reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২০

পর্যালোচনা

মেধা ও মেধাবী মূল্যায়ন এবং দুর্বলতা

অলোক আচার্য

মেধা বলতে প্রকৃতপক্ষে কী বোঝায়? আমরা যখন কোনো শিশুকে মেধাবী বলে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি, তখন তার মানদন্ড কী হচ্ছে, তা নিয়ে ভাবতে হবে। ব্যক্তির মেধা এবং মেধার স্বরূপ যদি যাচাই করা না যায় বা তার যাচাই প্রক্রিয়ায় যদি ত্রুটি থেকে যায়; তাহলে কোনো দিনই সেই ব্যক্তির মেধা প্রকাশ করা সম্ভব হবে না। মেধা বিকশিত হওয়ার জন্য কয়েকটি বিষয় জড়িত থাকে। এক. ব্যক্তির পারিপাশির্^ক অবস্থা দুই. মেধা যাচাইয়ের পদ্ধতি। ব্যক্তির ব্যক্তিত্বও এ ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে। কারণ ব্যক্তি যদি লাজুক স্বভাবের হয় এবং মিশতে লজ্জাবোধ করে, তাহলে তার মেধার দিকটি এক রকম অন্ধকারেই থেকে যায়। মেধা বিকাশের একটি ক্রম প্রয়োজন হয় এবং ধীরে ধীরে সুপ্ত প্রতিভা বিকাশ লাভ করে। বলা হয়ে থাকে যে, একজন শিক্ষকের অন্যতম প্রধান দায়িত্বই থাকে শিক্ষার্থীর সুপ্ত মেধা বিকাশে সহায়তা করা। কিন্তু আজকাল কি সেই দায়িত্ব পালতি হচ্ছে? আজকাল শিক্ষক কেবল শ্রেণিতে পাঠদান এবং সিলেবাস শেষ করার দিকেই অত্যধিক মনোযোগ দিচ্ছেন। এ ছাড়া আর বিকল্প উপায়ও নেই তার হাতে। তার প্রধান দায়িত্বই হলো পরীক্ষায় সন্তান যেন ভালো ফলাফল করতে পারে, সেদিকে লক্ষ রাখা। মেধা নিরূপণ করার সহজ একটি পদ্ধতি হলো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এবং তার মূল্যায়নে নেওয়া পরীক্ষা। সেই পরীক্ষা পদ্ধতি একজনের সত্যিকারের মেধা বের করতে পারছে কি না বা যাচাই করার সর্বোত্তম পন্থা কি না, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা পদ্ধতি মেধা যাচাই করার একটি কার্যকর পদ্ধতি হতে পারে, তবে তা মেধার বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে প্রয়োগযোগ্য নয়। কারণ সেক্ষেত্রে আমাদের দুর্বলতা রয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমি প্রথমেই বিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করছি। তার বক্তব্য হলো, সব মানুষ-ই প্রতিভাবান, কিন্তু আপনি যদি একটা মাছকে তার গাছে ওঠার ক্ষমতা দিয়ে বিচার করেন, তাহলে সে নিজেকে সারা জীবন মূর্খ্যই ভেবে যাবে।

আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় মনে হয় আমরা সেই রকম মেধা খুঁজে বের করার চেষ্টাই করেছি। কারণ সহশিক্ষাক্রমিক কার্যক্রম জোরদার করার প্রয়াস খুব বেশি বছরের না। অন্তত আমাদের সময়ে তো নয়ই। আজও মফস্বলের কোনো স্কুলে কতটা সহশিক্ষাক্রমিক কাজ করানো হয় বা বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সহশিক্ষাক্রমিক কার্যক্রমে কতগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করে তার হিসেব করলেই প্রকৃত বিষয় স্পষ্ট হবে। এর কারণ হলো চর্চার অভাব এবং দুই. পরিবেশের অভাব। এজন্য কোনো মানদন্ডে মেধার মূল্যায়ন করা হয় বা আমরা যে পদ্ধতিতে মেধাবীদের চিহ্নিত করছি, তা কতটুকু বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে যুক্তিসংগত তা আলোচনার দাবি রাখে। মেধা এবং মেধাবীদের বিষয়ে আমাদের দেশের মানুষের ধারণা যে একটি নির্দিষ্ট রেখায় গিয়ে মিলিত হচ্ছে, সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর সেটা হচ্ছে পরীক্ষার মূল্যায়ন। স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে যত ভালো ফলাফল করছে, সে তত মেধাবী বলেই গণ্য করা হয়। আমাদের দেশে অন্তত সেই মূল্যায়নই যথেষ্ট বলে ধরে নেওয়া হয়। সেই ভালো আবার কেবল গণিত বা ইংরেজি বিষয়ের দক্ষতার ওপর নির্ভর করে। একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় একেবারে প্রাথমিক শ্রেণি থেকে গণিত ও ইংরেজি বিষয়ের ওপর দক্ষতাকেই গুরুত্বারোপ করা হয়। অন্য কোনো বিষয়ের দক্ষতাকে আজও সেভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। অথচ উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে কেবল লেখাপড়ার মূল্যায়নের মাধ্যমে প্রকৃত মেধাবী বের করার পদ্ধতিটা সেকেলে। মেধা বলতে একজন ব্যক্তির বিশেষ বিষয়ের ওপর পারদর্শিতা বোঝানো হয়। সেই বিশেষ বিষয় যেমন কোনো বিষয়ভিত্তিক হতে পারে আবার হতে পারে নাচ, গান, আবৃত্তি, অভিনয়, খেলাধুলা বা এ রকম কোনো বিষয়। কিন্তু কেবল এসবের বিচারে আমাদের দেশে কাউকে মেধাবী বলা হয় না।

মেধার বিচার হয় মানদন্ডে। কিন্তু সেটা কী? সেটা কি কেবল পরীক্ষায় প্রথম বা দ্বিতীয় হওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ? যে ছাত্র বা ছাত্রীটি প্রতি বছর খেলাধুলায় প্রথম হয় এবং সে যদি পরীক্ষায় প্রথম দশের ঘরেই না থাকতে পারে তখনো কি আমরা তাকে মেধাবী বলে সায় দিচ্ছি? উত্তর হলো, না। কেবল খেলাধুলা বা অন্য কাজে পারদর্শী হলেই চলবে না। আমাদের সমাজে একজনের বহুবিধ গুণ থাকতে হবে বিশেষ করে প্রতিটি সাবজেক্টে ভালো মার্কস তুলতে পারার ক্ষমতা এবং আরো বিশেষ করে গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে দক্ষ ছাত্রছাত্রীর পরিচয় দেয়। তবে সে মেধাবী। এই মেধাবী আবার যখন ভালো চাকরি জোটাতে ব্যর্থ হয়, তখন তাকে আবার মেধাবীর আসন থেকে টেনে নামানো হয়। তখন আবার যে একটা ভালো চাকরি জোটাতে পারে মেধাবীর তকমাও তখন তার গায়েই লাগে। আজব ব্যাপার! ধরা যাক, একটি শ্রেণিতে একজন শিক্ষার্থী অত্যন্ত ভালো বাচনভঙ্গিতে কথা বলতে পারে। সে খুব ভালো যুক্তি দেখাতে পারে। কিন্তু গণিত বা ইংরেজি বা বিজ্ঞান তার কাছে আকর্ষণীয় মনে হয় না। ফলে সে অন্যান্য বিষয়ে ভালো করলেও সেসব বিষয়ে তার ফলাফল ভালো নাও হতে পারে। এখন যদি এর ভিত্তিতে বলে দেওয়া হয় যে, সে খারাপ শিক্ষার্থী তাহলে আফসোসের শেষ থাকবে না। কারণ সে খুব ভালো বক্তা হতে পারে। অথবা অন্যকিছু। তার মনে যা চায়।

আমাদের দেশে চাকরির পরীক্ষায় যে মূল্যায়ন পদ্ধতি তাতেও কি শতভাগ প্রকৃত মেধাবী বের করে আনা সম্ভব হচ্ছে? সেখানেও মেধাবীরা বহুভাবে বিতর্কিত হচ্ছে। যে যত ভালো মুখস্থ করছে, যত বেশি কৌশল আয়ত্ত করতে পারছে; সে পরীক্ষায় তত ভালো করছে। বাজার ভর্তি এসব শটকার্ট পদ্ধতির বইয়ে। আপনি যত ভালো টেকনিক জানবেন চাকরির পরীক্ষায় তত ভালো ফল করবেন। আপনিই হবে শেষ পর্যন্ত মেধাবী। আপাতত মনে হবে সেই আসলে মেধাবী। কিন্তু বাড়িতে বসে নতুন কিছু তৈরি করছে, কোনো আবিষ্কার করছে এমনকি কোনো গল্প বা কবিতা লিখছে; সেও কি মেধাবী নয়। কেবল কোনো পরীক্ষায় টিকতে না পারার জন্য তাকে মেধাবীর তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হবে। এটাই হচ্ছে। তাই মেধার সংজ্ঞাটা আর একটু বদলানো দরকার। অন্তত আমরা যদি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছ থেকে নতুন কিছু প্রত্যাশা করি। তাদের যদি নতুন পথের ঠিকানা দিতে চাই; তাহলে আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখাতে হবে। বিসিএস করে যারা আসছে, তারা অব্যশই মেধাবী। কিন্তু যারা বিসিএস করতে পারছে না বা অতদূর পড়ালেখাই করতে পারছে না, তাদের ভেতরেও মেধাবী শিক্ষার্থী বাস করে। ফলে মেধার সংজ্ঞাটা কেবল চাকরির ভাঁজে আটকে রাখলেই চলবে না। আবার ফিরে আসি বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের কথায়। কথাটা যদি আমরা আরো ব্যখ্যা করতে যাই তাহলে দেখা যাবে আজকের সমাজের প্রেক্ষাপটে এটাই ঘটে চলেছে অবিরত। এমনকি সে মেধাবী নয় বা তার কোনো কাজ যে মেধাবীদের কাজের সঙ্গে সামঞ্জস্য নয় তাও আমরা একজনকে বুঝিয়ে দিই। কেন আমরা ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার ছাড়া একজন সায়েন্সের ছাত্রছাত্রীর কাছে থেকে অন্যকিছু প্রত্যাশা করতে শিখিনি। আমরা ধরেই নেই, সে বিজ্ঞান বিভাগ পরে বড় ডাক্তার হবে। কেন সে বড় বিজ্ঞানী হবে, এই চিন্তা মনে ধারণ করছি না। আমাদের চিন্তা-চেতনা ধ্যানধারণায় পরিবর্তন না আনলে এই গতিধারার আমূল পরিবর্তন কখনোই সম্ভব হবে না। মেধাবীদের প্রকৃত মূল্যায়নও তত দিন অধরাই থেকে যাবে। আবার প্রকৃত মেধাবী বের করে আনা কষ্টসাধ্য হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close