মো. গোলাম দস্তগীর

  ২৮ জানুয়ারি, ২০২৩

সময়ের কথা

বিচিত্র জীবন ও সময়ের সমীকরণ

বৈচিত্র্যপূর্ণ এ ধরণিতে রয়েছে নানা দেশ, নানা জাতি ও সংস্কৃতি। আছে অনেক প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম সৌন্দর্যেঘেরা চিত্তাকর্ষক পরিবেশ এবং বৈচিত্র্যময় স্থান। এরই মাঝে আন্তজালে রয়েছে বিনোদনের মহাসম্মেলন। ঘড়ির কাঁটার মতো চলছে জীবন, যাচ্ছে সময়!

বিশ্বগ্রামে আজ মানুষজন জীবন নামক সামষ্টিক সময়ের সিংহভাগ ক্ষেপণ করছে অনলাইন ও অফলাইনের বিভিন্ন শাখায়। কি যুবক-বৃদ্ধ, আবাল-বনিতা, সবাই যেন চিত্তাকর্ষণে মত্ত থাকা এক ঘুমন্ত পথিক। তবে জাগ্রত বিবেক আজও বিদ্যমান জ্ঞানার্জনে, চিন্তার দর্শন ও ফলিত দর্শনে জীব ও জগতকে নতুন করে দেখার; নতুন কিছু করার। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতার বিকাশে এ পৃথিবী নতুন রঙে সেজেছে। ফলে উন্নত জীবন যাত্রার অগ্রগতিও বেশ ত্বরান্বিত হয়েছে।

সময়কে সময় দিলে সময়ই অসামান্য কিছু করার সুযোগ দিবে। পৃথিবীর কোনো শক্তিই সময়ের গতিশীলতাকে রোধ করতে পারে না। সময় কখনো থামতে জানে না, সে আপন গতিতে সদা চলমান। সময় কখনো ক্লান্ত হয় না, তাই তার বিশ্রামেরও প্রয়োজন নেই। এজন্য গভীর চিন্তাশীল গবেষণাধর্মী সময়ানুরাগী মানুষরাই পৃথিবীতে স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে থাকে। যেমন- ঐতিহাসিকভাবে পূর্ণিমার চাঁদের মতো উজ্জ্বল এক নক্ষত্র আল রাজি। চিকিৎসাবিজ্ঞানে যার অবদান অবিস্মরণীয়। চিকিৎসাশাস্ত্রে মুসলমান বিজ্ঞানীদের অবদানের কথা বলতে গেলে শুরুতেই তার কথা বলতে হয়। তবে উনি শুধু চিকিৎসকই ছিলেন না, ছিলেন একাধারে গণিতবিদ, রসায়নবিদ ও দার্শনিক এবং তিনি পেডিয়াট্রিকস, অফথ্যালমোলজি, নিউরোসার্জারি ও সংক্রামক রোগসহ চিকিৎসাবিদ্যার অনেক শাখার গোড়াপত্তন করেন।

আল রাজির সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ অবদান ছিল, তিনি কমবেশি ২০০ কিতাব রচনা করেন। এর মধ্যে চিকিৎসাশাস্ত্রেই তার গ্রন্থের সংখ্যা ১০০। আল রাজির সবচেয়ে বড় কীর্তি হচ্ছে তিনিই প্রথম রেটিনার স্তর আবিষ্কার করেন ১০টি। আর বসন্ত ও হাম সম্পর্কে ‘আল জুদারি ওয়াল হাসবাহ’ নামক পুস্তক রচনা করে এতে গুটি বসন্ত ও হাম রোগের লক্ষণের সঠিক বিবরণ ও পার্থক্য লিপিবদ্ধ করেন; যা তার বিরল প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করে। ওই পুস্তক ইংরেজি, লাতিন ও ইউরোপীয় অন্য ভাষায় অনুবাদ হয়। তার চিকিৎসাবিষয়ক গ্রন্থের মধ্যে ‘এল হাওয়াই’ সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য। এ গ্রন্থটি ‘লিবার কন্টিনেন্স’ নামে লাতিন ভাষায় অনূদিত হয়েছিল।

আল রাজির চিকিৎসাবিষয়ক আরেকটি ছোট গ্রন্থ ‘মানসুরি’ বা ‘লবার আলমানসোরিস’। এটি তিনি মানসুর ইবনে ইসহাক নামের জনৈক শাসককে উৎসর্গ করেছিলেন। ওই গ্রন্থটিতে ভ্রমণকারীর জন্য চিকিৎসা উপদেশ, বিষাক্ত প্রাণীর দংশনের প্রতিকারসহ অন্যান্য বিষয় আলোচনা করেছেন। আল রাজি চিকিৎসা ও দর্শন ছাড়াও জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যামিতি, খনিজবিদ্যা, ব্যাকরণসহ প্রভৃতি বিষয়ে অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন।

তেমনি আরেকজন নক্ষত্র হলেন আবু নসর আল ফারাবি। তিনি তার অমর কীর্তির জন্য বিশ্ববাসীর হৃদয়ে অমর হয়ে আছেন। অজানাকে জানার এবং অজেয়কে জয় করার প্রবল আকাঙ্ক্ষা ছিল তার হৃদয়ে। তাই তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনায় কাটিয়েছেন পুরো জীবন। জ্ঞানের সন্ধানে ছুটে চলেছেন দেশ থেকে দেশান্তরে। এক সময় মুসলিমদের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা কোন দিকে কম ছিল না। সে সময়ে সারা বিশ্বের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ছিল মুসলিমদের কাছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য এবং সভ্যতায় মুসলমানরা ছিল উন্নত ও শ্রেষ্ঠ। তবুও নাক উঁচু স্বভাবের ইউরোপীয় পণ্ডিতরা বিশ্ববিখ্যাত মুসলিম বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের নাম সেভাবে উপস্থাপন করেনি। তারপরও আল ফারাবি ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি দর্শন ছাড়াও যুক্তিবিদ্যা ও সংগীতের মতো জ্ঞানের বিস্তর শাখায় অবদান রাখেন। তিনি একজন খ্যাতনামা দার্শনিক ও বহুভাষাবিদ পণ্ডিত। উনি প্রায় ৭০টি ভাষা জানতেন। আর সেজন্য আরবরা তাকে ‘হাকিম সিনা’ বলত।

বলাবাহুল্য, এ মহীতে যাদের নামই স্বর্ণাক্ষরে খোদিত আছে সবাই পৃথিবীর নান্দনিক বৈচিত্র্যে গা এলিয়ে জীবনাতিবাহিত করেননি। সময়ের সুষম ব্যবহার ও জ্ঞানার্জনে গভীর আত্মনিয়োগ করেছেন এবং জগতবাসীর জন্য রেখে গেছেন অনেক কিছুই। যার ফলে তারা আজ দেশ-বিদেশে খ্যাতির উচ্চ আসনে সমাসীন। বিজ্ঞানের যুবরাজ খ্যাত এমনি আরেক বিস্ময়ের নাম আবুল আলী ইবনে সিনা। যিনি মাত্র ১০ বছর বয়সে কুরআনের হিফজ শেষ করেন! যার সময় ও জ্ঞানানুরাগের কথা শুনলে চমকে যেতে পারে যে কেউ! আরো চমকে উঠবেন জানলে, বোখারার আমিরকে সুস্থ করে তোলার বিনিময়ে কী চেয়েছিলেন তিনি। ঘটনাটি তাহলে বলা যাক। উনার বয়স যখন মাত্র ১৮; তখন হঠাৎ একবার আমিরের গুরুতর ব্যাধি হলো। অভিজ্ঞ ডাক্তার-হেকিম সবার চিকিৎসাই ব্যর্থ হলো। ইবনে সিনা তখন বললেন, আমি একটু চেষ্টা করে দেখি? পরে অনুমতি পেয়ে তার চিকিৎসায় যখন আমির সুস্থ হয়ে উঠলে, তিনি তাকে পুরস্কৃত করতে চাইলেন।

এমন সময় পুরস্কার হিসেবে ইবনে সিনা জানালেন, তার চাওয়া হচ্ছে প্রাসাদের ভেতরে যে বিশাল গ্রন্থাগারটি আছে, সেখানে প্রবেশাধিকার ও অধ্যয়নের সুযোগ। আমির অনুমতি দিলেন। পরবর্তী দিনগুলোতে ইবনে সিনা উদয়াস্ত হয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন। অবশ্য কিছুদিন পর আগুনে সে গ্রন্থাগারটি পুরোপুরি ভস্মীভূত হয়ে যায়।

কৈশোরে একবার অ্যারিস্টটলের মেটা ফিজিক্স পড়তে গিয়ে প্রথমেই ধাক্কা খান তিনি। কিছুই বুঝতে পারছেন না। বোঝার জন্যে শুরু করলেন দর্শন পড়া। তাও কঠিন। দেড় বছর টানা দর্শন নিয়ে পড়ে থাকেন। কথায় আছে, এসময় পড়তে পড়তে ইবনে সিনা যখন কিছুই বুঝতে পারতেন না বলে মনে হতো তখন সোজা বই রেখে উঠে দাঁড়াতেন। অজু করে চলে যেতেন মসজিদে। এরপর প্রার্থনায় নিমগ্ন থাকতেন যতক্ষণ না সমাধান পেতেন বা বুঝতে পারতেন বলে মনে হতো। একাধিক্রমে চল্লিশবার উনি অ্যারিস্টটলের মেটা ফিজিক্স অধ্যয়ন করেন। পড়তে পড়তে বাক্য এমনকি শব্দগুলোও পর্যন্ত তার মুখস্থ হয়ে ছিল। কিন্তু দুর্বোধ্যতা কমেনি তবুও। শেষ পর্যন্ত একদিন ঘটনাচক্রে তিনি ক্রয় করেন আল ফারাবির একটি বই। তিন দিরহাম দামের এই বইটিতে দার্শনিক আল ফারাবি অ্যারিস্টটলের মেটাফিজিক্সের ওপর তার একটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণী মন্তব্য তুলে ধরেছিলেন।

আর সেটা পড়তেই ইবনে সিনার কাছে পুরো দর্শনটি দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যায়। কৃতজ্ঞতায় তিনি এতটাই আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন যে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যান মসজিদে স্রষ্টার কাছে শুকরিয়া জানাতে। আবার শুকরিয়াস্বরূপ দরিদ্রদের মাঝে দানও করেছিলেন তিনি। তিনিই সে মনীষী যাকে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক বলা হয়। তাই বোঝাই যাচ্ছে, খ্যাতিগুলো এমনি এমনি আসেনি বরং এর পেছনে সময়ের সঠিক ব্যবহার ও জ্ঞানার্জনের ভালোবাসাই মুখ্য। তাই জ্ঞানার্জনে, চিন্তা ও গবেষণায় সময়ের মূল্যায়ন অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রসঙ্গত আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা অনুসন্ধানপ্রিয় অথবা যারা কৃতজ্ঞতাপ্রিয়, তাদের জন্য তিনি রাত্রি ও দিবস সৃষ্টি করেছেন পরিবর্তনশীলরূপে।’ (সুরাতুল ফুরকান-৬২)

আবার জ্ঞানের মূল্যায়নে বলেছেন, ‘জ্ঞানীদের থেকে জেনে নাও যদি তোমরা না জানো। (সুরাতুন নাহল-৪৩)

এরূপে অসংখ্য হাদিসেও সময়ের মূল্য এবং জীবনের গুরুত্ব প্রদানের তাগিদ রয়েছে। একটি হাদিসে নবীজি (সা.) বলেন, ‘পাঁচটি বিষয়কে পাঁচটি বিষয়ের আগমনের আগে গণীমত মনে করো। বার্ধক্যের আগে যৌবনকে, অসুস্থতার আগে সুস্থতাকে, দরিদ্রতার আগে সচ্ছলতাকে, কর্মব্যস্ততার আগে অবসরকে এবং মৃত্যুর আগে জীবনকে।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ৩৫৪৬০)।

হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) বলতেন, ‘সময়ের চক্র যদিও বিস্ময়কর, কিন্তু মানুষের আলসেমি আরো বিস্ময়কর! মানুষের উচিত নিজ জীবনের সেই দিনটির জন্য দুঃখ প্রকাশ করা যা এমনভাবে অতীত হয়েছে যে, তাতে কোনো নেক কাজ করা হয়নি!’

বিশিষ্ট তাবেয়ি হজরত হাসান আল বসরি (রহ.) বলেন, আমি এমন লোকদের (সাহাবাদের) সংস্রবে থেকেছি, যারা স্বীয় জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে সোনা-রুপার চেয়েও বেশি মূল্যবান মনে করতেন। কিন্তু আফসোস বর্তমানে আমাদের মধ্যে কোনো সময়ানুবর্তিতা নেই! অথচ সময় ও জ্ঞানানুরাগী মানুষরাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সন্তান। কথায় আছে, ‘সময় ও নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না।’ দুটোই তাদের গতিপথে চলমান। তাই সময়ের যথার্থ মূল্যায়নে নিজের জন্য এবং দেশ, জাতি ও বিশ্ববাসীর জন্য কিছু করে যাওয়াই হবে জ্ঞানীর কাজ। তাই তো স্কাউট প্রতিষ্ঠাতা ভিপি বলেছিলেন ‘তোমরা পৃথিবীকে যেমন পেয়েছ তারচেয়েও সুন্দর রেখে এসো।’

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close