খন্দকার আপন হোসাইন

  ০৪ মার্চ, ২০২৪

মুক্তমত

অ্যারন বুশনেলের আত্মহনন ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি

গাজায় পাঁচ মাস ধরে চলা ইসরায়েলের তাণ্ডবে আমেরিকাসহ গোটা পৃথিবীর সাধারণ নাগরিক খুবই অসন্তুষ্ট। ‘প্যালেস্টাইনকে মুক্ত কর’ ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে আত্মাহুতি দেওয়া অ্যারন বুশনেল আমেরিকার সাধারণ নাগরিকদের মানবিক চিন্তনের পরোক্ষ প্রতিনিধি। রবিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪) ওয়াশিংটন ডিসিতে ইসরায়েল দূতাবাসের প্রবেশপথে নিজের গায়ে আগুন দিয়ে অ্যারন বুশনেল বিশ্বমানবতা জাগ্রত করার চেষ্টা করেছে। সেই চেষ্টা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে যুক্তরাষ্ট্রের একটি গোয়েন্দা সংস্থা বুশনেলকে মানসিক কষ্টে ভোগা একজন ব্যক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। আবার পেন্টাগন প্রেস সেক্রেটারি প্যাট্রিক এস রাইডার বুশনেলের মৃত্যুতে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমাদের বাইডেন প্রশাসনের সমর্থন ইসরায়েলের আত্মরক্ষার সহজাত অধিকারের প্রতি লৌহবদ্ধ।’ অন্যদিকে মোসাদ কমেন্টারি নামক ইসরায়েলপন্থি এক টুইটার অ্যাকাউন্টে টুইট করা হয়েছে ‘আমাদের শত্রুরা নিজেরাই নিজেদের হত্যা করে’। এই টুইটের মাধ্যমে মার্কিন নাগরিকদের ইসরায়েলের শত্রু হিসেবে সরাসরি উল্লেখ করা হয়। বস্তুত অ্যারন বুশনেলের এই আত্মত্যাগ একটি ব্যর্থ প্রতিবাদ মাত্র। কেননা ২০২৩ সালের ১ ডিসেম্বর জর্জিয়ার আটলান্টায় ইসরায়েলি কনস্যুলেটের সামনে ফিলিস্তিনের পতাকা হাতে আত্মহত্যার মাধ্যমে এক ব্যক্তি প্রতিবাদ করেছিলেন। বিরূপ মনোভাবের কারণে আটলান্টা কর্তৃপক্ষ তার পরিচয় পর্যন্ত প্রকাশ করেনি।

বুশনেলের আত্মাহুতির চার দিন পেরিয়ে গেলেও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের দেশে দেশে ইসরায়েলের নারকীয় তাণ্ডববিরোধী আন্দোলন ত্বরান্বিত হয়নি। ২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর তিউনিশিয়ার সিদি বওজিদ শহরের শিক্ষিত বেকার যুবক তারেক আল-তাইয়্যেব মোহাম্মদ বোউয়াজিজি কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ সদস্যের রোষানলে পড়ে। বোউয়াজিজির অতি ক্ষুদ্র ফল ও সবজির দোকান থেকেও পুলিশ সদস্যরা চাঁদা দাবি করে। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে পুলিশ তার দোকান উল্টিয়ে দিয়ে চরম অপমান করে। অপমান, অসম্মান ও আত্মদহনের জ্বালায় অতি দুঃখে, কষ্টে, অভিমানে বোউয়াজিজি স্থানীয় সরকার কার্যালয়ের সামনে জনসম্মুখে নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। বোউয়াজিজির আত্মহত্যা বিফলে যায়নি। বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল দেশটির ৪০ শতাংশ বেকার যুবক। শিগগিরই সে আন্দোলন গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। ফলে ১৪ জানুয়ারি ২০১১ প্রেসিডেন্ট জাইন আল আবেদিন বেন আলির ক্ষমতা শেষ হয়। দেশটির রাজপথের সে আন্দোলন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল পৃথিবীর নানা প্রান্তে, রূপ নিয়েছিল দাবানলে। এরপর একে একে মিসর, বাহরাইন, জর্দান, ইয়েমেন, সিরিয়া, লিবিয়ায় এই দাবানল ছড়িয়ে পড়ে। এই দাবানলকে সে সময় আরব বসন্ত নামে অবহিত করা হয়েছিল। বোউয়াজিজির আত্মহননে আরব বসন্ত সৃষ্টি হলেও বুশনেলের আত্মহননে আমেরিকান বসন্ত সৃষ্টি হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

মূলত হিটলারের নাৎসি বাহিনী ইউরোপে প্রায় ৬০ লাখ ইহুদিকে হত্যা করার পর থেকেই ইহুদিদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনের উদ্যোগ জোরদার হয়। ইহুদিরাষ্ট্র গঠনে মরিয়া হয়ে ওঠে তৎকালীন ইহুদি নেতারা। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনকে ফিলিস্তিন তাদের জন্য বিপর্যয় মনে করে। এই বিপর্যয় উত্তরণেই ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে পালাক্রমে ১৯৪৮ সালে, ১৯৫৬ সালে, ১৯৬৭ সালে এবং ১৯৭৩ সালে মোট চারবার আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। চারবারই জয় পেয়েছে ইসরায়েল। চারবারের যুদ্ধ জয়ে ইসরায়েল অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী ও আগ্রাসী হয়ে ওঠে। ইসরায়েল রাষ্ট্রের সৃষ্টি ও আগ্রাসী ভূমিকায় নিজ দেশেই পরবাসী হয়ে গেছে ফিলিস্তিনিরা। ফিলিস্তিনির শিশুরা জন্মের পর থেকেই জীবনধারণের জন্য লড়াই করতে শিখে যায়। তাদের ধ্যান, জ্ঞান, চিন্তন ও মননে ঘুরে বেড়ায় একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্ন। তাদের মনে ইসরায়েলের প্রতি তীব্র ঘৃণা জন্মায় শৈশব থেকেই। কৈশোরে তা আরো দৃঢ় হয়। ফিলিস্তিনিরা তাদের স্বাধীন ভূখণ্ডের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে আমৃত্যু সংগ্রাম করাকেই ব্রত মনে করে। ইসরায়েলের অমানবিক, বর্বরোচিত ও নারকীয় হামলায় তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়, নষ্ট হয় চাষের ফসল, অনুর্বর হয় আবাদি জমি। জীবনযাত্রার মান নিম্ন থেকে নিম্নস্তরে চলে যায়। ফিলিস্তিন জনমনের তীব্র ঘৃণা, ক্ষোভ আর পুঞ্জীভূত অভিমান রূপান্তরিত হয় ক্রোধে। একদিকে নিজেদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা, অন্যদিকে প্রচণ্ড ইসরায়েলবিদ্বেষ ফিলিস্তিনি যুবকদের ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ও সশস্ত্র সংগঠন হামাসের সদস্য হতে আকৃষ্ট করে। রকেট নিক্ষেপ, বোমা নিক্ষেপ কিংবা ইসরায়েলি নাগরিক জিম্মি করে পিতৃহত্মা, ভাতৃহত্মার প্রতিশোধ নিতে চায় স্বাধীনতা হরণকারী ইসরায়েলের ওপর। আর তাই গত ৭ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে গাজা উপত্যকা থেকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড পরিচালনা করে হামাস। এ ঘটনার শোধ নিতে ২৭ অক্টোবর ২০২৩-এ ইসরায়েল গাজায় স্থল আক্রমণ শুরু করে। ২ নভেম্বর ২০২৩-এ ইসরায়েল গাজা শহর অবরোধ শুরু করে। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ৫ মাসে ৩১ হাজার ফিলিস্তিন নাগরিক নিহত হয়েছে। এখনো হত্যাযজ্ঞ চলমান রয়েছে।

ইসরায়েলি তাণ্ডব, বর্বরতা, হত্যাযজ্ঞ ও অমানবিক কর্মকাণ্ড যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি অদ্যাবধি সমর্থন করছে। ১৯৪৮ সাল থেকে চলমান ইসরায়েল-ফিলিস্তিন লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্র কখনোই স্বাধীন ফিলিস্তিনের ন্যায্য দাবিতে নৈতিক সমর্থন দেয়নি। এমনকি তারা ফিলিস্তিন জনগোষ্ঠীকে মানুষ হিসেবেই বিবেচনা করেনি। তারা ফিলিস্তিনিদের উপস্থাপন করেছে কুৎসিত সন্ত্রাসী হিসেবে। এই জনগোষ্ঠীকে বিশ্বের বোঝা হিসেবেই দেখানোর চেষ্টা করেছে। তাদের একপক্ষীয় গবেষণায় সর্বদা হামাস, হেজবুল্লাহকে ইসলামী জঙ্গিবাদ হিসেবেই উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে। আর তাই অগ্নিদগ্ধ অ্যারন বুশনেলের অশ্রুসিক্ত আহাজারি ‘প্যালেস্টাইন মুক্ত কর’ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে কড়া নাড়ে না। শাসকগোষ্ঠীর কর্তাব্যক্তিদের অনুভূতির অনুরণন হয় না।

লেখক : গবেষক ও সংগঠক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close