মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

  ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

মতামত

জেগে উঠলে গ্রাম, সমৃদ্ধ হবে দেশ

বরিশাল বিভাগের পিরোজপুর জেলাধীন উপজেলা স্বরূপকাঠির কৃষি উৎপাদনের মধ্য দিয়ে এককালে এলাকার অর্থনৈতিক ভিত স্থাপিত হলেও পরে শিক্ষা, রাজনীতি, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষিত বিবেচনায় স্থানটি দেশের একটি উল্লেখযোগ্য এলাকা হিসেবে দেশজুড়ে পরিচিতি লাভ করে। স্বরূপকাঠি এক বিখ্যাত জনপদে পরিণত হতে থাকে। আগে যেখানে বরিশাল সদর থেকে একমাত্র নৌপথে স্বরূপকাঠি গমনাগমনে ছয়-সাত ঘণ্টা সময় ব্যয় হতো, সেখানে আজ বরিশাল থেকে মাত্র একঘণ্টা পনেরো মিনিট বাসে চড়ে পৌঁছা যায় রূপকাঠি বন্দরে। বরিশাল থেকে এখন প্রতি ঘণ্টায় উন্নতমানের বাস সরাসরি যায় স্বরূপকাঠিতে। প্রায় সতেরো কিলোমিটার পিচঢালা রাস্তা, ছোটখাটো ব্রিজ-কালভার্ট পেরোতে গাড়ি এগিয়ে চলে দ্রুতবেগে। সেখান পথকে ট্রলারে চড়ে যাওয়া যায় উপজেলার প্রতিটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে। যন্ত্রই আজ নিয়ন্ত্রণ করে নদীপথের যাতায়াত ব্যবস্থা। অথচ পঞ্চাশ-ষাট দশকে বরিশাল থেকে মাঝির নৌকায় চড়ে নদী-খাল পেরিয়ে যেতে হতো স্বরূপকাঠি। সময় লেগে যেত সাত-আট ঘণ্টা। এরপর লঞ্চ সার্ভিস শুরু হলেও প্রায় পাঁচণ্ডছয় ঘণ্টা লাগত অনেক পথ ঘুরে যেতে হতো বলে। টইটম্বুর সন্ধ্যার ঢেউ, খালে জলের নাচন নৌকার গায়ে বারবার আছড়ে পড়ত। নৌকা ইন্দেরহাট খালে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে দুই পাশের অসংখ্য করাত কলের একটানা শব্দে কানে তালা লেগে যেত। ধীরে ধীরে সবকিছু পাল্টে যেতে থাকে। গ্রামগঞ্জের চেহারা দেখলে অবাক হতে হয়। সন্ধ্যা নদীর খালমুখ ধরে এগোতেই চোখে পড়ে বিশাল ব্রিজ, যা খালের দুপাড়ে গড়ে ওঠা প্রসিদ্ধ ইন্দেরহাট ও মিয়ারহাটকে একই সূত্রে গেঁথেছে। মিয়ারহাটের পাড়ে রয়েছে স্বরূপকাঠি সরকারি কলেজ। সেখানে আজ শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক। অনার্স খোলা হয়েছে বেশ কতগুলো বিষয়ে। উপজেলা স্বরূপকাঠির পাড়ে রয়েছে বেসরকারি শহীদণ্ডস্মৃতি মহাবিদ্যালয়। ইন্দেরহাট খালধরে আরেকটু যেতে দেখা যায় বহুদিনের বিখ্যাত সুটিয়াকাঠি হাইস্কুল। সুটিয়াকাঠির গার্লস হাইস্কুলটিও দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। এ ছাড়া বৃহত্তর স্বরূপকাঠি উপজেলায় স্কুলের অভাব নেই। ছেলেমেয়েরা বেশির ভাগই লেখাপড়া করে স্কুল কিংবা কলেজে। গ্রামগঞ্জ জুড়ে রিকশা, অটোরিকশা আর মোটরসাইকেলের দাপট। আজ এসব চলে স্বরূপকাঠি, ইন্দেরহটের প্রত্যন্ত গ্রামের রাস্তায়। কী নেই এ অঞ্চলে! ছোটখাটো গ্রামেও রয়েছে অনেক উন্নতমানের দোকানপাট। সেখানে নানা পণ্যে দোকান ঠাসা। পল্লীবিদ্যুতের কল্যাণে রয়েছে ফ্রিজভর্তি কোমলপানীয়। ইন্দেরহাট বিশাল বাজারটি দীর্ঘদিনের পুরোনো। রাস্তার দুধারে সারিবদ্ধ দোকানপাট। দেশি-বিদেশি উন্নতমানের পণ্যের পসরা। সপ্তাহে দুদিন হাট বসে ইন্দেরহাটে। গ্রাম-গ্রামান্তরের মানুষের বয়ে আনা নানা পণ্যে ভরে যায় বিশাল হাট এলাকায় মানুষের ভিড়। এ অঞ্চলের মানুষের বড় ধরনের বাজার করতে বরিশাল বা ঢাকা যেতে হয় না। শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যের খাতিরে নিয়মিত তিন-চারটি বৃহদাকার তেতলা লঞ্চ নিয়মিত ইন্দেরহাট-ঢাকা-ইন্দেরহাট রুটে যাতায়াত করে। গ্রামীণ অর্থনীতি যে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে স্বরূপকাঠি উপজেলাকে দেখলে তা সহজে ধরা পড়ে।

স্বরূপকাঠি উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় শিক্ষার প্রসার, সফল ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পেছনে উন্নত নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থা বরাবরই বিশেষ ভূমিকা রেখে আসছে। দীর্ঘকাল ধরে স্বরূপকাঠি-ইন্দেরহাটের বিশাল জনগোষ্ঠী সুন্দরবন, ভাওয়ালগড়, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বার্মার আহরিত সুন্দরী, গরান, সেগুন, গামারীকাঠ ও গোলপাতার ব্যবসা করে এলাকার অর্থনৈতির ও সামাজিক উন্নয়ন লাভে সক্ষম হয়। পাশাপাশি ইন্দেরহাটের নারকেলের ছোবড়ানির্ভর কুটিরশিল্প অতি প্রাচীন। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষই নারকেলের ছোবড়া দিয়ে দড়ি, ব্রাশ, পাপোষ বানানোর কাজে নিয়োজিত ছিল। নারকেল ছোবড়া দিয়ে তৈরি কুটিরশিল্পের ওপর ভিত্তি করে এখানে গড়ে উঠেছিল শিল্পনগরী। আজও ইন্দেরহাটের বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে নারকেলের ছোবড়ার কুটিরশিল্পভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। এসব শিল্পপণ্য দেশের বিভিন্ন অংশে চালান দেওয়া হয়। কিছু কিছু পণ্য রপ্তানি হয় বিদেশেও। পরিবেশজনিত কারণে সুন্দরবনের কাঠকাটা নিষিদ্ধ হলে এ অঞ্চলে কাঠ ব্যবসায় কিছুটা ভাটা পড়ে। তার পরও এলাকার পরিশ্রমী লোকজন বসে থাকেনি। স্থানীয়ভাবে আহরিত নানা জাতের কাঠের ওপর ভিত্তি করে আজও টিকে আছে স্বরূপকাঠি এলাকার বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাঠব্যবসা। সন্ধ্যানদী এবং এর আশপাশের খালের দুপাড় জুড়ে বিস্তৃত কৌরিখাড়া, সুটিয়াকাঠি, বালিহারি, বলদিয়াসহ বিভিন্ন গ্রামে এখনো নিয়মিত বসে কাঠের বিশাল বাজার। কাঠ চেড়াইয়ের জন্য প্রতিষ্ঠিত অসংখ্য স’মিল দিনরাত আওয়াজ তোলে। সারা বছর ধরে ব্যবসায়ীরা এখান থেকে উন্নতমানের কাঠ নৌকা, ট্রলার বা কার্গোবোঝাই করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়ে যায়।

সম্প্রতি নার্সারি ব্যবসায় স্বরূপকাঠি সৃষ্টি করেছে যুগান্তকারী অধ্যায়। স্বরূপকাঠি, ইন্দেরহাট এবং তৎসংলগ্ন বিভিন্নœ গ্রামের বিশাল এলাকা জুড়ে বর্তমানে বিভিন্ন জাতের বনজ, ফলদ ও ঔষধি গাছের চারা ও কলম তৈরি করা হচ্ছে। এসব চারা ও কলম বৃহত্তর বরিশাল তথা দেশের বিভিন্ন অংশে চালান দেওয়া হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত বৃক্ষমেলাগুলোতে স্বরূপকাঠির নার্সারির গাছগাছালির চাহিদা বেশি। ইন্দেরহাটের প্রত্যন্ত অঞ্চল ডুবি, বিশারকান্দিতে শুরু হয়েছে ভাসমান সবজি চাষের নতুন প্রযুক্তি। খালে জমে থাকা কচুরিপানার স্তূপে মাটি ফেলে তার ওপর চাষ করা হয় নানা ধরনের শাকসবজি। এ ধরনের ব্যবসায় সাফল্যে অনেকের ভাগ্যে পরিবর্তন এনে দিয়েছে। স্বরূপকাঠি-ইন্দেরহাট এলাকার নারকেল, কলা, পেয়ারা, আমড়াসহ নানা জাতের ফলমূল নৌপথে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয় দীর্ঘকাল ধরে। ইন্দেরহাট সন্নিকটে আটঘর-কুড়িয়ানার পেয়ারার প্রসিদ্ধি দেশজুড়ে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এ অঞ্চলের জনগণের ভূমিকার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস হয়ে আছে। স্বরূপকাঠির আটঘর-কুড়িয়ানাসহ বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অভূতপূর্ব সাফল্য আজও মানুষের হৃদয় আন্দোলিত করে। আজকাল স্বরূপকাঠি এবং ইন্দেরহাটে তৈরি কাঠের ক্রিকেট ব্যাট এবং অন্যান্য খেলার উপকরণ নিয়মিত সরবরাহ করা হয় দেশ-বিদেশের বিভিন্ন অংশে। স্বরূপকাঠি, ইন্দেরহাটে বর্তমানে গড়ে উঠেছে নৌযান নির্মাণশিল্প এবং তা অল্প সময়ের মধ্যে তা সমৃদ্ধি লাভ করেছে। আজ স্বরূপকাঠি ও ইন্দেরহাটে বৃহদাকার লঞ্চ ও কার্গো নির্মিত হচ্ছে। ইন্দেরহাট খালের দুপাড়ে যেন তিল ধরার জায়গা নেই। এ শিল্প ছড়িয়ে পড়েছে ইন্দেরহাটের খালমুখ ধরে বলদিয়া, ডুবি পর্যন্ত। শ্রমজীবী মানুষের পদভারে মুখরিত পুরো খালপাড়সহ ইন্দেরহাট সংলগ্ন বিশাল এলাকা। দিনরাত সেখানে চলছে ওয়েল্ডিয়ের কাজ। দেখলে মনে হয়, বিশাল এক ডকইয়ার্ড। এ যেন ঢাকার বুড়িগঙ্গা তীরের নৌযান শিল্পকেও হার মানিয়েছে। এ যেন গ্রাম নয়, বিকশিত এক শিল্পনগরী!

স্বরূপকাঠি উপজেলার অন্যতম সমস্যা নদীভাঙন। সম্ভাবনাময় স্বরূপকাঠির ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, কৃষি, শিল্প বিকাশের প্রধান সহায়ক, শিক্ষা-সংস্কৃতির অগ্রগতির মূল চালিকা শক্তি সন্ধ্যা নদী আজ বিপন্ন। তিন যুগের অধিক সময়ের অব্যাহত ভাঙনের শিকার এ নদী আজ হারিয়েছে তার প্রকৃত রূপ। সন্ধ্যা নদী গ্রাস করে চলেছে গ্রামের পর গ্রাম। শর্সিনা মাদরাসার দেয়ালের একেবারে কাছে চলে এসেছে নদীপাড়। একসময় ব্রাহ্মণকাঠি ও মাগুরা এলাকায় নির্মিত বাইপাস সড়কটিও ভেঙে নদীতে বিলীন হয়ে গেলে বরিশালের সঙ্গে স্বরূপকাঠির সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়া সন্ধ্যা নদীর ভাঙনের ফলে শান্তিহার গ্রাম, দক্ষিণ কৌরিখাড়া, সোহাগদল, গোনমানসহ কিছু বর্ধিষ্ণু গ্রাম অনেকটা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। এর আগে স্বরূপকাঠি উপজেলা সংলগ্ন ও অন্যান্য এলাকার ভাঙন প্রতিরোধে কিছু পাইলিং ও কংক্রিটের বস্তা ফেলার কাজ করা হয়। কিন্তু তাতেও সন্ধ্যার ভাঙন প্রতিরোধ করা যায়নি। ধান-নদী-খাল এই তিনে বরিশাল- এমন একটি সুবচন দীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশের মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। বরিশাল, স্বরূপকাঠিসহ দক্ষিণাঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য মূলত জলপথনির্ভর। কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং সন্ধ্যা নদীর প্রতি মানুষের বিরূপ আচরণের ফলে সন্ধ্যা আজ ক্ষুব্ধ। নদীর নিচে ক্রমশ পলি ও ভাঙনের মাটি জমা হয়ে নদীতল ভরাট হয়ে গেছে। হ্রাস পেয়েছে নদীর পানি ধারণক্ষমতা। নদী হারিয়েছে তার নাব্য। নদীর পাড়ে ড্রেজার বসিয়ে ক্রমাগত মাটি ও বালু উত্তোলনের ফলে সন্ধ্যার পাড় ভাঙন আরো জোরদার হয়েছে। সন্ধ্যা নদীর ভাঙনের হাত থেকে ঐতিহ্যবাহী স্বরূপকাঠি-ইন্দেরহাট বন্দর, তৎসংলগ্ন বর্ধিষ্ণু গ্রামাঞ্চল এবং শিল্পনগরীকে রক্ষা করতে হলে সন্ধ্যা নদীকে ড্রেজিং করতে হবে। ভাঙনের ফলে এঁকেবেঁকে যাওয়া সন্ধ্যার গতিপথ সোজা করতে নিতে হবে নদী শাসনের পদক্ষেপ। সন্ধ্যা নদীর ভাঙনরোধ ও নাব্য ধরে রাখতে নদী থেকে মাটি ও বালু উত্তোলন বন্ধ করতে হবে। নদী-খালের পানিদূষণ রোধে বর্জ্য অপসারণ বন্ধ করতে পৌরসভাকে আরো সক্রিয় করা আবশ্যক। শিল্প বিকাশের স্বার্থে স্বরূপকাঠির নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি। স্বরূপকাঠি উপজেলার রাস্তাঘাট, বাসস্ট্যান্ড ও অভ্যন্তরীণ খালের উন্নয়নে ব্যবস্থা নিতে হরে। কৃষি ও নৌযান শিল্পবিকাশের স্বার্থে সরকারের সার্বিক সহায়তা দক্ষিণ বাংলার ঐতিহ্যবাহী উপজেলা স্বরূপকাঠির সম্ভাবনাময় শিল্পের বিকাশ ও সমৃদ্ধি গোটা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। আর তাহলে গ্রামে কর্মসংস্থানের পরিধি বিস্তৃত হবে। পাশাপাশি গ্রামের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা উন্নত করা গেলে শহরমুখো বিশাল জনগোষ্ঠী ফিরে আসবে গ্রামে। রাজধানীসহ দেশের শহরাঞ্চলে ওপর জনসংখ্যার চাপ কমবে। হ্রাস পাবে নগর জীবনের নানা সমস্যা। বাড়বে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের সুযোগ। স্বরূপকাঠির উন্নয়নের মডেল অনুসরণ করে সারা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষও নিজ নিজ গ্রামের উন্নয়নে উদ্বুদ্ধ হবেন। দেশের বিত্তবানরাও বিনিয়োগে এগিয়ে আসবেন। সমৃদ্ধ হবে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি। ধীরে ধীরে জেগে উঠবে সারা দেশ। গ্রামের উন্নয়ন দেশের সার্বিক সমৃদ্ধির চালিকাশক্তি।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close