মোতাহার হোসেন

  ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১

পরিবেশ

সুন্দরবনের ঐতিহ্য রক্ষা সবার জন্য অপরিহার্য

পৃথিবীর দেশে দেশে প্রকৃতি, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গবেষক, লেখক, গণমাধ্যমকর্মী, রাজনৈতিক নেতারা প্রতিবাদে সোচ্চার হন মাঠে ময়দানে, লেখালেখিতে। কারণ পরিবেশ প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্যের সঙ্গে অর্থনীতির সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সে কারণে প্রকৃতির সঙ্গে বৈরিতায় শেষমেশ ক্ষতি হয় মানুষেরই। ইউনেসকো ঘোষিত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের সাম্প্রতিক অবস্থা সম্পর্কে একটি খবর প্রকাশিত হওয়ার পর প্রকৃতি রক্ষায় আমাদের অবস্থান ব্যাখ্যার দাবি রাখে। শুরুতেই বলা সংগত, আমরা আমাদের প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বিশ্বের উন্নত দেশগুলো থেকে যোজন যোজন দূরে রয়েছি। পরিণামে প্রকৃতিও আমাদের ওপর সেই প্রতিশোধ নিচ্ছে বিভিন্ন সময়ে।

পরিবেশ রক্ষায় বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী একটি ঐতিহাসিক ঘটনার কথা উল্লেখযোগ্য। ইকুয়েডরে ম্যানগ্রোভ কেটে চিংড়ি চাষ করার প্রতিবাদে ১৯৯৮ সালের ২৬ জুলাই আয়োজিত সমাবেশে মৃত্যু হয় একজন অংশগ্রহণকারীর। সেই থেকে তার স্মরণে ২৬ জুলাই দিনটি বেসরকারিভাবে আন্তর্জাতিক ম্যানগ্রোভ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। অন্যদিকে জাতিসংঘের শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ইউনেসকোর আহ্বানে ২০১৫ সাল থেকে এই দিনটিকে ম্যানগ্রোভ ইকোসিস্টেম সংরক্ষণের আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এর লক্ষ্য ম্যানগ্রোভ ইকোসিস্টেমের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো। বিশেষ করে বাস্তুসংস্থানের স্বার্থে ম্যানগ্রোভের টেকসই পরিচালনা, সংরক্ষণ এবং ব্যবহার নিশ্চিত করাই এর উদ্দেশ্য।

বিশ্বের মধ্যে একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন, যা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত। প্রাকৃতিক নানা কারণ ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমের ফলে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবনে প্রাকৃতিক পরিবেশ আজ হুমকির মুখোমুখি। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, সুন্দরবনে নোনার মাত্রা বেড়েছে। স্বাদু ও নোনা পানির একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় যে প্রতিবেশ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে তাকেই ম্যানগ্রোভ ইকোলজি (বাস্তুতন্ত্র) বলা হয়। এখানকার পানিকে ব্রাকিশ ওয়াটার বলা হয়। এ কারণে এই পানির প্রভাবাধীন এলাকাকে ব্রাকিশ ওয়াটার জোন বলে। এই প্রতিবেশ ব্যবস্থার অন্যতম বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি দ্রুত পরিবর্তনশীল। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নিতে পারে জীববৈচিত্র্যের আধার। ম্যানগ্রোভ বা বিশাল পরিমাণের বনের কারণে উদ্ভিদের পাতা পানির সঙ্গে মিশে জলজ প্রাণী, বিশেষত মাছের খাবার জোগান দেয়। এখানকার মাছ এ কারণে অনন্য স্বাদের। সাম্প্রতিককালে সুন্দরবনে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমেছে; বিশেষত উজান থেকে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় এই সংকট তৈরি হয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবে জোয়ারের পানি অর্থাৎ সাগরের লবণাক্ত পানির চাপ বেড়েছে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. দিলীপ কুমার দত্তের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘আমাদের মিষ্টি পানির উৎস হচ্ছে পাহাড়বাহিত নদী ও বৃষ্টির পানি। শুষ্ক মৌসুমে বৃষ্টি না হওয়া এবং উজানের নদীগুলো থেকে একেবারেই পানি না আসায় জোয়ারের চাপে সাগরের পানি বেশি চলে আসায় লবণাক্ততার আধিক্য ধরা পড়ে, যা বৃষ্টি হলেই কমে যায়। উজানের নদীগুলোর পানি নানাভাবে প্রত্যাহার করে নেওয়ায় আমাদের এখানে মিষ্টি পানির সংকট দেখা দেয়। বছরের বেশির ভাগ সময়ই এখন লবণাক্ত পানির দাপট বেশি থাকে। উপরন্তু পশ্চিমাংশে বিদ্যাধরী নদীর মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মিষ্টি পানির জোগান প্রায় বন্ধ। ফলে লবণাক্ততার তেজ বেড়েছে। মাটি ও পানিতে লবণাক্ততার বাড় বাড়ন্তে অনেক প্রজাতির গাছ একেবারেই হচ্ছে না; অথবা সাংঘাতিকভাবে এর বৃদ্ধি কমে গেছে- যেমন সুন্দরি, গোলপাতা। শুষ্ক মৌসুমে লবণাক্ততার পরিমাণ সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক গুণ বেশি বৃদ্ধি পায়।’

ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদরাজি বায়ুমণ্ডল থেকে প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড টেনে নেয়। এতে পরিবেশের দূষণ কমে। কার্বন ডাই-অক্সাইডকে খাদ্যে রূপান্তর করে লবণাক্ত পানির এই উদ্ভিদরাজি বেড়ে ওঠে। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনে ৩৪ প্রজাতির গাছ আছে। এরই মধ্যে কেওড়াগাছ সর্বাধিক কার্বন ডাই-অক্সাইড তার শিকড়, কাণ্ড, ডালপালা ও পাতায় আটকে রাখতে পারে। এক হেক্টর কেওড়াবন বছরে ১৭০ টন পর্যন্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড আটকে রাখতে পারে। বাইনের ক্ষেত্রে তা ১১৫ টন, গোড়ান তা ২৩ টন। গাছের বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ওই ক্ষমতা কমতে থাকে।

সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলে মোটামুটি ৬৬২ কোটি টন কার্বন ডাই-অক্সাইড আটকে রাখে সেইসঙ্গে প্রতি বছর আরো ৩৮ লাখ টন যোগ হচ্ছে। এই বনের মৎস্য সম্পদের (মাছ ও চিংড়ি, কাঁকড়া, কুঁচে প্রভৃতি) ওপর এখনো বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল। বিশেষত ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত থেকে সুন্দরবন মানুষের জীবন, সম্পদ ও জনপদকে রক্ষা করে চলেছে। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় থেকে শুরু করে সব প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধসহ সাম্প্রতিককালে আঘাত হানা আম্পান, যশেও সুন্দরবন বুক উঁচিয়ে রক্ষা করেছে। অবশ্য নদীতে অধিক হারে পলি জমছে। এতে নদীগুলোর গভীরতা কমে যাচ্ছে। এ কারণে ইয়াসে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে সুন্দরবনের প্রায় পুরো এলাকা তিন থেকে চার দিন ডুবে ছিল। বনের মধ্যকার মিষ্টি পানির পুকুরগুলো নোনাক্রান্ত হয়। এতে প্রাণিকুল সুপেয় পানির সংকটে পড়ে। এ ছাড়া আরো দুবার সুন্দরবনের ঘষিয়া খালি নদীতে তৈলবাহী ট্যাংকার ফেটে ট্যাংকারের সবতেল, মবিল নদীকে ভীষণভাবে দূষণ করে। প্রসঙ্গক্রমে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের এক অধ্যাপকের মন্তব্য হচ্ছে, ‘প্রাকৃতিক কারণেই সুন্দরবনের নানা পরিবর্তন ঘটছে। দৃশ্যমানভাবে আমরা জানতে পারছি যে অনেক গাছ, প্রাণী, পাখি হারিয়ে গেছে। অন্যদিকে সুন্দরবনের সামুদ্রিক পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা বেড়েছে, মিষ্টি পানির প্রবাহ কমেছে। এই অতিরিক্ত লবণাক্ততাই সুন্দরবনের জন্য এখন মারাত্মক সমস্যা। তবে শত বছরেরও বেশি আগের ১৯০৩ সালের ডকুমেন্ট বলছে, এই অঞ্চলে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমছে।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল হচ্ছে সুন্দরবন। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে এর আয়তন ১০ হাজার ২৩০ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে ৬ হাজার ৩০ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশে। বাকিটা ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। কাজেই প্রকৃতি, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য বিশেষ করে উপকূলীয় মানুষের জীবন, জীবিকা, সম্পদ রক্ষার স্বার্থেই সুন্দরবনের প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। দরকার সম্মিলিত উদ্যোগ। পিআইডি ফিচার

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

সাধারণ সম্পাদক- বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close