অলোক আচার্য্য
বিশ্লেষণ
চিকিৎসক চিকিৎসা এবং...
ডাক্তার এমন একজন মানুষ, যার ওপর মৃত্যুর কাছাকাছি থাকা একজন ব্যক্তি সৃষ্টিকর্তার পরই তাকে ভরসা করেন। কয়েক দশক আগের ডাক্তারের সঙ্গে আজকের ডাক্তারদের কিছুটা পার্থক্য আছে। একসময় ডাক্তারবাবুরা সেবামূলক মনোভাব নিয়েই ডাক্তারি পেশায় আসতেন। আর আজকাল অধিকাংশ ডাক্তারই পেশাদার এবং ব্যবসায়ী। অর্থ উপার্জনই এই পেশায় আসার মূল কারণ। রোগী থেকে ফি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্য সব মানুষ যেমন সমান নয়, তেমনি সব ডাক্তারও এক নন। তবে বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই একই চেতনা। গলাকাটা ভিজিটের সঙ্গে নানা রকম পরীক্ষার ফি গুনতে হয় রোগীকে। রোগী বেচারা ভালো করেই জানে যে তাকে কেবল ডাক্তারবাবুর জন্য ভিজিট নিলেই হবে না, মোটা টাকা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফিও দিতে হবে। আর এ জন্য দেশে অনুমোদনপ্রাপ্ত এবং অসংখ্য অনুমোদনহীন ক্লিনিক অলি-গলিতে গড়ে উঠেছে। সেখানে ডাক্তার আছে কী নেই, অপারেশনের জন্য বিশেষজ্ঞ আছে কী নেই, তার খোঁজ নেওয়ারও কিছু নেই। কর্তৃপক্ষও সেসব দেখভাল করেন না বললেই চলে। ডাক্তারদের অনেকেই নিজের দায়িত্ব থাকার সময়ও সেসব ক্লিনিকে রোগী দেখেন। এমনকি বেশির ভাগ ডাক্তারের সঙ্গেই ক্লিনিকের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। কোন ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে পরীক্ষা করাতে হবে, তাও স্পষ্ট করে বলে দেন রোগীকে। তা না হলে ডাক্তারবাবু নাখোশ হন। সেখান থেকে যে কমিশন আসে তার! ডাক্তারদের কাছে নতুন রোগী পুরনো রোগীর একটা ব্যাপার আছে। নতুন রোগীর এক ফি, আবার এক মাসের ভেতরে গেলেই সেই রোগী পুরনো হিসেবে গণ্য হন। তখন তার ফি হয় একটু কম। আবার এক মাস পর তিনি-ই হন নতুন রোগী। এ রকম নানা হিসাব-নিকাশ আছে। এসব হিসাবের প্যাঁচে বেচারা রোগীই বুঝতে পারেন না তিনি নতুন না পুরনো। ডাক্তারভেদে দিন মাসের পার্থক্য আছে। অথচ আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে, এই ডাক্তারদের মধ্যে কেউ কেউ ছোটবেলায় তোমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা রচনা লেখার সময় ডাক্তার হয়ে গ্রামে গিয়ে গরিব মানুষের সেবা করার কথা লিখেছিলেন। তবে কি সেসব কেবল লেখার জন্য ছিল? সেবা বিষয়টি আজ গৌণ্য মুখ্য কেবল অর্থ। সাংবাদিক বন্ধুর ফেসবুক পোস্ট থেকে জানতে পারলাম, তার এলাকার ক্লিনিকে বসা বিষেজ্ঞ ডাক্তাররা গ্রামের মফস্বল ডাক্তারের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ আছে। মফস্বলের এসব ডাক্তার যদি ওই ডাক্তারের কাছে রোগী পাঠাতে পারেন, তাহলে তার একটা অংশ সেই মফস্বলের ডাক্তারকে দিতে হয়। এটা তারা নিজেরাই আলোচনা করার সময় আমার বন্ধুবর শুনে ফেলেন।
একসময় রোগী ডাক্তার খুঁজতেন আর এখন ডাক্তার রোগী খুঁজে বেড়ান। আমাদের হাটে বাজারে কতশত ডাক্তারের প্রচারে মাইকিং শোনা যায়। তার নামের পেছনে এত ডিগ্রি থাকে যে খোদ ডাক্তারবাবুর নামটাই শেষ পর্যন্ত ভুলে যাই। এসব ডাক্তার সপ্তাহে একদিন বা দুদিনের জন্য পল্লী গাঁয়ে ছুটে যান রোগী দেখতে। আবার সেই ডাক্তারকেই যদি গ্রামের কোনো হাসপাতালে বদলি করা হয়, তাহলে সেখানে যেতে গড়িমসি করেন। নানা তদবির করে গ্রামে যাওয়া স্থগিত করে দেন। বছরের পর বছর এ রকম ওপর মহল ম্যানেজ করে শহরে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। আমাদের দেশে ওপর মহলের বিশাল ক্ষমতা! বিষয়টি আমার কাছে বেশ রহস্যজনক মনে হয়। অনিয়ম কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে! ডাক্তার, ইন্টার্ন ডাক্তারদের সঙ্গে প্রায়ই রোগীর স্বজনদের হাতাহাতির ঘটনা ঘটছে। কিছুদিন আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজে এক ডাক্তারকে মারাত্মক আহত করে তার হাত ভেঙে দিয়েছেন রোগীর আত্মীয়স্বজন। তার ভাষ্যমতে, রোগী যখন ভর্তি হন, তখনই লাস্ট স্টেপে ছিলেন। ডাক্তার এবং রোগীর সম্পর্ক হবে বন্ধুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমাদের দেশে তা হয় না। রোগীর স্বজন মনে করেন, ডাক্তার চিকিৎসায় অবহেলা করছেন আর অনেক ডাক্তার রোগী নিয়ে মোটা আয়ের পথ খোঁজেন। আসলে বিশ্বাসটা উঠে গেছে। আজকাল ঘন ঘন দেশের বিভিন্ন মেডিকেল হাসপাতালে রোগীর স্বজনদের সঙ্গে প্রায়ই ডাক্তার, ইন্টার্ন ডাক্তার এবং স্টাফদের কথা-কাটাকাটি এমনকি হাতাহাতির ঘটনা ঘটছে। আবার অনেক কুৎসিত ঘটনাও ঘটছে। সিলেটে ইন্টার্ন ডাক্তার রোগীর স্বজনকে ধর্ষণ করার ঘটনা ঘটেছে। এই ইন্টার্ন ডাক্তার এক দিন বিষেজ্ঞ ডাক্তার হবেন! তবে তিনি বড় মানুষ হবেন কি? রোগী কেন মারা গেলেন, তার সঠিক কারণ না জেনেই হুলস্থূ’ল কা- অনেকেই ঘটাচ্ছে। ভাঙচুর করছে। ভাঙচুর করতে আমাদের দেশে অতি-উৎসাহী কিছু মানুষই আছে। যারা কথায় কথায় ভাঙচুর করে। ডাক্তার তার সাধ্যমতো চেষ্টা করবেন কিন্তু কারো জীবন দেওয়া তার হাতে নেই। সে কিন্তু আমরা তা না বুঝেই লঙ্কাকা- বাধিয়ে ফেলি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আমাদের সবার মধ্য থেকেই ধৈর্য এবং সহিঞ্চুতা উঠে যাচ্ছে। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারি না। কেউ কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে নারাজ। ডাক্তার যেমন রোগীর স্বজনদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছেন, অন্যদিকে রোগীর স্বজনদের ধৈর্য নেই। তাই পান থেকে চুন খসলেই ডাক্তারকে ধর। তারপর হাসপাতালে ভাঙচুর চালানো হয়। একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস এসব ঘটনার পেছনের মূল কারণ। কারণ গুটিকতক ভালো মনের ডাক্তার ছাড়া আমাদের দেশে ডাক্তারবাবুদের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে অতিরিক্ত সুসম্পর্ক সবারই জানা। তাদের দেখানো ক্লিনিক থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হয়। এত কিছুর পরও রোগী বিশ্বাস রাখেন যে ডাক্তারবাবু হয়তো তাদের জন্য সঠিক সিদ্ধান্তই নিচ্ছেন। রোগীকে আইসিইউতে বিনা কারণে আটকে টাকা আদায়ের জন্য কিছুদিন আগেই এক নামকরা ডাক্তার গ্রেফতার হলেন।
সম্প্রতি চট্টগ্রামের বেসরকারি একটি হাসপাতালে একজন সাংবাদিক মেয়ের মৃত্যু নিয়ে বেশ হইচই হয়ে গেল। ক্লিনিকগুলো ধর্মঘট পর্যন্ত করেছে। আজকাল অবশ্য ধর্মঘট তেমন কোনো বিষয় নয়। ন্যায় হোক বা অন্যায় হোক যেকোনো দাবির জন্য ধর্মঘট হয়। তবে অন্যান্য ক্ষেত্রে এক রকম কিন্তু ডাক্তারবাবুরা ধর্মঘট করে বসে থাকলে সেটা এক রকম। আমি আগেই বলেছি, মৃত্যুপথযাত্রীর পৃথিবীতে শেষ ভরসা থাকেন একজন ডাক্তার। সেবা খাতে এ রকম হুটহাট ধর্মঘট আর কোনো দেশের ডাক্তাররা করেন কি নাÑআমার জানা নেই। চিকিৎসায় ভুল আর অবহেলা দুটো দুই রকম শব্দ। তার অর্থের পার্থক্যও বিশাল। তবে এই ভুল চিকিৎসাক্ষেত্রে জীবনের মতো বড় মাশুল দিতে হয়। তাই এ ক্ষেত্রে ভুলটা না করাই ভালো। সেই বেসরকারি হাসপাতালে মারা যাওয়া মেয়েটি সাংবাদিককন্যা বা অন্য কারো কন্যা, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো মেয়েটির মারা যাওয়ার কারণ। সেটি যদি ডাক্তার। মাঝেমধ্যেই দেখা যায়, ইন্টার্ন চিকিৎসকরা বিভিন্ন দাবিতে ধর্মঘট ডাকছেন। সব সেবা কার্যক্রম বন্ধ করে তারা সেই ধর্মঘট সফল করে তুলছেন। তা ছাড়া রোগীর সঙ্গে বাগ্বিত-া এমনকি হাতাহাতির ঘটনা একেবারেই নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডাক্তারি একটা মহান পেশা। এই পেশার সঙ্গে জড়িতদের মানুষ সব সময় সুপারম্যান হিসেবে দেখে। কারণ এই ডাক্তার মানুষের শেষ সময়ের আশার আলো দেখাতে পারেন। কিন্তু আমাদের এসব ইন্টার্ন চিকিৎসক যারা আর কয়েকদিন পরই পূর্ণাঙ্গ ডাক্তার হয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সেবা করতে যাবেন, তাদের এই অসহিষ্ণুতা দেখানো মোটেই যুক্তিযুক্ত নয়। ডাক্তারি পেশার মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ সেবা খাতে কথা কথায় ধর্মঘট করা সমীচীন নয়। সেবামূলক পেশায় থেকে ধৈর্য এবং সহিষ্ণুতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই আসতে হবে। রোগীর সঙ্গে বা তার সঙ্গে আসা লোকদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য এবং হতাশাজনক। ডাক্তার হওয়ার আগে তাই মানুষ হওয়াটা অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
"