এ এফ এম ফৌজি চৌধুরী

  ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

জাতীয় সংগীত গাইতে হবে শুদ্ধভাবে

আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’... আমাদের জাতীয় সংগীত। এক মহাকাব্য। আমাদের এক অস্তিত্বের নাম। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ২৫ লাইনের এই গানের ১০ লাইনকে জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ৩০ লাখোশহীদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের অর্জন আমাদের জাতীয় সংগীত। বাঙালিদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া একসময়কার জাতীয় সংগীত পাক সারজমিন সাদবাদ... এর পরিবর্তে আমরা আজকের জাতীয় সংগীত পেয়েছি। ভাষার জন্য বাঙালি জাতি যে সংগ্রাম, আন্দোলন করেছে, এই জাতীয় সংগীত পেতেও আমাদের লড়াই, সংগ্রাম করতে হয়েছে। একসময়ের নিষিদ্ধ এই জাতীয় সংগীত আমাদের অহংকারের অনুষঙ্গ। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকপর্যায়ে প্রতিদিন জাতীয় সংগীত গাওয়ার মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিদিনের কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ৫৩ বছর পর যে প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শুদ্ধভাবে, শ্রদ্ধাভরে জাতীয় সংগীত কি গাওয়া হয়? কীভাবে একটি রবীন্দ্রসংগীত জাতীয় সংগীত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলো সেই ইতিহাস আমরা কজনইবা জানি। আমাদের পাঠ্যবইয়ে সেই বিষয়টি স্থান পেতে পারত না? আর জাতীয় সংগীত নিয়ে খুব বেশি কাজও আমরা করিনি। মফস্বলপর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অনেক স্থানে সঠিক পদ্ধতিতে জাতীয় সংগীত গাওয়া হয় না। শিশুদের শুদ্ধভাবে জাতীয় সংগীত গাওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের যে ভূমিকা রাখার দরকার, অনেক ক্ষেত্রে তা করা হয় না।

জাতীয় সংগীত কোনোভাবেই ভুলভাবে গাওয়া যাবে না। একদম সঠিক উচ্চারণে এবং সুরে শুদ্ধ করে গাইতে হবে এবং গাওয়ার সময় এর প্রতি যথাযথ সম্মানও দেখাতে হবে। যখন জাতীয় সংগীত গাওয়া অথবা বাজানো হয় ও জাতীয় পতাকা প্রদর্শন করা হয়, তখন উপস্থিত সবাইকে জাতীয় পতাকার দিকে মুখ করে দাঁড়াতে হবে। যখন পতাকা প্রদর্শন না করা হয়, তখন সবাইকে বাদক দলের দিকে মুখ করে দাঁড়াতে হবে অনেক জায়গায় অনেককে বুকে হাত রেখে জাতীয় সংগীত গাইতে দেখা যায়। এটি আসলে সঠিক নয়। জাতীয় সংগীত গাইতে হবে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে। সাধারণ নাগরিকদের বাইরে ডিফেন্স বা প্রতিরক্ষাবাহিনীর জন্য জাতীয় সংগীত গাওয়ার নিয়ম পৃথকভাবে বলা হয়েছে।

জাতীয় সংগীতের পুরোটা সব অনুষ্ঠানে গাওয়ার নিয়ম নেই। বিভিন্ন জাতীয় দিবস, যেমন একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানের শুরুতে এবং শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণ সংগীত বাজাতে হবে। তবে স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসের প্যারেড অনুষ্ঠানে দুই লাইন শুরুতে বাজানোর নিয়ম রয়েছে। সব বিদ্যালয়ের দিনের কার্যক্রম জাতীয় সংগীত গাওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু করতে হবে রাষ্ট্রপতির ভাষণ দেওয়ার উদ্দেশ্যে সংসদ ভবনে প্রবেশ করার শুরুতে ও শেষে পূর্ণ জাতীয় সংগীত বাজাতে হবে। রাষ্ট্রপতির ভাষণ যখন জাতির উদ্দেশে সম্প্রচার করা হয়, তখন সম্প্রচারের শুরু ও শেষে দুই লাইন বাজাতে হবে। রাষ্ট্রপতি যখন কোনো প্যারেডে সালাম গ্রহণ করেন, তখনো দুই লাইন বাজাতে হয়। তা ছাড়া রাষ্ট্রপতি যদি কোনো অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হন বা কোনো অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন অথবা প্রধানমন্ত্রী প্রধান অতিথি হিসেবে স্বাধীনতা পদক প্রদান অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন, তাহলে এসব ক্ষেত্রে তাদের আগমন ও প্রস্থানের সময় দুই লাইন জাতীয় সংগীত বাজানোর নিয়ম রয়েছে। বিদেশি কোনো রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান তার রাষ্ট্রীয় বা সরকারি সফরে বাংলাদেশে এলে তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করার সময় আগে জাতীয় সংগীতের প্রথম দুই লাইন বাজাতে হবে। এ ছাড়া কোনো বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান, রাজপরিবারের সদস্য, রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার বা সমমর্যাদার কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতিনিধি যখন রাষ্ট্রপতির সালাম গ্রহণ করেন, তখন দুই লাইন বাজাতে হবে। রেডিও এবং টেলিভিশনের প্রতিদিনের কার্যক্রমের শেষেও দুই লাইন বাজানোর কথা রয়েছে।

বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের সুর বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সংগ্রহ করেছিলেন শিল্পী গগন হর করার রচিত একটি গানের সুর হতে। গানটি ছিল ‘আমি কোথায় পাব তারে, মনের মানুষ যে রে’...। আমার সোনার বাংলা গানটি ১৯৭১ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। এ গানের রচয়িতা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এই গানটি রচিত হয়েছিল। ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি তারিখে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে এ গানটির প্রথম দশ লাইন সদ্যগঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্বাচিত হয়। গানটি রবীন্দ্রনাথের গীতবিতান গ্রন্থের স্বরবিতান অংশে যুক্ত। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ তারিখে পল্টন ময়দানে স্বাধীনতার ইশতেহারে এই গানকে জাতীয় সংগীত হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ১৯৭২ সালে ৪ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর বাংলাদেশের সংবিধানে এই গানকে জাতীয় সংগীতের মর্যাদা দেওয়া হয়। চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান ১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত তার বিখ্যাত ‘জীবন থেকে নেওয়া’ কাহিনিচিত্রে এই গানের চলচ্চিত্রায়ন করেন। গানটির ইংরেজি অনুবাদ করেন সৈয়দ আলী আহসান। গানটিতে বাংলার প্রকৃতির কথা প্রধানভাবে স্থান পেয়েছে। এ জন্য আমরা সবাই যখন জাতীয় সংগীত গাইব, তখন শুদ্ধভাবে, শ্রদ্ধাভরে জাতীয় সংগীত গাওয়া উচিত।

লেখক : কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close