ইমরান হোসাইন

  ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

মুক্তমত

বাংলা ভাষার বিকৃতি ও তরুণ প্রজন্ম

ভাষা আন্দোলন বাঙালির ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের চেতনা থেকেই ৬ দফা, ১১ দফা ও পরে ১ দফা। এটিই বাঙালির প্রথম স্বাধীনতার প্রতীক। একুশে ফেব্রুয়ারি তার চিহ্ন। এরপর ৬৯ গণজাগরণের আন্দোলন থেকে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে মহান স্বাধীনতা অর্জন।

বাঙালিদের স্বাধীনতার সূত্রপাত ভাষা আন্দোলন থেকেই শুরু। তাই একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি এলেই আমরা বিনম্র শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি বাঙালি জাতির সেই সূর্য সন্তানদের, যারা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে ছিনিয়ে এনেছিল বাংলা ভাষার সম্মান, প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই মাটিতে বাংলাদেশের নাম। ভাষা আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছিলেন আবদুস সালাম, আবুল বরকত, জব্বার, রফিকউদ্দিন আহমেদ ও শফিউর রহমানসহ নাম না জানা অনেকে। প্রতি বছর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে বিশ্বব্যাপী শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ও বিভিন্ন আয়োজনের মধ্য দিয়ে তাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। কারণ পৃথিবীর একমাত্র ভাষা যার জন্যই প্রাণ দিয়েছিল বাঙালি জাতি, যা পৃথিবীতে বিরল।

কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি চলে গেলেই ভুলে যাই আমরা সারা বছর এই ভাষার ইতিহাস। শুধু ভুলেই যাই না বিদেশি ভাষায় আবদ্ধ হয়ে যাই। বিদেশিদের ভাষায় নতুন প্রজন্মদের মুখে বাংলা-ইংরেজি মিশ্রিত ভাষা কথা বলায় শেখাই। এতে করে কি নিজেদের ভাষাকে ছোট করা হচ্ছে না? বাংলা ভাষার চর্চা না করে ইংরেজি ভাষার প্রতি আবদ্ধ করছি বর্তমান প্রজন্মকে, এতে করে ধীরে ধীরে বাংলা ভাষার আবেগ, অনুভূতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক হারিয়ে ফেলছি আমরা। এখানেই সীমাবদ্ধ নয়, প্রায় সময়ই দেশের বিভিন্ন স্থানে বিলবোর্ড, উন্নত বা মানসম্মত হোটেল, রেস্তোরাঁ, অফিসসহ সব জায়গায় ভুল বানান ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাকে অপমান করা হচ্ছে।

শুধু তা-ই নয়, প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহারের এ যুগে আমরা প্রতিনিয়তই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিকৃতি ঘটাচ্ছি; যা বাহ্যিক দৃষ্টিতে আমাদের একটু স্মার্ট বানালেও নিশ্চিতভাবেই ভাষাকে অপমান করছি। বানানের ভুল ব্যবহার তো আমাদের কাছে খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, এমনকি বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যানার-বিজ্ঞপ্তিতেও মাঝেমধ্যে এ দৃশ্য দেখা যায়, এমনকি অনেক অফিসে আবার ইংরেজিতে বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করে, যা একেবারেই কাম্য নয়।

বাংলার মানুষ হয়ে নিজ দেশের অফিস দপ্তরে আমরা ইংরেজি ভাষার প্রতি ঝুঁকছি। এটাই কি ছাত্রসমাজের জীবনের প্রতিদান। বাংলা ভাষার জন্য জীবন দিল সেই ভাষাকে অবহেলিত করছি, এ কেমন জাতি আমরা। কষ্ট হলেও বাস্তব এটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন আমাদের। দেশের শিক্ষিত সমাজের মধ্যেও নেই ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। সঠিকভাবে বাংলা ভাষার চর্চা না করে অ্যাকাডেমিক পাঠ্যবইয়ে সীমাবদ্ধ রাখছে শিক্ষার্থীদের। আবার ইংরেজি ভাষার চর্চায় আবদ্ধ করছে বর্তমান ছাত্রসমাজকে। শুধু তাই নয়, জাতীয় দিবসসমূহে দায়বদ্ধতা থেকে শিক্ষার্থীদের উপস্থিত করেন শিক্ষকরা এবং দিবসগুলোতে দেশাত্মবোধক গানের চেয়ে বিদেশি গান-বাজনা বাজাচ্ছেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগ কর্মকর্তারা। এই মাতৃভাষাকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের। আমরা যদি মাতৃভাষাকে ভুলে গিয়ে বিদেশি ভাষার প্রতি নির্ভর হই। তাহলে জাতি হিসেবে আমরা ধ্বংস হয়ে যাব।

তাই ভাষার এই বৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখতে সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সাহিত্য ও সংস্কৃতি ব্যক্তিত্বসহ প্রত্যেককে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ ভাষার বিকাশ রুদ্ধ হয়ে গেলে আমাদের সংস্কৃতির বিকাশও পথ হারাতে হবে। তাই আমাদের গৌরবের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে সবার। শহীদের রক্তের যথার্থ সম্মান করি এবং মিশ্রিত ভাষার প্রয়োগ থেকে ফিরে আসি। তাই বর্তমান তরুণ ছাত্রসমাজের উচিত বাংলা ভাষার সঠিক ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে ভালোভাবে জানা ও পৃথিবীর সর্বত্র বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করা। পাশাপাশি, ভাষার সঠিক ব্যবহারের প্রতিও সচেতন ও যত্নবান হতে হবে আমাদের বাংলা ভাষার প্রতি।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close