ফারিহা হোসেন

  ০৫ মার্চ, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

নদীকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যে সুদিনের প্রত্যাশা

পানি ছাড়া প্রাণের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। আমাদের জীবনধারণ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সবই নদীকেন্দ্রিক। নদীর ভাঙাগড়ার ভেতর দিয়েই প্রবাহিত হয়েছে আমাদের জীবনধারা। পৃথিবীর আদি সভ্যতা ও মনুষ্য বসতি গড়ে উঠেছে নদীকে ঘিরেই। আবহমানকাল থেকেই এ দেশের মানুষের জীবন-জীবিকা নদীনির্ভর। দেশের সভ্যতা, কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে অন্যতম নিয়ামক হলো নদী। নদ-নদীকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে যুগ-যুগান্তরের সভ্যতা। দেশে নদী ছড়িয়ে আছে জালের মতো। নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে রাজধানী ঢাকা, প্রাচীন রাজধানী সোনারগাঁসহ দেশের সব শহর-নগর। নদীকেন্দ্রিক যোগাযোগ যুগে যুগে দেশকে করেছে সমৃদ্ধতর। শুধু ভূখণ্ড সৃষ্টি আর দেশকে সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলাই করেনি নদী; শুধু বাংলাদেশেরই নয়, বিশ্বের প্রায় সব সভ্যতার বিকাশও ঘটিয়েছে নদী।

একসময় দেশের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যমই ছিল নদীপথ। ধীরে ধীরে প্রধান নদীগুলোর ওপর সেতু তৈরির মাধ্যমে দেশের যোগাযোগব্যবস্থা আরও উন্নত হয়ে উঠছে। যোগাযোগের সহজলভ্যতাই মানুষের উন্নয়নের পথ আরো সহজ করে তুললেও, নদীর গুরুত্ব মনে রাখা বাঞ্ছনীয়। দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ পানি। সারা বিশ্ব যখন পানিসংকটে ভুগছে, তখন আমরা এ সম্পদের উৎস নদীগুলোর সুরক্ষায় মনোযোগ দিচ্ছি না। দেশের জনসংখ্যা ১৬৯ দশমিক ৪ মিলিয়ন। জনসংখ্যা অনুযায়ী দেশে খাদ্য উৎপাদন ব্যাপক হারে বেড়েছে। উত্তরাঞ্চলে কৃষির ব্যাপক সম্প্রসারণ হয়েছে। ৪০০ কোটি বছরের এই প্রাচীন পৃথিবীতে বাংলাদেশের বয়স সর্বাধিক ৩ থেকে ৪ কোটি বছর। ভূমির উর্বরশক্তি ধরে রাখতেও শতাব্দীর পর শতাব্দী ভূমিকা রেখেছে নদীবিদৌত পলিমাটি। নদীর পানি যত স্বল্পই হোক, তার সঙ্গে আসে পলি। এর ফলে নতুন উর্বর শক্তিতে, বছর বছর নতুন যৌবন ফিরে পায় দেশের কৃষিভূমি।

ঐতিহাসিক সত্য হচ্ছে, বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। শাখা-প্রশাখাসহ প্রায় ৭০০ নদ-নদী বিপুল জলরাশি নিয়ে ২২,১৫৫ কিলোমিটার জায়গা দখল করে দেশের বিভিন্ন স্থান দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নদ-নদীগুলোর উপনদী ও শাখা নদী রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী ২০১৩ সালে দেশে নদ-নদীর সংখ্যা ছিল ৩১০টি। সরকারি তথ্য মতে, দেশে এর সংখ্যা প্রায় ৮০০টি। বর্তমানে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪০৫টিতে। এভাবে নদীগুলো মরতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে নদীর অস্তিত্ব ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে।

নদীকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে অসংখ্য কবিতা, গান, গল্প ও উপন্যাস। ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে’ থেকে আরম্ভ করে ‘আমায় ভাসাইলি রে আমায় ডুবাইলি রে’ চিরচেনা গানের প্রতিটি লাইনে নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদ-নদীর অপরূপ সৌন্দর্য আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে। নদীমাতৃক দেশ বলেও বাস্তবে দেশের নদীগুলোকে ভরাট ও দখল-দূষণে বিপন্ন করে তুলছি। নদীর সঙ্গে বিপদে পড়ছে নদীর ওপর নির্ভরশীল মানুষও। কৃষিপ্রধান উত্তরাঞ্চলে মরূকরণ দেখা দিলে সেখানে সেচ চাহিদা মেটাতে হচ্ছে মাটির নিচের পানি তোলে। এতে করে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামছে, মাটির গুণাগুণ নষ্ট হচ্ছে। মিঠাপানির অভাবে হুমকিতে পড়েছে সুন্দরবন। লবণাক্ততা মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে সুন্দরবনসহ দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে।

অন্যদিকে, সাম্প্রতিক সময়ে প্রাকৃতিক কারণে নদীভাঙনের হার আগের তুলনায় কমেছে। কিন্তু মনুষ্য সৃষ্ট নানা কারণে বেড়েছে নদীভাঙন। এর প্রধান কারণ নির্বিচারে বালু উত্তোলন। মানুষের লোভে, অসচেতনতায় নদীগুলো মরতে বসেছে। একই সঙ্গে কৃষি, প্রকৃতি ও পরিবেশ হচ্ছে বিপন্ন। নদীভাঙনে প্রতি বছর হাজার হাজার পরিবার ভিটে বাড়ি হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। পাশাপাশি নদী দখল হচ্ছে দুভাবে, ভূমিদস্যুরা নদী ভরাট করে স্থাপনা তৈরি করছে এবং শিল্পবর্জ্য নদীতে ফেলে নদীর পানিকে দূষিত করছে। দেশের নদীবিধৌত সব এলাকায় নদী, খাল-বিল অবৈধভাবে দখল হচ্ছে। ফলে পানিপ্রবাহের গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এতে নদ-নদী সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে। বর্ষাকালে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হওয়ায় প্রতিনিয়ত বন্যা দেখা দেয়। আবার অতি বৃষ্টিতে শহরাঞ্চলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এতে নগরবাসীর চলাচলে বিঘ্ন ঘটে এবং পানিতে ডেঙ্গু মশার বিস্তার ঘটে। একসময় দেশের মাছের চাহিদার প্রায় পুরোটাই জোগান দিত দেশের নদ-নদী, হাওর, বাঁওড় ও বিলগুলো। শিল্প, প্লাস্টিক বর্জ্য নদীতে ফেলার কারণে নদীর জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। দূষিত পানির কারণে মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আগে যেখানে নদী ছিল এখন সেখানে গড়ে উঠেছে সুরম্য ভবন, কোথাও কোথাও ফসলের মাঠ। এক তথ্যে দেখা যায়, গত ৫০ বছরে দেশের ৫০০ নদী ও ৮ হাজার খাল হারিয়ে গেছে। অবশিষ্ট জলাশয়ের অস্তিত্বও হুমকির মুখে আছে। নদীর ওপর নির্ভর করা মানুষগুলো বিকল্প আয়ের সন্ধানে ছুটছে ঢাকার পথে, এতে করে ঢাকা হয়ে পড়েছে ওভার-পলিউটেড এবং চাপ পড়ছে নির্দিষ্ট কিছু পেশার ওপর।

অথচ প্রভাবশালী মহলে দেশের নদীগুলো দখল করে বাণিজ্যিক ভবন তৈরি করছে। এতে প্রতিনিয়ত হারাচ্ছে নদী ও খাল। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, ভুল নদী শাসন, অবৈধ দখল দূষণের কারণে এখন অস্তিত্বসংকটে রয়েছে দেশের বেশির ভাগ নদী ও খাল-বিল। এমনি অবস্থায় অবৈধ দখল, দূষণ বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। সেই সঙ্গে বড় ধরনের জলাধার নির্মাণ, হাওর-বাঁওড়গুলোর সংস্কার করে পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি ও পানির গুণগত মান বাড়ানোর মতো নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। পাশাপাশি নদীপথ সচল করে ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি আনা যেতে পারে ও নদীকেন্দ্রিক পর্যটন এবং নৌপথে যাতায়াত সহজ করা যেতে পারে। এতে দেশের অর্থনীতি গতি পাবে।

ঢাকার হৃৎপিণ্ড বলে পরিচিত বুড়িগঙ্গার পানিদূষণ মারাতক রূপ ধারণ করেছে। শিরা-উপশিরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে মানবদেহকে যেমন অসুস্থ করে তোলে, তেমনি অবস্থা হয়েছে ঢাকাবাসীর। অথচ বুড়িগঙ্গাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা মলমূত্র, আবর্জনা ও রাসায়নিক বর্জ্যরে ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা। বহু প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল এসব নদী সৌন্দর্য হারানোর পাশাপাশি প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থলও বিলুপ্ত হচ্ছে এবং বিরূপ প্রভাব ফেলছে জীববৈচিত্র্যে। এরই মধ্যে বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশের নদী খনন, নদীর তীর রক্ষায় সরকার নানামুখী কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। পাশাপাশি বুড়িগঙ্গা, তুরাগ নদীর তীরঘেঁষে ওয়ার্ক ওয়ে নির্মাণ ও বৃত্তাকার নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা, নদ-নদী রক্ষায় সরকারের এসব কর্মপরিকল্পনা সঠিকভাবে দ্রুত বাস্তবায়ন হবে। তাহলে নদী বাঁচবে, রক্ষা পাবে জীববৈচিত্র্য, বাড়বে নদীকেন্দ্রিক যাতায়াত, পর্যটন, ব্যবসা-বাণিজ্য, গতি আসবে দেশের অর্থনীতিতে।

লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, শিক্ষার্থী-নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close