কোনো রোজাদারের ক্ষতি না হয়। পবিত্রতা রক্ষার স্বার্থে রমজানে গানবাজনা, সিনেমা হল, হোটেল এবং রোজাদারের জন্য ক্ষতিকর এমন কিছু করা যাবে না, বন্ধ রাখতে হবে। পাশাপাশি অশ্লীল কথাবার্তা, শব্দদূষণ ইত্যাদি থেকে নিজেকে পবিত্র রাখতে হবে।
সারা দিনের পরিকল্পনা : যারা চাকরি করেন তাদেরা একরকম খসড়া পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে, যারা ছাত্র তারা অন্যভাবে নিতে হবে এবং পরিকল্পনানুযায়ী কাজ করার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। মহান আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে হবে। একজন অবিবাহিত মেয়ের জন্য রমজানে অনেক কিছু করা সম্ভব। কিন্তু একজন ব্যস্ত মায়ের জন্য তা ততটা সহজ নয়। যতটুকু পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, তা সঠিক সময়ে যাতে সম্পন্ন হয়, তার জন্য সারাটি দিনের কোন সময়টিকে কাজে লাগানো যায়, তা ভেবে বের করতে হবে। কখন আপনি কোরআন পড়বেন? নিজের জন্য নফল নামাজ অথবা ইসলামি সাহিত্য অধ্যয়নের উপযুক্ত সময় কোনটি? তারাবিহ এবং কিয়াম, দুটোই কি সম্ভব? না কি যেকোনো একটা? বাস্তবে সারা দিনের এ সময় পরিকল্পনা অনেক সময় কাজে আসে না। ছোট শিশু সন্তানের মায়ের জন্য ঘড়ির কাঁটা অনুযায়ী চলা কঠিন। তবু অন্তত এটুকু খেয়াল রাখতে হবে, রমজানের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে আজ আমার কতটুকু করণীয় ছিল, আর কতটুকু হলো। মায়েদের ক্ষেত্রে যখন বাচ্চারা ঘুমায়, খেলাধুলা অথবা কিন্ডারগার্টেন, কিংবা স্কুলে ব্যস্ত থাকে সেই সময়টাকে প্রাধান্য দিতে হবে।
দোয়ার তালিকা : রমজান দোয়া কবুলের মাস। এই মাসে আল্লাহপাকের কাছে চাইলে তিনি বান্দাহকে ফিরিয়ে দেন না। আমরা কি চাই আমাদের দুনিয়ায় এবং পরবর্তী জীবনে? দোয়ার এই লিস্ট আমরা এভাবে করতে পারি। দুনিয়া, আখিরাত, ইবাদাত, উম্মাহ, পারস্পরিক সম্পর্ক ইত্যাদি। আল্লাহর কাছে পাগলের মতো দোয়া করতে হবে। মনে রাখা দরকার, আল্লাহপাক হচ্ছেন আল মুজিব... জবাবদাতা। দোয়া কবুল হওয়ার সবচেয়ে ভালো সময়গুলোতে দোয়া করি। ইফতারের সময়, নামাজে, তাহাজ্জুদ, শেষ দশ রাত। তা ছাড়া বেশি বেশি কোরআন তিলাওয়াত, দরুদ শরিফ পাঠ, জিকির, ভালো কাজ এবং বেশি বেশি দান করা। মহান আল্লাহতায়ালা আমাদের সবার সব দোয়া, দান ও কাজ কবুল করুক, সেই কামনা রইল।
ভালো কাজের লিস্ট : রমজান ফুরিয়ে গেলে অনেক সময় আফসোস হয়, হায়! কেন আমি রমজানে এই ভালো কাজটা করলাম না! সুতরাং দেরি না করে আসুন আজকেই একটা ভালো কাজের লিস্ট বানিয়ে ফেলি। চিন্তা করে দেখি কোন কোন ভালো কাজ আমাদের পক্ষে সম্ভব। বিদেশের বাড়িতে গরিব মিসকিনকে খাওয়ানো বা দান করার সুযোগ অনেক কম। তাই এমন হতে পারে যে প্রত্যেক ইফতার ওয়াক্তে আমাদের শিশুসন্তানকে দিয়ে একটি দানবাক্সে কিছু অর্থ জমানো, যা পরে গরিব শিশুদের জন্য ব্যয় হবে। ব্যক্তিগতভাবে আমি এটা খুব পছন্দ করি, কারণ আমি মনে করি এতে আমার সন্তানের মধ্যে দানশীলতার গুণ সৃষ্টি হবে। আমরা যে শহরে থাকি, সেখানকার ছোট ছোট শিশু বা মহিলাদের জন্য কোরআন শিক্ষার ক্লাস শুরু করতে পারি। নিকটস্থ মসজিদে কোরআন দান করতে পারি। ফল কিনে মসজিদে রেখে আসতে পারি। আশা করা যায়, কোনো রোজাদার এই ফল খেয়ে রোজা ভাঙলে অথবা এই কোরআনের কপিটি পড়লে তার পুরস্কার আমিও পাব।
পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা : বাসায় কোনো মেহমান এলে, তার আসার আগেই আমরা আমাদের বাসা পরিষ্কার করে ফেলি। রমজান নামক এই পবিত্র অতিথি আসার আগেই তেমনিভাবে আমাদের চারপাশ পরিচ্ছন্ন করে নেওয়া উচিত। তবে অবশ্যই এটা শুধু পারিপার্শিক পরিচ্ছন্নতা হবে না, এটা হবে আমাদের অন্তরের পরিচ্ছন্নতাও।
ঈদের প্রস্তুতি : ঈদ। মুমিনের খুশি। সাধ্যমতো এই খুশিতে সবাই শামিল হবে, এটাই রাসুলের সুন্নাহ! রমজানের প্রস্তুতির সময় তথা রমজানের আগেই এর প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। বেশির ভাগ মানুষই প্রস্তুতি নেয় শেষ দিকে। অথচ শেষ দশ দিন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাই ঈদের কেনাকাটা, উপহারসামগ্রী, সারা দিনের পরিকল্পনা সব আগেভাগে করে রাখা ভালো। প্রিয় পাঠক, উল্লিখিত বিষয়াদি যদি আমরা অনুসরণ করে পবিত্র মাহে রমজানুল মোবারক অতিবাহিত করতে পারি- সেই ফরিয়াদ করি মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে, আমিন।
লেখক : ধর্ম ও সমাজ সচেতনবিষয়ক লেখক
"