মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ
মতামত
জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চায় গ্রন্থাগার
![](/assets/news_photos/2024/03/05/image-445196.jpg)
সময় বড্ড দ্রুত পাল্টায়। তার চেয়েও তাড়াতাড়ি বদলায় মানুষের মনের চাহিদা। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে যারা লেখাপড়ার গণ্ডির মধ্য থেকে বেড়ে উঠেছেন, শিক্ষায়তনকে তাদের মনে হতো একান্ত আপন। স্কুলের সহপাঠী, বন্ধু-বান্ধবের মতোই আকর্ষণ ছিল শিক্ষকদের প্রতি। কড়া শাসনের মধ্যেও শিক্ষকরা ছিলেন বন্ধুর মতো। তারা সবাই ক্লাসে হাতে করে এক গাদা বই নিয়ে আসতেন। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি থাকত সুখপাঠ্য গল্পের বই। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইয়ের বাইরে ওইসব বই পড়তে উৎসাহিত করতেন। সেই সময়ে স্কুলে শিক্ষার্থীদের জন্য বড় ধরনের বিশেষ কোনো গ্রন্থাগার না থাকলেও প্রায় সব সরকারি স্কুলে, বিশেষ করে জেলা শহরের স্কুলগুলোতে শিক্ষকদের বসার ঘরে বড় আলমারিতে বেশ কিছু বই থাকত। শিক্ষকরা সেখান থেকে বই নিয়ে নিয়মিত পড়াশোনা করতেন। অবসর সময়ে শিক্ষকদের মধ্যে আলোচনা হতো শিক্ষার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। শিক্ষকের বসার কক্ষে ছাত্রদের যাওয়ার তেমন সুযোগ ছিল না। তবে শিক্ষকদের কাছে গিয়ে যেকোনো বিষয়ে প্রশ্ন করতে কোনো বাধা ছিল না। জানার আগ্রহকে শিক্ষকরা সব সময়ই উৎসাহিত করতেন। তখনকার দিনে একেকজন শিক্ষক ছিলেন পণ্ডিত ব্যক্তি। তারা সবাই প্রতিটি বিষয় ভালো পড়াতে পারতেন। কলেজে লেখাপড়ার পরিধি ছিল আরো বিস্তৃত। কলেজের কৃতী শিক্ষকরা কলেজ লাইব্রেরি এবং বাইরের যেকোনো পাঠাগারে গিয়ে বই পড়তে প্রাণিত করতেন। ষাটের দশকে বরিশাল জেলা স্কুলে একজন আমেরিকান শিক্ষক এসেছিলেন কোনো একটি সরকারি প্রকল্পের অধীনে। তিনি সম্ভবত দু-বছর এ দেশে ছিলেন। সারা দিন তিনি শিক্ষক-লাইব্রেরিতে পড়ে থাকতেন। আর অবসরে শহরের বিভিন্ন স্থানে বই পড়ার জন্য ছুটে বেড়াতেন। এ দেশে তার অবস্থানকে অনেকে ভালো চোখে দেখেননি। তিনি চলে যাওয়ার পরে শুনেছি, বাংলাদেশে তিনি জীবনানন্দ দাসের ওপর গবেষণায় ব্যস্ত ছিলেন এবং নিজ দেশে ফিরে তিনি জীবনানন্দ সাহিত্যের ওপর ডক্টরেট করেছেন। সেখানকার কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ জীবনানন্দ সাহিত্য পড়ানো হচ্ছে এবং বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীরা ওই বিষয়ে পিএইচডি করছে।
লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগার বলতে একটি কক্ষকে বোঝায়, যেখানে বই সংগ্রহ করে রাখা হয়। গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার ইতিহাস অনেক প্রাচীন। ভাষা সৃষ্টির পূর্ব থেকেই গ্রন্থাগারের অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া যায়। মুদ্রিত বই-পুস্তক না থাকলেও গ্রন্থাগার ছিল তখন প্রাচীন যুগ থেকে। নিম্ন মেসোপটেমিয়ার প্রাচীন রাজবংশীয় রাজাদের ইতিহাস লেখা শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব মধ্য-তৃতীয় সহস্রাব্দে কীলকাকার বর্ণমালা দিয়ে। এরই ধারাবাহিকতায় বেবিলনীয় সাম্রাজ্যের সময় শহর এবং মন্দিরগুলোতে গ্রন্থাগার গড়ে ওঠে। সেই সময় পুরুষ এবং নারী উভয়ই পড়তে ও লিখতে জানত। খ্রিস্টের জন্মের পাঁচ হাজার বছর আগে মিসরে গ্রন্থাগারের অস্তিত্ব ছিল। প্রাচীন গ্রিসেও লাইব্রেরির অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। একটি লাইব্রেরি মানুষের অজানা এবং অদেখা সম্পর্কে জ্ঞানদান করে। কল্পনাজগৎকে অবারিত করে দেয়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে’। অষ্টম থেকে একাদশ শতক পর্যন্ত বৌদ্ধ বিহারগুলো ছিল বিদ্যাচর্চার কেন্দ্রস্থল। সে সময় বৌদ্ধ আচার্যরা অনেক তত্ত্বমূলক গ্রন্থ রচনা করেছেন, যা আজ বিলুপ্তপ্রায়। তবে চীন, তিব্বত ও মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন গ্রন্থাগারে সেসব গ্রন্থের কিছু অনুবাদ সংরক্ষিত হয়েছে। মানবসভ্যতার ইতিহাসের সঙ্গে লাইব্রেরি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মিসরের আলেকজান্দ্রিয়ার অতি প্রাচীন বিশাল লাইব্রেরিতে সাত লাখ গ্রন্থের সংগ্রহ রয়েছে বলে জানা যায়। এসব গ্রন্থ গ্রিস, পারস্য, মিসর, ভারতসহ অন্যান্য স্থান থেকে সংগৃহীত। বিশ্বখ্যাত বাগদাদের ‘বাইতুল হিকমা’ (জ্ঞানের ভাণ্ডার) লাইব্রেরি স্থাপিত হয় ৮৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। এত ধ্বংসযজ্ঞের পরে আজও বাগদাদের মুতানব্বি স্ট্রিটে বহু পুরোনো গ্রন্থের সমারোহ দেখতে পাওয়া যায়। এ ছাড়া স্পেন, রোম, চীন, এথেন্সেও বহু পুস্তক-সংবলিত লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অতি প্রাচীনকালে।
একসময় বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে নানা রূপে গ্রন্থাগারের ব্যবহার ছিল ব্যাপকভাবে। ব্যক্তি হিসেবেও অনেকে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন, নিজে বই পড়ে জ্ঞানের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে বিশ্বনন্দিত হয়েছেন। বই এবং লাইব্রেরিকে নিজের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রাখা একজন বিরলপ্রাণ মানুষ হলেন ১৯০০ সালের ১৭ ডিসেম্বর জন্ম নেওয়া বরিশালের লামচরির আরজ আলী মাতুব্বর। স্বশিক্ষিত দার্শনিক, মানবজীবন, প্রকৃতি-পরিবেশ, জড়জগৎ ও বিশ্বসংসার থেকে পাঠ গ্রহণ করেন। বই পড়তে তিনি বরিশালের সব লাইব্রেরি চষে বেড়ান, জ্ঞান আহরণে নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন। ৮৬ বছরের জীবনকালে ৭০ বছরই তিনি লাইব্রেরিতে কাটিয়ে দিয়েছেন। নিজস্ব মতবাদ গড়ে তোলেন দার্শনিক, চিন্তাবিদ, লেখক আরজ আলী মাতুব্বর। লেখেন ‘সত্যের সন্ধান (১৯৭৩), সৃষ্টিরহস্য (১৯৭৭), অনুমান (১৯৮৩) ও মুক্তমন (১৯৮৮)। পান বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্যপদ (১৯৮৫)। এ ছাড়া বহু পুরস্কার এবং সম্মাননায় ভূষিত হন মানবতাবাদী আরজ আলী মাতুব্বর। জ্ঞান বিতরণের জন্য তার অর্জিত সম্পদ দিয়ে বাড়িতে গড়ে তোলেন ‘আরজ মঞ্জিল পাবলিক লাইব্রেরি’। তার প্রতিষ্ঠিত লাইব্রেরিতে রয়েছে অনেক দুর্লভ গ্রন্থ।
শখের বসে ষাটের দশকে অনেকে নিজ উদ্যোগে বাড়ির কক্ষে সবার জন্য উন্মুক্ত ছোট্ট পাঠাগার গড়ে তোলেন। দু-তিনটা আলমারিতে থাকত নতুন-পুরান কিছু বই, লম্বা একটা টেবিল ঘিরে দু-চারটা চেয়ার। পাড়ার অনেকেই প্রতিদিন লাইব্রেরিতে গিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো বই পড়তে পারতেন। বেশির ভাগ জেলা শহরে তখন ছিল ছিল ইউএসআইএস লাইব্রেরি। ইউএসআইএসে বসে বেশ কিছু ইংরেজি বই এবং ইংরেজি বইয়ের অনুবাদ পড়ার সুযোগ মিলত। শহরের কোথাও ছিল সরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত পাবলিক লাইব্রেরি। তখনকার দিনে বই পড়ার প্রতি সব বয়সের মধ্যে মানুষের প্রবল আগ্রহ লক্ষ করা যেত। ষাটের ঢাকায় কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি ঘিরে ছিল বইপ্রেমীদের প্রধান আড্ডার জায়গা। ভার্সিটি ক্যাম্পাসে এসে পাবলিক লাইব্রেরিতে বই পড়ে, শিক্ষাবিষয়ক নানা আলাপচারিতায় মুখর হতেন যুবসমাজ। এরপর ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে প্রেক্ষাপট। সেসব লাইব্রেরি হারিয়ে যায় ক্রমেই। ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত গ্রন্থাগারগুলো ক্রমেই হারিয়ে যেতে থাকে। ইউএসআইএস লাইব্রেরি বিলুপ্ত হয়ে যায়। লাইব্রেরি বলতে মানুষ বুঝতে শুরু করে ‘বইয়ের দোকান’! শহরের রাস্তায় লাইব্রেরির বদলে শুধু দেখা মেলে ভিডিও ক্লাবের ছড়াছড়ি। ১৯৯০ থেকে ২০০০ সালে ইন্টারনেটের প্রচলনে বই-পুস্তক, তথ্য সংগ্রহের মাধ্যম হিসেবে সবকিছু কম্পিউটার আর সেলফোনের মধ্যে জায়গা করে নিল। ইলেকট্রনিক মিডিয়া গ্রাস করতে থাকে প্রিন্ট মিডিয়াকে। ফেসবুক, ইউটিউব যেন গোটা সাম্রাজ্য দখল করে নেয়। সব ধরনের লেখাপড়া আজ অনলাইনে চলে।
কিন্তু গ্রন্থাগারকে ঠেলে দিয়ে আজও একেবারে নিঃশেষ করে দিতে পারেনি কেউ। বিজ্ঞানের সহায়তায় উন্নতমানের পাঠাগার প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। ঢাকার কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি ছাড়াও বাংলা একাডেমি গ্রন্থাগার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, এশিয়াটিক সোসাইটি লাইব্রেরি, ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি রয়েছে। রাজধানীর বাইরে রাজশাহী, খুলনা ছাড়ার অন্যান্য শহরে সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত কিছু লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিশেষ করে, ঢাকার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের প্রচলন করে আলোকিত মানুষ গড়ার প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়। প্রতি বছর পুরো ফেব্রুয়ারিতে চলে অমর একুশের বইমেলা। বাংলা একাডেমি চত্বর ছাড়িয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল পরিসর জুড়ে জমে ওঠে এই বইমেলা। প্রতি বছর কত বই ছাপা হয় প্রতিবারের বইমেলায়। শিশু-কিশোররা তাদের প্রিয় বইটি খুঁজে ফেরে মেলার স্টলে স্টলে। একুশের গ্রন্থমেলার কলেবর বাড়ছে বছর বছর। বই প্রকাশের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজধানীর বাইরে শহরে শহরে জমে উঠছে একুশের গ্রন্থমেলা। কলকাতার বইমেলায় পুস্তকপ্রেমীদের যথেষ্ট ভিড় দেখা যায়। এমন এক দিন নিশ্চয়ই আসবে, যেদিন একুশের গ্রন্থমেলাকে ঘিরে মানুষের মধ্যে আবার নতুন করে পাঠাভ্যাস গড়ে উঠবে। বই পড়ার আগ্রহ বাড়লেই তো বিস্তৃত হবে গ্রন্থাগার।
গ্রন্থাগারের বইয়ের বিপুল ভাণ্ডারে সঞ্চিত থাকে মানবসভ্যতার শত বছরের ইতিহাস। গ্রন্থাগার গড়ে তোলে মানুষের অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যতের মাঝে এক দৃঢ় সেতুবন্ধ। বর্তমান সময়ে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে বই সংরক্ষণ, পাঠকের মাঝে বিতরণ করে পুরো পাঠাগার কার্যক্রম পরিচালনা সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তাই নতুন প্রজন্মের মধ্যে বই পড়ার উন্মেষ ঘটাতে দেশের প্রতিটি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে হবে সমৃদ্ধ লাইব্রেরি। সেখানে নিয়মিত পড়ে ওদের জ্ঞানের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করার সুযোগ করে দিতে হবে। শিক্ষাক্রমে লাইব্রেরি-ওয়ার্ককে করতে হবে বাধ্যতামূলক। ঘরের আলমারি শো-পিসের বদলে ভরে রাখতে হবে নিত্যনতুন বইয়ে। নতুন বইয়ের মিষ্টি গন্ধে মনে প্রাণশক্তির সঞ্চার হবে। মানুষ বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে প্রিয়জনকে বই উপহার দেবেন। বয়স নির্বিশেষে সবাই ফিরে আসবেন পড়ার টেবিলে। বাবা-মা, অভিভাবক তাদের সন্তানদের পুস্তক পাঠে উৎসাহিত করবেন। কিনে দেবেন নিত্যনতুন সুখপাঠ্য বই। পাড়া-মহল্লায় পুস্তকপ্রেমীরা একত্র হয়ে নিজেদের ঘরের পুরোনো বই দিয়ে পাড়ার যেকোনো একটি কক্ষে লাইব্রেরি গড়ে তোলার কাজটি শুরু করতে পারেন। তাদের দেওয়া সামান্য অনুদানের অর্থ দিয়ে ধীরে ধীরে কেনা যেতে পারে নতুন কিছু বই। এভাবে অন্যরাও পাঠাগারের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে এর পরিসর বৃদ্ধিতে এগিয়ে আসতে পারেন। দেশের কিশোরশ্রেণি ফেসবুকের নেশা ছেড়ে বই পড়ায় মনোযোগী হয়ে উঠবে। পাঠাগারের বৃহত্তর উন্নয়নে সরকারের সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। উধাও হয়ে যাওয়া পাঠাগার আবার মুখরিত হয়ে উঠবে দেশের গ্রাম-শহরের পাড়া-মহল্লা। পাঠাগার নতুন প্রজন্মকে আলোর মুখ দেখাবে। নিত্যনতুন গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা, বৃহত্তর জনগণের মাঝে পাঠাগার ব্যবহারে
জ্ঞানার্জন দেশে সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী
"