সাহাদাৎ রানা

  ১৭ মে, ২০২২

মতামত

তেল নিয়ে তেলেসমাতি!

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির খবর আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হিসেবে স্থান পেয়েছে সবখানে। বিশেষ করে তেলের মূল্যবৃদ্ধির খবর সবার জন্য অস্বস্তির খবর। তিন মাসের ব্যবধানে কয়েক দফায় তেলের দাম বেড়েছে। সবাই যখন আশা করেছিল ঈদুল ফিতরের পর তেলের দাম কমবে, ঠিক সে সময় অর্থাৎ ঈদের পর তেলের দাম আরো বেড়েছে। লিটারপ্রতি ৩৮ টাকা করে বাড়ানো হয়েছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। প্রাত্যহিক জীবনে অপরিহার্য উপাদান ভোজ্য তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ পড়েছে বিপাকে। অবশ্য ব্যবসায়ীরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে তেলের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার ঘোষণা দিলেও ফল হয়েছে উল্টো। তেল নিয়ে এমন তেলেসমাতির কারণ স্পষ্ট নয়! তবে ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফার লোভই কার্যত সবচেয়ে বড় কারণ। এ ছাড়া শুধু কী তেলের দাম, প্রায় সব নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে কোনো কারণ ছাড়াই।

দুই বছর ধরে দেশের মানুষ করোনার সঙ্গে লড়াই করছে। সেই লড়াইয়ে জীবনযাত্রায় এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। ফলে খাদ্য, বস্ত্র ও চিকিৎসাসহ মৌলিক চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। বাধ্য হয়ে লোকলজ্জার ভয় এড়িয়ে টিসিবির ট্রাকসেলে দাঁড়াতে হচ্ছে তাদের। এমন খবর নতুন হলেও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির খবর অবশ্য নতুন নয়। কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে বাজারে চাল, ডাল, আটা, তেল, ময়দাসহ বেশির ভাগ ভোগ্যপণ্যের দাম ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এ ক্ষেত্রে শুধু সরকারের ওপর দায় ঠেকালে হবে না, এর জন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সমন্বিত পদক্ষেপ।

অন্যদিকে বিশ্ব এক কঠিন সময় পার করছে। করোনার ব্যাপকতা হ্রাস পেলেও এখনো মানুষের মধ্যে রয়ে গেছে আতঙ্ক আর ভয়। সেই সঙ্গে বিরাজ করছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মতো চরম অস্থিরতা। এটা সত্যি, করোনার কারণে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রায় এসেছে পরিবর্তন। বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষদের। গত দুই বছরে অসংখ্য মানুষ কাজ হারিয়েছে। পরিবার-পরিজন নিয়ে কাটাচ্ছে এক দুর্বিষহ জীবন। প্রতিদিনই এ তালিকায় যুক্ত হচ্ছে অনেক শ্রমজীবী মানুষ। শুধু তাণ্ডই নয়, কমে গেছে আয়ের পরিমাণও। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ রয়েছে চরম অস্বস্তিতে।

রমজানের পরও নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। অথচ এই মূল্যবৃদ্ধির পেছনে নেই কোনো যৌক্তিক কারণ। আজ এক পণ্যের দাম বাড়ে তো কাল আরেকটির। পরদিন দেখা যায় অন্য আরেক পণ্যের দাম কেজিতে বেড়ে গেছে কয়েক টাকা। এ বিষয়ে দোকানির সহজ উত্তর ও কমন যুক্তি- চাহিদার চেয়ে পণ্যের জোগান কম। আবহাওয়া খারাপ, পাইকারি বাজারের সঙ্গে নেই খুচরা মূল্যের সামঞ্জস্য। বাজার থেকে সাধারণ ক্রেতা যে দামে পণ্য কিনছেন, উৎপাদক সেই দাম কল্পনাও করতে পারেন না। এর সুফল নিচ্ছেন একশ্রেণির প্রতারক মধ্যস্বত্বভোগী। যারা সাধারণ ক্রেতাদের জিম্মি করছেন, জিম্মি করছেন কৃষকদেরও। কিন্তু যারা নিজেদের সর্বোচ্চ শ্রম দিয়ে পণ্য উৎপাদন করছেন, সেই কৃষক শ্রেণি বঞ্চিত হচ্ছে ন্যায্যমূল্য থেকে। এ ক্ষেত্রে শুধু লাভবান হচ্ছে একশ্রেণির ব্যবসায়ী। আর ঠকছেন কৃষক ও সাধারণ ক্রেতা। আমাদের প্রধান খাদ্য ভাত। সেই ভাতের চালের দামও বাড়ছে কোনো কারণ ছাড়াই। এ ছাড়া নাভিশ্বাস উঠেছে ভোজ্য তেল, মসলা, ডালসহ নিত্যপণ্যের সবকিছুর দাম বৃদ্ধিতে। এখন প্রায় প্রতি সপ্তাহের নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি যেন সবার কাছে সাধারণ ঘটনা। মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ ঘটনা হলেও বিপরীতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস।

সিন্ডিকেট আমাদের দেশে একটি কমন বিষয়। এই কমন বিষয়টির কাছেই এক ধরনের জিম্মি বাজার, জিম্মি সাধারণ মানুষ। অধিকাংশ সময়ে আমাদের দেশে মূলত রাজনৈতিক কারণে আমদানির অনুমতি মেলে। বর্তমানেও তাই হচ্ছে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ব্যবসায়ীদের সরাসরি হস্তক্ষেপে সিন্ডিকেটগুলো বেশি মুনাফালোভী হয়ে উঠছে দিন দিন। সিন্ডিকেটগুলো নিজেদের ইচ্ছামতো পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এমনটা হচ্ছে সবার চোখের সামনেই। কিন্তু এ নিয়ে সরকার সেভাবে ভাবছে না। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঊর্ধ্বমূল্যের প্রধান কারণ হলো একশ্রেণির আমদানিকারক ও পাইকারি পর্যায়ের ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। যারা মূলত তাদের স্বার্থের জন্য বাজার কারসাজি করছে। জিম্মি করছে ক্রেতাকে। এ ক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। এই সুযোগে সিন্ডিকেটরা তাদের পুঁজি বাড়িয়ে যাচ্ছেন। ফলে সাধারণ মানুষের কষ্ট আরো দীর্ঘ হচ্ছে। পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির একটি বড় কারণ। বিভিন্ন এলাকা থেকে পণ্যদ্রব্য ঢাকা বা অন্যান্য জায়গায় যাওয়ার সময় চাঁদাবাজির ঘটনা যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। চাঁদাবাজি বন্ধ না হওয়ায় বাড়ছে পণ্যের দাম। সিন্ডিকেটগুলো ভাঙার ব্যবস্থা করার কথা সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। যার ফলে পণ্যের মূল্য শুধুই বাড়ছে।

এখানে দুঃখের বিষয়, পণ্যের মূল্য বাড়লেও কৃষক শ্রেণি কষ্ট করে তার পণ্য উৎপাদন করলেও পাচ্ছে না ন্যায্য মূল্য। এসব ক্ষেত্রে সেই উৎপাদক শ্রেণিই সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হয়। অথচ তারাই অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি। এদের সহায়ক হিসেবে রয়েছে ব্যবসায়ী শ্রেণি। ব্যবসায়ী ও উৎপাদক শ্রেণি হচ্ছে অর্থনীতির সহযোগী শক্তি। এদের মধ্যে যথাযথ সমন্বয় প্রয়োজন। বিশেষ করে উৎপাদক শ্রেণির মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনা সবার আগে জরুরি। বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে, তারা যে পণ্য উৎপাদন করবেন তার সঠিক ও ন্যায্য মূল্য পাবেন। কোনো সিন্ডিকেটের কাছে তাদের প্রাপ্য মূল্য চলে যাবে না। থাকবেন না জিম্মি হয়ে। আরো একটি বিষয় খুবই জরুরি। সেটা হলো ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান। প্রশাসনের পক্ষ থেকে যদি ঠিকমতো বাজার মনিটরিং করা হয় তবে অনেকাংশে বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। অবশ্য আমরা শুধু এসব ক্ষেত্রে রমজান মাসে কিছু অভিযান দেখি প্রশাসনের পক্ষ থেকে। শুধু রমজান মাসে নয়, সারা বছরই নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। যারা বাজার সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত তাদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনতে হবে।

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, ধারাবাহিকভাবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি। যাদের পক্ষে অধিক মূল্য দিয়ে পণ্য কেনা কষ্টসাধ্য। মাসে নির্দিষ্ট যে আয় হয় তা দিয়ে নিত্যদিনের পণ্য কেনা তাদের জন্য রীতিমতো কষ্টকর। এখন দ্রব্যমূল্যের লাগাম টেনে ধরা জরুরি। অদৃশ্য সিন্ডিকেটদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে বিচারের আওতায় এনে এ ক্ষেত্রে উদাহরণ তৈরি করতে হবে সরকারকে। আর রাজনৈতিক ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটগুলো ভেঙে দিতে হবে। তবেই নিয়ন্ত্রণে আসবে বাজার। এখন সবচেয়ে জরুরি তেলের মূল্য কমিয়ে এনে সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেওয়া।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close