হাবিব উল্লাহ রিফাত

  ০২ মার্চ, ২০২৪

মুক্তমত

ন্যাম কেন প্রাসঙ্গিক প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

বলা হয়ে থাকে, বঙ্গবন্ধুর কূটনীতিক চিন্তাধারাই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি; যা একুশ শতকের তৃতীয় দশকেও প্রাসঙ্গিক। মাল্টিপোলারকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থায় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য ‘ন্যাম’ কেন প্রয়োজন? তা এখন মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন।

বলা ভালো, গত শতাব্দীর বিশ্বরাজনীতি ছিল আপাদমস্তক ঘটনাবহুল বললে অত্যুক্তি হবে না। বিংশ শতাব্দীর প্রাক্কালে পরপর দুটো মহাযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে বেশ কিছু ঘটনা বিশ্বরাজনীতির পটপরিবর্তনে বেশ জোরালো ভূমিকা রেখেছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম নির্ধারক হলো জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন তথা ‘ন্যাম’ (NAM) প্রতিষ্ঠা।

সম্প্রতি ১৯তম ন্যাম সামিট অনুষ্ঠিত হয়েছে উগান্ডার রাজধানী কাম্পালায়। সাধারণত তিন বছর অন্তর এই শীর্ষ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়। গেল ১৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত পাঁচ দিনের এই সামিটে ১২০টি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। এই সম্মেলনে বর্তমান বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলায় ন্যামের সদস্য রাষ্ট্রসমূহের মিলিত প্রচেষ্টার বিষয়টির ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে চলমান ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল সংঘাতের প্রসঙ্গও উঠে আসে। বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্যদূরীকরণ ও টেকসই উন্নয়ন এবং ‘ন্যাম’-এর জোটনিরপেক্ষতা বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয় ওই সম্মেলনে।

জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন (ন্যাম) হচ্ছে কোনো শক্তির সঙ্গে জোট না বেঁধে প্রতিটি দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়া- এই মূলনীতির ভিত্তিতে ১৯৬১ সালে তৎকালীন যুগোস্লাভিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে জন্ম হয় জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন তথা ন্যামের। এ আন্দোলন গড়ার মূল নায়ক ছিলেন যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট জোসেফ ব্রোজ টিটো, ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, মিসরের প্রেসিডেন্ট গামাল আবদুল নাসের, ঘানার প্রথম প্রেসিডেন্ট খোয়ামে এনক্রুমা এবং ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুকর্ণ। মূলত ন্যাম প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী শাসন থেকে মুক্ত তৃতীয় বিশ্বের এশীয় দেশগুলো বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে একটি সুসামঞ্জস দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে চেয়েছিল।

বস্তুত উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে মুক্তিসংগ্রাম, যেকোনো দেশ বা গোষ্ঠীর একাধিপত্যের প্রয়াসকে প্রতিরোধ করা, স্বাধীনরাষ্ট্রের স্বার্বভৌমত্বের ওপর অযাচিত হস্তক্ষেপ রোধ করা, ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠা, সাম্রাজ্যবাদ ও নব্য উপনিবেশবাদকে প্রতিরোধ করা, শরিক দেশগুলোর নিজস্ব উন্নতি, জোটনিরপেক্ষতা বজায় রাখা, জাতিসংঘের কাজের সঙ্গে সমন্বয় করা এবং প্রতিটি দেশকে তার স্বনির্বাচিত পথে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ দেওয়া- এগুলোই ছিল জোট-নিরপেক্ষতার অন্যতম প্রেরণা।

বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালে ন্যাম-এর সদস্যপদ লাভ করে। সে বছরই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত ন্যাম-এর ৪র্থ শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে। ন্যাম সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু তার দ্বীপ্ত কণ্ঠে বিশ্বব্যপী নির্যাতিত ও শোষিত মানুষের পক্ষে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরেছিলেন। তিনি শোষিত মানুষের পক্ষে বাংলাদেশের অবস্থান ব্যক্ত করে একটি শান্তিপূর্ণ ও শোষণমুক্ত পৃথিবী নির্মাণে ন্যামের সদস্যরাষ্ট্রসমূহকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

জাতিসংঘের অব্যবহিত পরেই দ্বিতীয় বৃহত্তম বহুপক্ষীয় ফোরাম ন্যাম-এ বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের অংশগ্রহণ আন্তর্জাতিক আসরে বাংলাদেশের অবস্থানকে জোরদার করেছে। ন্যাম-এর ১৯তম শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা, বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অবদান, পরমাণু অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণে বাংলাদেশের অঙ্গীকার, ফিলিস্তিনি জনগণসহ বিশ্বব্যাপী শোষিত মানুষের পক্ষে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরা সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী এসডিজি বাস্তবায়নে South-South Cooperation-এর ভূমিকার বিষয়টিও তুলে ধরেছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, রোহিঙ্গা সমস্যাসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ন্যামের সদস্যরাষ্ট্রসমূহের একযোগে কাজ করার বিষয়গুলো বিশ্ববাসীকে অবহিত করা সম্ভব হয়েছে। বিশেষ করে, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘের পাশাপাশি ন্যাম-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

সমসাময়িক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিষয়ের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু তনয়ার হাত ধরে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক সাফল্যসহ দারিদ্র্যদূরীকরণ, চিকিৎসাসেবা, নারী উন্নয়ন, লিঙ্গসমতা নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশের অর্জনসমূহ বিশ্ব দরবারে ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রদত্ত নিরপেক্ষতার নীতির অনুসারী হিসেবে বাংলাদেশ নিয়মিতভাবে ন্যাম-এ সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছে এবং এরই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী ১৯তম ন্যাম সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন।

বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি দেশ ‘ন্যাম’-এর প্রতিনিধিত্ব করে। পরিবর্তিত বিশ্বরাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন কতটুকু প্রাসঙ্গিক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। চলমান রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত, এশিয়া প্যাসিফিকে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে চীন-মার্কিনি দ্বৈরথ ইত্যাদি বিষয়ে ন্যাম একটি সক্রিয় চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী হিসেবে তার আন্দোলনকে বেগবান রাখতে পারে। বলাবাহুল্য, শক্তিসাম্যের কথা বিবেচনায় রেখে কোনো বলয়ের অধীনে না গিয়ে বাংলাদেশকে তার জোটনিরপেক্ষতার নীতিতে অটল থাকা জরুরি। এ ক্ষেত্রে ন্যামকে অধিকতর কার্যকর করার বিষয়টি ফুটে উঠবে, যা ন্যামে বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় ভূমিকাকে সুদৃঢ় করবে।

সর্বোপরি, ন্যাম রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ নানামুখী সমস্যা সমাধান ও উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close