হীরেন পণ্ডিত

  ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

একুশ আমাদের চেতনায় ও প্রেরণায়

স্বাধীনতার জন্য বাঙালির আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় অধ্যায় বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। রক্তস্নাত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মাতৃভাষার জাতীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠার এমন উদাহরণ বিশ্বে বিরল। শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে নয়, ২১ ফেব্রুয়ারিকে ইউনেসকো কর্তৃক ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান এবং ২০০০ সাল থেকে জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত ১৯৩টি দেশে দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন ভাষা আন্দোলনকে বিশ্ব ইতিহাসেরও গৌরবময় অধ্যায়ে পরিণত করে।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ সরকার ১৪ আগস্ট পাকিস্তানকে স্বাধীনতা দেয়। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলার মানুষকে সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে শোষণ করতে থাকে। মাত্র ৮ শতাংশ উর্দুভাষী মানুষ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার কথা ঘোষণা করে যেখানে ৫৬ শতাংশেরও বেশি বাংলাভাষী। বাংলার মানুষ এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় প্রাণ বিসর্জন দেন বাঙালি বীর সন্তানরা। ঢাকার রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেওয়ার মাধ্যমে আমাদের জাতীয়তাবোধের বীজ বপন করা হয়েছিল, যা অবশেষে আমাদের প্রেরণা হয়েছে ও সাহস জুগিয়েছে। আমাদের স্বায়ত্তশাসনের জন্য চাপ দেওয়া এবং পরবর্তীকালে পাকিস্তানি শৃঙ্খল থেকে আমাদের মুক্তি, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে, এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে।

আমাদের জাতীয় গর্বের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে লড়াই করতে হয়েছে, যুদ্ধ করতে হয়েছে। যত দিন গেছে বাঙালিদের জন্য, শোষণের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে গিয়ে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। যখন বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে ষাটের দশকের রাজনৈতিক আন্দোলন আওয়ামী লীগের ১১ দফা দাবির ছয় দফা সনদে গৃহীত হয়েছে, ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলন এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, যা বাংলাদেশের জন্ম। বাঙালির অধিকার ও স্বাধীনতার চেতনাকে জাগ্রত করতে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন সব সময় আমাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সব রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে প্রভাবিত করেছে। প্রভাব এতটাই সুদূরপ্রসারী ছিল যে, সাধারণ ও রাজনৈতিক মানুষের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। পরস্পরের প্রতি আস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যা জাতির মুক্তিসংগ্রামকে বেগবান করেছিল।

ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই পাকিস্তানের শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহী মনোভাব বাঙালি হৃদয়ে প্রকাশ পায়। বলা যায়, ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালির সব ধরনের অধিকার আদায়ের সূচনা। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলার মানুষ তাদের দাবির প্রতি সচেতন হতে শুরু করে। ভাষা আন্দোলন মানুষের মনে মনোবল ও আত্মবিশ্বাস জাগিয়েছিল, যা জাতীয়তাবাদের বোধ জাগ্রত এবং এর উন্মেষ ঘটিয়েছিল। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরের স্বাধীনতাসংগ্রাম প্রতিটি ক্ষেত্রে ভাষা আন্দোলনের চেতনা মনোবল ও শক্তি সৃষ্টি করেছিল।

১৯৬৯ সালের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি উত্থাপন করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের জন্য জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে। কিন্তু তা কখনোই হওয়ার কথা ছিল না। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইট চালায় এবং এমন বর্বরতা, যা বিশ্বে খুব কমই দেখা গেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে আমরা ৩০ লাখ মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষকে হারিয়েছি এবং ২ লাখ মা-বোনকে লাঞ্ছনার শিকার হতে হযেছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ হাল ছাড়েনি এবং তারা জয়ী হয়েছে। তারা তাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছে। বাংলার মানুষ তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে এবং জয়লাভ করেছে আমাদের মাতৃভাষা।

১৯৫১ সাল নাগাদ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের দাবি বাড়তে থাকে। পূর্ব বাংলার শিক্ষাবিদ, লেখক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরা সবস্তরে বাংলা ভাষা চালুর জন্য তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের কাছে স্মারকলিপি দেন। ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২। সারা দেশে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। ওইদিন সকাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের সামনে দলে দলে শিক্ষার্থীরা জড়ো হতে থাকে। উদ্দেশ্য ছিল বাংলা ভাষার দাবিতে সোচ্চার হওয়া এবং মাতৃভাষার পূর্ণ অধিকার নিশ্চিত করা। চারদিকে বাতাসে শোনা যায় ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। ১৪৪ ধারা অমান্য করে মিছিল বের করা হয়। পথে পুলিশি বাধার মুখে পড়লে তা সংঘর্ষে রূপ নেয়।

পুলিশ গুলি চালালে আবদুল জব্বার ও রফিকউদ্দিন মুহূর্তেই পড়ে যান। রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায় বাংলার রাজপথ। এই রক্তবাংলার সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে। সব ভেদাভেদ ভুলে সবাই মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন শুরু করে। ফলে ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগ শোচনীয়ভাবে পরাজয়বরণ করে। পাকিস্তান সরকার ১৯৫৬ সালের সংবিধানে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিল। তাই এটি ছিল পাকিস্তান সরকারের চূড়ান্ত পরাজয়ের একটি। আর বিশ্বে বাংলা ভাষা ও বাঙালি গর্বিতভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ভাষা আন্দোলন বাঙালির মনে জাতীয়তাবোধের জন্ম দেয় এবং নতুন দিগন্তের সূচনা করে। এটি এক নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছে, যা বাঙালির দীর্ঘ মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে অনবদ্য স্থান দখল করে আছে।

বাংলা ভাষা, বাঙালি জাতির মাতৃভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে যোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে জাতিকে পথে নামতে হয়েছিল প্রধানত দুবার। প্রথমবার ১৯৪৮ সালে এবং দ্বিতীয়বার ১৯৫২ সালে।

বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ এখন একটি সম্মানজনক ও শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে। বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলাদেশের নাম উচ্চ স্বরে ব্যবহৃত হচ্ছে, বাংলাদেশ আজ এক উন্নয়নের মডেল। নতুন বিশ্বে, বাংলাদেশ নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে আবার দক্ষতার সঙ্গে সফলভাবে সেগুলো মোকাবিলা করছে। এসডিজি বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছে, এখনো রাখছে। জাতীয়তাবাদের চেতনায় আমাদের সব সময় এগিয়ে যেতে হবে। বাঙালি অতীতে কখনো হারেনি, ভবিষ্যতেও হারবে না। দল-মত নির্বিশেষে সবার সহযোগিতায় আমাদের বিশ্বের বিভিন্ন জাতির মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে। একুশে ফেব্রুয়ারিকে জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এই স্বীকৃতিও আমাদের জন্য সম্মানের।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ মাতৃভাষার অধিকার রক্ষায় ভাষা আন্দোলন শুরু হয়। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আমরা দেখলাম, বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে জাতীয় ভাষা করার বড় ষড়যন্ত্র চলছে। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং তমদ্দুন মজলিস প্রতিবাদ করে এবং বাংলা ও উর্দু উভয়কেই রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানায়। আমরা মিটিং করে প্রতিবাদ শুরু করি। এ সময় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস যৌথভাবে সর্বদলীয় সভা আহ্বান করে এবং ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে। সভায় ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চকে ‘বাংলা ভাষা দাবি’ দিবস ঘোষণা করা হলো। জেলায় জেলায় আমরা বের হয়ে পড়লাম।’ (পৃষ্ঠা : ৯১, ৯২)

একটি সুন্দর, নিষ্কলুষ, নির্যাতন-নিপীড়নহীন শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে ১১ দফার ভিত্তিতে সমগ্র জাতিকে এক মোহনায় শামিল করতে সক্ষম হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেদিনের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলার ঘরে ঘরে স্বাধিকার ও স্বাধীনতার এক নতুন বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন। দিনটি ছিল শুক্রবার। একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদদের স্মরণে প্রথম সরকারি ছুটি অর্জিত হয়েছিল। কালো পতাকা উত্তোলন, আজিমপুর কবরস্থানে শহীদদের সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, প্রভাতফেরি এবং কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণের মধ্য দিয়ে সেদিন কর্মসূচি শুরু হয়। শহীদ দিবস উপলক্ষে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে শহীদ মিনারের পাদদেশে শপথ অনুষ্ঠান পরিচালিত হয়।

একুশে ফেব্রুয়ারি যুগে যুগে আমাদের প্রেরণার উৎস হয়ে আছে। জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এই স্বীকৃতিও আমাদের জন্য সম্মানের। আমরা যদি শিক্ষা, সংস্কৃতিতে অগ্রসর হতে না পারি এবং উন্নত মানবসম্পদ হতে না পারি তাহলে আমরা আমাদের ভাষা ও দেশকে মহিমান্বিত করতে পারব না। দেশকে এগিয়ে নিতে পারব না। এ ক্ষেত্রে সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে বৈষম্য দূরীকরণের পদক্ষেপ নিতে হবে এবং নতুন প্রজন্মকে সেভাবেই গড়ে তুলতে হবে, যা খুব জরুরি।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close