সাজ্জাদুল করিম

  ০৪ মার্চ, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

মানুষ

সম্প্রতি আমার এক সুহৃদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি চমৎকার মন্তব্য করেছেন। তার মন্তবক্ষ্যটি এ রকম- ‘ছোটবেলায় গরুর রচনা পড়েছিলাম, তাই গরু চিনতে ভুল হয় না। কিন্তু মানুষের রচনা পড়া হয়নি তাই মানুষ চিনতে এখনো ভুল হয়।’ তার মন্তবক্ষ্যটি হাস্যরসাত্মক মনে হলেও আসলে কথাটির অর্থ কিন্তু অনেক গভীর। সতিক্ষ্যই মানুষ চেনা রীতিমতো কঠিন কাজই বটে। এজনক্ষ্যই বোধ করি বিখক্ষ্যাত গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের ‘Know Thyself’ এই শব্দ দুটিকে তার মহামূল্যবান বাণী হিসেবে গণক্ষ্য করা হয়। একই কথা আরেক মনীষী অ্যারিস্টটলও বলেছিলেন, ‘Knowing yourself is the beginning of all wisdom’। তা ছাড়া মহাগ্রন্থ আল-কোরআনের প্রথম অবতীর্ণ আয়াতগুলোতেও (৯৬ : ১-৫) কিন্তু মানব সৃষ্টিতত্ত্ব ও তার স্রষ্টা সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ আত্মপরিচয় সম্পর্কে চিন্তাভাবনা তথা জ্ঞানার্জন করা যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ তা বলাই যায়। অথচ কত জ্ঞান-বিজ্ঞান, কত শিল্প-সাহিতক্ষ্য, কত ইতিহাস-ঐতিহক্ষ্য আমরা জানার চেষ্টা করি কিন্তু মানুষ সম্পর্কে বা নিজের পরিচয় সম্পর্কে আমাদের জানার আগ্রহ তেমন নেই। ফলে মানুষ চিনতে আমাদের ভুল হয়। তাই আমার আজকের লেখার বিষয় ‘মানুষ’।

২.

মানুষ কাকে বলে বা মানুষের সংজ্ঞা কীক্ষ ছোটবেলায় গরুর রচনা পড়তে গিয়ে আমরা বলতাম- গরু একটি গৃহপালিত চতুষ্পদ প্রাণী। যার চারটি পা, দুটি কান, দুটি চোখ, দুটি শিংবিশিষ্ট একটি মাথা ও একটি লম্বা লেজ আছে। একইভাবে মানুষের পরিচয় দিতে গিয়ে যদি বলা হয়, মানুষ একটি প্রাণী, যার দুটি হাত, দুটি পা, দুটি চোখ, দুটি কান, একটি নাক, একটি মুখ ও একটি মাথাবিশিষ্ট শরীর রয়েছে। এটুকু বললেই কি মানুষের সম্পূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায়। এর উত্তর হলো- না। তার কারণ শুধু মানুষের মতো শারীরিক কাঠামো বা অবয়ব থাকলেই তাকে মানুষ বলা যায় না। মানুষ হতে হলে প্রথমত মানুষের মতো আকার-আকৃতি, অঙ্গ-প্রতক্ষ্যঙ্গ, তন্ত্র, কলা-টিসক্ষ্যু ইতক্ষ্যাদি থাকতে হয়। দ্বিতীয়ত, আত্মা বা প্রাণ এবং তৃতীয়ত, মন থাকতে হয়। এই তিনটির সামষ্টিক রূপকেই মানুষ বলা যায়। আর এখানেই মানুষ নামের তাৎপর্য। প্রাণ থাকলেই আমরা তাকে প্রাণী বলি আর মানুষ হতে হলে প্রাণের সঙ্গে মনও থাকা আবশক্ষ্যক। অর্থাৎ মন আছে বলেই আমরা মানুষ। চলুন একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করি- একটি কম্পিউটার যেমন কিছু হার্ডওয়্যার (মনিটর, সিপিইউ, কি-বোর্ড, মাউস) ও সফটওয়্যারের (অপারেটিং ও অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার) সমন্বয়ে গঠিত, ঠিক একইভাবে মানুষও শরীর (হার্ডওয়্যার), আত্মা ও মন (অপারেটিং ও অক্ষ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার) এই তিনটির সমন্বয়ে সৃজিত একটি প্রাণী, যাকে অন্যসব সৃষ্টি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমি আদম সন্তানকে সম্মানিত করেছি, তাদের জলে-স্থলে চলাচলের জনক্ষ্য বাহন দিয়েছি, তাদের উত্তম জীবিকা (পবিত্র রিজিক) দিয়েছি এবং তাদের আমার অনেক সৃষ্টির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি (১৭ : ৭০)।’

৩.

মানুষের সবচেয়ে বড় স্বাতন্ত্র্য হলো তার মেধা, জ্ঞান, বুদ্ধি ইতক্ষ্যাদি। মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রই জ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কিত। অর্থাৎ যাপিত জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে মেধা, জ্ঞান-বুদ্ধি খাটিয়ে তাকে টিকে থাকতে হয়। যেমন- মানুষের প্রথম ও প্রধান মৌলিক চাহিদা ক্ষুধা নিবারণের জনক্ষ্য তাকে মেধা খাটাতে হয়। অনক্ষ্যানক্ষ্য সৃষ্টি বা পশু-পাখি যেখানে প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত খাবার সরাসরি গ্রহণ করে, মানুষকে সেখানে তার মেধা খাটিয়ে খাদক্ষ্য উৎপাদন, চাষ, খাদেক্ষ্যর উৎস সন্ধান, প্রক্রিয়াকরণ ইতক্ষ্যাদির মাধক্ষ্যমে তার খাদেক্ষ্যর সংস্থান করতে হয়। একইভাবে তার লজ্জা নিবারণ, বাসস্থান তৈরি, চিকিৎসাসহ জীবনের প্রয়োজনীয় সব উপকরণের জনক্ষ্য কত প্রযুক্তি, কত কলাকৌশল রপ্ত করতে হয়, কত জ্ঞান-বুদ্ধি খরচ করতে হয়। এজনক্ষ্যই মানুষকে এই মহাবিশ্বের একমাত্র বুদ্ধিমান প্রাণী বলা হয়। দ্বিতীয়ত, মানুষের আরেকটি আলাদা বৈশিষ্টক্ষ্য হলো- মানুষকে স্রষ্টা কিছু কিছু বিষয়ে স্বাধীনতা দিয়েছেন, যেখানে অন্যানক্ষ্য সৃষ্টি সম্পূর্ণরূপে একটি নিয়মের অধীন। মানুষ প্রকৃতিগতভাবে কিছু বিষয়ে (জন্ম-মৃত্যু, বেড়ে ওঠা, বিভিন্ন জৈবিক বিষয়াবলি ইতক্ষ্যাদি) নিয়মের অধীন ঠিকই, তবে তার কর্মের স্বাধীনতা রয়েছে। তৃতীয়ত, মানুষের রয়েছে চিন্তা ও কল্পনা করার ক্ষমতা। মানুষই একমাত্র সৃষ্টি যে তার জৈবিক চোখ ছাড়াও কল্পনার চোখ দিয়ে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের অনেক কিছু দেখতে পারে। চতুর্থত, মানুষের আরেকটি উল্লেখযোগক্ষ্য বৈশিষ্টক্ষ্য হলো, সে তার মনের ভাব, চিন্তা-কল্পনাকে ভাষায় প্রকাশ করতে পারে। আবার সেই ভাবকে প্রতীক, সংকেত বা চিহ্নের মাধক্ষ্যমে লিপি আকারেও প্রকাশ করতে পারে, যা এই মহাবিশ্বে অন্য কোনো সৃষ্টির পক্ষে সম্ভব নয়। সর্বোপরি, মানুষকে এই সৃষ্টি জগতের অনেক কিছুর ওপর আধিপতক্ষ্য করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

৪.

তবে এই বৈশিষ্টক্ষ্যগুলোই মানুষের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় বহন করে না। কারণ মানুষের মাঝে একাধারে দুটি বিপরীতমুখী বৈশিষ্টক্ষ্য রয়েছে- মনুষক্ষ্যত্ব ও পশুত্ব। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে একদিকে যেমন সৃষ্টির সেরা হওয়ার মতো গুণাগুণ দিয়েছেন, অনক্ষ্যদিকে তার মধ্যে এমন কিছু প্রবৃত্তি দিয়েছেন, যা তাকে মহাবিশ্বের নিকৃষ্টতম অবস্থায় পৌঁছে দিতে পারে। (আল-কোরআন, ৯৫ : ৪-৫) আর বিপরীতমুখী এই দুটি স্বভাবের মধ্যে, যার মধেক্ষ্য যেটির আধিকক্ষ্য পরিলক্ষিত হয় সে সেই দলভুক্ত। সুতরাং মানুষ হিসেবে পরিচয় দেওয়ার সবচেয়ে বড় উপাদান হলো ‘মনুষক্ষ্যত্ব’। আর মনুষক্ষ্যত্ব হলো সেসব গুণাবলির সমষ্টি (দয়া-মায়া, প্রেম-ভালোবাসা, মহানুভবতা, উদারতা, জ্ঞান-বুদ্ধি, বিবেকবোধ, চিন্তাশীলতা, সভ্যতা, সৌন্দর্যবোধ, শৃঙ্খলা-নিয়মানুবর্তিতা, পরিচ্ছন্নতা, সহিষ্ণুতা, সহানুভূতি, লজ্জাশীলতা ইত্যাদি), যা মানুষকে অন্যসব প্রাণী বা সৃষ্টি থেকে আলাদা করেছে। মানুষকে একদিকে যেমন ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ হিসেবে আখক্ষ্যায়িত করা হয়, আবার এই মহাবিশ্বের হেন অপকর্ম নেই, যা মানুষের দ্বারা সংঘটিত হয় না। তাই তো আমরা দেখি হতক্ষ্যা-মারামারি, যুদ্ধ-বিগ্রহ, প্রাকৃতিক বিপর্যয় (বৃক্ষ নিধন, পাহাড়ধস, কার্বন নিঃসরণ, জলাশয় ভরাট ইতক্ষ্যাদি), পরিবেশ (বায়ু, পানি, মাটি) দূষণসহ জলে-স্থলে যত ধরনের অনিষ্ট সবই মানুষেরই কর্ম।

মোদ্দাকথা, মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচায়ক হলো ‘মনুষক্ষ্যত্ব’। মনুষ্যত্বহীন ব্যক্তি আকারে অবয়বে মানুষের মতো দেখালেও আদতে সে মানুষ নয়। আর এদের জনক্ষ্যই ‘অমানুষ’ শব্দটির উদ্ভব ও প্রয়োগ। তাই তো বলা হয়- There is a big difference between Human Being and being Human.

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক ও জেলা লাইব্রেরিয়ান, শেরপুর

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close