মো. সাখাওয়াত হোসেন

  ০১ মার্চ, ২০২৪

মতামত

নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে শেখ হাসিনা

ক্ষমতায়নের প্রত্যয়ের ব্যাপারে আমাদের সবার কমবেশি ধারণা রয়েছে। ক্ষমতায়নকে নানাভাবে স্বীকৃতি দেওয়া যায়। কেন না ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষমতায়নের রকমফের হয়ে থাকে। বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের আলোচনা সামনে এলেই শেখ হাসিনার সরকারের ভূমিকা ও অবদানের কথা সামনে চলে আসে। বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় স্থানে অবস্থান করছে, যা ইত্যবসরে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এবং নারীদের প্রকৃত মূল্যায়নের মানসে শেখ হাসিনার অনস্বীকার্য অবদানের ব্যাপারে আমরা সবাই অবগত। পুরো পৃথিবীতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নারীর ক্ষমতায়নে কাজের স্বীকৃতস্বরূপ সম্মানজনক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন এবং বাংলাদেশের সম্মান ও মর্যাদাকে গৌরবময় করেছেন।

শেখ হাসিনার ইতিবাচক পদক্ষেপের কারণে নারীরা শিক্ষা-দীক্ষায় যেমন এগিয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে কর্মক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য হারে অংশগ্রহণ করছে। বিভিন্ন চাকরির ফলাফলে পুরুষদের পেছনে ফেলে নারীদের দৃপ্তময় চলা নারীর ক্ষমতায়নকে মূলত তুলে ধরে। সরকারি-বেসরকারি প্রত্যেকটি জায়গায় নারীদের যথার্থ অংশগ্রহণ মূলত নারীর ক্ষমতায়নের পরিচায়ক। ক্ষমতায়নের মাত্রা নানাভাবে প্রভাবিত ও মূল্যায়িত হতে পারে। ধরা যাক নারীদের শিক্ষা-দীক্ষায় উদ্বুদ্ধ করে পরিপূর্ণ শিক্ষায় শিক্ষিত করে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে তৈরি করতে হয়েছে। নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নারীদের জাগরণের জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। অর্থাৎ খোলস ছেড়ে বেরিয়ে পৃথিবীকে জানতে চাওয়ার মননে দীক্ষিত করেছিলেন, যার ফলে আজও বাংলার নারীরা বেগম রোকেয়াকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন। কেননা তিনিই প্রথম আহ্বান জানিয়েছিলেন শিক্ষাগ্রহণের। আদতে শিক্ষিত মানবসম্পদ তৈরিতে শিক্ষিত মায়ের বিকল্প নেই। নেপোলিয়ান বলেছিলেন, আমাকে শিক্ষিত মা দাও; আমি তোমাদের শিক্ষিত জাতি উপহার দেব। একটি ঘর থেকেই কিন্তু একটি সংসারের রূপান্তর হয় এবং এই রূপান্তরে নারীর অনস্বীকার্য ভূমিকাকে আমরা স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠাবোধ করে থাকি। ঘর থেকে সংসারে রূপান্তরে একজন নারীর সীমাহীন ত্যাগের চিত্র নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো ভাবালেশ নেই। একজন শিক্ষিত মা তার সন্তানদের সুনাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে যে নিরলস পরিশ্রম ও ত্যাগের মুখোমুখি হন পৃথিবীর অন্য কারোর পক্ষে তেমনটি আর সম্ভব নয়। কাজেই নারীকে মূল্যায়ন করতে হবে, কাজের স্বীকৃতি দিতে হবে। সে লক্ষ্যেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারীদের শিক্ষাগ্রহণ ও চাকরিতে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন এবং এর সুফল পাচ্ছে বাংলাদেশ এবং এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অগ্রযাত্রা।

নারীর ক্ষমতায়নের ব্যাপকতায় বাংলাদেশ যেমনভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে ঠিক, তেমনিভাবে বিশ্বব্যাপী এর একটি রেশ রয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন যেহেতু একটি প্রতিষ্ঠিত রূপ পেয়েছে এবং বাস্তবিক-অর্থে দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে, সেহেতু ক্ষমতায়নের বাস্তবতাকে বহুমুখী করার চিন্তা করছেন বিশ্লেষকরা। কেননা দেখা যায়, একটি বিষয় নিয়ে যখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর সেটি স্বীকৃতি পায়, তখন সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে বহুমাত্রিকতার স্বরূপ সামনে নিয়ে এসে আলোচনা করা হয়। বিশেষভাবে বললে বলা যায়; ক্ষমতায়ন প্রত্যয়টি মূলত শুরুতে যে চিন্তা-চেতনা করে সামনে উন্মোচিত হয়েছিল, কালক্রমে সেটি ভিন্নরূপ পায়। সে কারণেই মূলত রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে।

প্রধানমন্ত্রী শুরু থেকেই প্রত্যেকটি জায়গায় ক্ষমতায়নের চর্চা করেছেন। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পরিচালনায় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ হিসেবে নারীদের বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব প্রদান করেছেন। দলের প্রেসিডিয়ামে তিনি নারী নেত্রীদের জায়গা করে দিয়েছেন। জেলা-উপজেলায় তিনি নারীদের কাজের যথার্থ মূল্যায়ন সাপেক্ষে দল থেকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। দলের গুরু দায়িত্ব প্রদান করেছেন। এর সবকিছুই শেখ হাসিনার নেতৃত্বের দৃঢ়তা ও প্রাজ্ঞতার পরিচায়ক। তিনি তার পরিবার থেকে যে শিক্ষা পেয়েছেন, রাজনৈতিক জীবনে সেসব কাজে লাগানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব দলের ক্রান্তিলগ্নে যে ধরনের সাহসী ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন সেসব দৃষ্টান্ত দেখে তিনি উজ্জীবিত হয়েছেন এবং রাজনীতিতে নারীদের প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোতে নারীর অংশগ্রহণ তুলনামূলক কম হলেও আওয়ামী লীগের চিত্র ভিন্ন। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে রাজনৈতিক দলে ৩৩ শতাংশ নারী কোটা পূরণের ক্ষেত্রে যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে, তা পূরণে তুলনামূলক শীর্ষে রয়েছে দলটি। গত এক দশকে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগে নারী নেতৃত্ব বেড়েছে দ্বিগুণ। ২০১২ সালের ২৯ ডিসেম্বর ১৯তম সম্মেলনের মাধ্যমে গঠিত আওয়ামী লীগের কমিটিতে ১৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ, অর্থাৎ ১০ জন নারী ছিলেন। ১০ বছর পর ২০২২ সালের ২৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলনের পর নবগঠিত কমিটিতে নারী সদস্যের সংখ্যা ২০ জন। ফলে নারী নেতৃত্বের হার হয়েছে ২৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এ জায়গায় দলের সভাপতি শেখ হাসিনার ইতিবাচক ভূমিকাই গুরুত্ব পেয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সমাজের যেকোনো পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়ন, অধিকার বেড়েছে অনেক। তেমনি রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে দলটি কাজ করে যাচ্ছে। তৃণমূলপর্যায়েও যাতে নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণ হয় তার নিমিত্তেই দলটি কেন্দ্র থেকে কাজ করে যাচ্ছে। তৃণমূলে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলো কাজ করে যাচ্ছে। আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় রাজপথের রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন মহিলা লীগ ও যুব মহিলা লীগে শতভাগ নারী নেতৃত্ব। অর্থাৎ আওয়ামী লীগে দলীয়ভাবে যেভাবে নারী নেতৃত্বদের গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, সেভাবে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিতে সরাসরি নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ প্রদান করছে দলটি।

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ১৯৮১ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। দলের চরম দুর্দিনে তিনি আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে সভাপতি হওয়ার আগ পর্যন্ত সংকটময় সময়ে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন এবং সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। ওয়ান-ইলেভেনের পর আওয়ামী লীগের ক্রান্তিকালেও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী (প্রয়াত), বেগম মতিয়া চৌধুরী, ডা. দীপু মনি, সাহারা খাতুন (প্রয়াত) ও শেখ ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পির (প্রয়াত) মতো অসংখ্য নারী নেতাকর্মী দলের জন্য বিশাল ভূমিকা রাখেন। ২০০৮ সালে হওয়া গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী, ২০২০ সালের মধ্যে সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সব পর্যায়ের ৩৩ শতাংশ নারী নেতৃত্ব নিশ্চিত করার বাধ্যবাধতা ছিল। তবে ওই সময়ের মধ্যে প্রায় কোনো দলই ইসির এ শর্ত পূরণ করতে পারেনি। ২০১৯ সালের ২১তম জাতীয় সম্মেলনে শেখ হাসিনা দলের সর্বস্তরের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী নেতৃত্ব নিশ্চিতের প্রস্তাব করেন। প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে অনুমোদন দেওয়া হয় এবং পরে আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রেও যুক্ত করা হয়।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রাপ্তদের মধ্যে ৮ শতাংশ ছিল নারী। দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৫০ শতাংশই নারী। আবার ভোটারের হিসেবেও নারী-পুরুষের অনুপাত প্রায় সমান। তারপরও রাজনীতির মাঠে বরাবরই পিছিয়ে নারীরা, নারীদের রাজনীতিতে সমান অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিতে কাজ করে যেতে হবে। গত নির্বাচনে ১৮টি আসনে নারী প্রার্থীরা নৌকা প্রতীকে ভোট করেছিলেন। এবার আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মধ্যে ২৪ জন নারী মনোনয়ন পেয়েছেন। কাজেই একটি পরিবর্তন কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি এবং এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে ভবিষ্যতে রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পাবে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের উচিত হবে আওয়ামী লীগদলীয় প্রধান শেখ হাসিনার মনোভাব ও দূরদর্শী চিন্তা ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে শুধু সংরক্ষিত আসনের মধ্যে নারীদের সীমাবদ্ধ না রেখে রাজনীতিতে প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে জনগণের আস্থা অর্জনের সুযোগ প্রদান করা এবং সে মোতাবেক দলীয়ভাবে নারীদের উজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার ব্রতে অগ্রসরমান হওয়া। উপমহাদেশীয় রাজনীতিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, আগামী পৃথিবীতে রাজনৈতিক দলগুলো তা অনুসরণ করবে।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close