এস এম মুকুল
গবেষণা
চিন্তাসূত্র
মানুষ মাত্রই চিন্তা করে। চিন্তার দ্বারা অনেক কিছুই সৃজন এমনকি অনেক ধ্বংসলীলা ঘটতে পারে। অন্যভাবে বলা যায়, প্রতিটি মানুষ কমবেশি ভালো চিন্তা করে, আবার সচেতন বা অবচেতনভাবে খারাপ চিন্তাও করে। স্বভাবত কারণে খারাপ চিন্তার কথা কেউ স্বীকার করে না। কথায় আছেÑভালো চিন্তায় ভালো ফল, মন্দ চিন্তায় রসাতল। পজিটিভ চিন্তা মানুষকে পজিটিভ দিকে পরিচালিত করে, আর নেগেটিভ চিন্তা মানুষকে নেগেটিভ পথে নিয়ে যায়। তার মানে ভালো কাজের পূর্বশর্ত হলো ভালো চিন্তা করা, অন্যপক্ষে খারাপ চিন্তায় ভালো ভালো কিছু আশা ঠিক নয়। প্রচলিত অর্থে চিন্তার ধরন চারটিÑসংকীর্ণ চিন্তক, যারা পরনিন্দা-পরচর্চায় সময় কাটান, সাধারণ চিন্তকÑযারা প্রতিদিনকার ঘটনা বিশ্লেষণ করতে ভালোবাসেন, মহৎচিন্তক, যারা সমস্যা সমাধানের উপায় খোঁজেন এবং শ্রেষ্ঠতর চিন্তক, যারা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। চিন্তা জিনিসটা আসলে কী। চিন্তা করলে কী লাভ, কী ক্ষতি? চিন্তার সৃজনশীলতা অথবা চিন্তার ভালো-মন্দ কত কথাই হতে পারে। তবে চিন্তা নিয়ে এই কবিতায় কী বলছে জেনে নেওয়া যাকÑ‘দিন চলে যায়, রাত চলে যায়/ ঘড়ির কাঁটার তালে তালে/জীবন থেকে আয়ু ফুরায়।/দিনের শেষে রাত্রি হলে/এই নাগরিক জীবন ঘিরে/সারাদিনের হিসেব চুকে/মাথায় নানান চিন্তা ঢুকে।/চিন্তা ভীষণ অন্তহীনা/চিন্তা দারুণÑঅমল অসুখ,/হরেক রকম ওষুধ খেলে/চিন্তানাশক তেল মাখিলে/চিন্তা কভু ঘর ছাড়ে না।/ অতীতের এই হিসাব খুলে/দেখবে যখন নয়ন মেলে/পাতায় পাতায় ভুলে ভরা,/যোগ বিয়োগ আর গুণন, ভাগের/চোখ ধাঁধাঁনো ফাঁদে পড়ে/ভুল হিসেবে জীবন গড়া।/ভুল করে আর না ভাবিয়া/ভুলের আগেÑভেবে চিন্তে/সোনার জীবন সোনার আলোয়/মনের মতোন দাও ভরিয়া।/যারা কেবল কাজের ভীড়ে/কিংবা যারা অলস, কর্মহীনা/সবাই যারা চিন্তা করে ঘুমাও শুধু,/কিংবা যাদের চিন্তা নিয়ে/চিন্তা করে ঘুম আসে না,/আমি বলি লাভ কীরে ভাইÑ/সময়টাতো যাচ্ছে বয়ে/তাই তোমাদের ডাক দিয়ে যাই/চিন্তাহীনা জীবন গড়ো/চিন্তাহীনা। আসলেই চিন্তাহীনা জীবন গড়ার প্রয়াশ থাকা দরকার।
চিন্তা আসলেই একটা জটিল বিষয়। চিন্তা হলো এক ধরনের প্রাক-কল্পনা। মানুষের আবেগ, বস্তুনির্ভর জ্ঞান, অন্তর্র্দশন এবং সামাজিক চেতনার প্রতিফলন যা মস্তিষ্কে আন্দোলন ঘটায় বাস্তবতার অণুরণে। প্রথমত, মানুষের কল্পনা থেকে মস্তিষ্ক একটা ইমেজ তৈরি হয়, সেই ইমেজ বা চিত্রকে নিয়েই মস্তিষ্কে বাস্তবতার অনুরণনের উদ্ঘাটন প্রক্রিয়াকেই আমরা বলি চিন্তা। সাধারণভাবে দাবি করা হয় মানুষ অন্যান্য প্রাণীর চেয়ে উন্নত। কারণ মানুষের চিন্তা করার ক্ষমতা আছে। সৃষ্টিগতভাবে মানুষ চিন্তাশীল প্রাণী। মানুষ আহার-নিদ্রা যাপনের পাশাপাশি চিন্তাও করে অবিরত। অবাক করার বিষয় হলো সব মানুষের চিন্তাশক্তি আছে; কিন্তু অমিলটি হলো মানুষে মানুষে চিন্তার ভিন্নতার কারণে সব মানুষ এক রকম নয়? গবেষকরাও তাই বলছেন, চিন্তার ভিন্নতাই মূলত মানুষে মানুষে ভিন্নতা তৈরি করে। চিন্তার মাধ্যমে বাস্তব জীবন ও দর্শনে পরিবর্তন আনা সম্ভব। ফ্রেঞ্চ সাইকোলজিস্ট এমিল কো গবেষণায় দেখেছেনÑমানুষ যখন ভালো কথা বারবার বলে, তখন ভালো জিনিস তার কাছে আসতে থাকে। ফলে জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে। তাই জীবনে পজিটিভ পরিবর্তন বা সাফল্য আনতে চাইলে প্রথমে ইবষরবভ ংুংঃবস বা দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। চিন্তা সম্পর্কে কথিত আছে, একদা লোকমান হেকিম তার একজন বুদ্ধিমান খাদেমকে নির্দেশ দিলেনÑযাও, আমার বকরিপাল থেকে একটি বকরি জবেহ করে তার সর্বোত্তম কয়েকটি অংশ নিয়ে এসো। খাদেম একটি বকরি জবেহ করে তার জিহ্বা, হৃৎপি- ও মগজ নিয়ে এলো। কিছুদিন পর লোকমান হেকিম ওই খাদেমকে আবার নির্দেশ দিলেনÑএকটি বকরি জবেহ করে তার সর্বনিকৃষ্ট অংশ নিয়ে আসো। খাদেম এবারও জিহ্বা, হৃৎপি- ও মগজ নিয়ে এলো। লোকমান হেকিম বললেন, তোমাকে প্রথমবার উত্তম অংশ আনতে বললাম তুমি যা নিয়ে এলে, খারাপ অংশ আনতে বললে তুমি তা-ই নিয়ে এলে। খাদেম বলল, এ তিনটি অঙ্গই ভালো ও মন্দের নিয়ন্ত্রক। তার মানে হলোÑউত্তম চিন্তা ও উত্তম কথা দ্বারা মানুষ উত্তম হয়, আবার খারাপ চিন্তা ও খারাপ কথা দ্বারা মানুষ অধমে পরিণত হয়। আল্লাহ বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের শ্রবণ, দৃষ্টি ও চিন্তা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ৩৬)। ইসলামে সৎ চিন্তা ও উত্তম কথা বলার গুরুত্ব অনেক।
ভিন্নতর চিন্তাকে বলা হয় ক্রিটিক্যাল থিংকিং। সমাজবিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, একজন মানুষের থট প্রসেস গ্রো হয় ছয় থেকে চব্বিশ বছর বয়সের মধ্যে। অর্থাৎ প্রথম শ্রেণি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আমরা যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাই তার ওপরই নির্মিত হয় আমাদের চিন্তা করার ক্ষমতা। চিন্তা ও চিন্তাশক্তির কারণে মানুষ পশু থেকে পৃথক হয়েছে। ভিন্নতর চিন্তাশক্তিই লেখক, বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যিকদের ভিন্ন ভিন্ন জায়গা সৃষ্টি করে দিয়েছে। ভেবে দেখুন, পৃথিবীর সব কবি যখন আকাশের চাঁদকে প্রিয়ার মুখচ্ছবি মনে করেন, তখন কবি সুকান্ত আকাশের ভরা পূর্ণিমা চাঁদকে মনে করেন ঝলসানো রুটি। ভিন্নতর এই চিন্তাশক্তির কারণেই তিনি কবি সুকান্ত। পৃথিবীর সৃষ্টি রহস্য নিয়ে যারা যত স্বাধীন ও গভীরভাবে চিন্তা করতে পেরেছেন, তারা তত বড় প্রাজ্ঞ, জ্ঞানী ও মনীষী হয়েছেন। চিন্তার দুটো দিকÑচিন্তার ভালোটা ভালো, মন্দটা মন্দ। চিন্তার সাফল্য আছে, বিফলতাও আছে। তবে চিন্তার উ?ৎকর্ষেও কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। ছক-বাঁধা সংজ্ঞা নেই চিন্তার স্বাধীনতার। ফোর্বস ম্যাগাজিনে ক্যারিয়ার বিশেষজ্ঞ ট্রাভিস ব্রাডবেরি বলেছেন, অহেতুক চিন্তাটা পরিত্যাগ করুন, কারণ আপনার লক্ষ্য নির্ধারণে চিন্তা পদে পদে বাধা সৃষ্টি করবে। জয়-পরাজয় মানব জীবনেরই অংশ। পথ চলতে গেলে হোঁচট খাওয়া বা জীবনে ব্যর্থতার শিকার হতেই পারেন। ভুল হতেই পারে। তাই বলে সমস্যা নিয়ে পড়ে থাকলে নেতিবাচক চিন্তারা বাসা বাঁধবে এবং নিজের মনেই সন্দেহের দানা বাঁধবে। তাই এ নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করলে আত্মবিশ্বাস হারাতে থাকবেন। জীবনে পরাজয়ের দিকে এগিয়ে যাবেন!
চিন্তার সমার্থক বা সংযোজক শব্দটি হলো ভাবনা। তাই আমরা চিন্তাভাবনা কথাটিও বলে থাকি। মানুষের ভাবনারও দিক আছে দুটিÑএকটি হলো যৌক্তিক, অপরটি আবেগীয়। আবেগকে প্রশমন বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ হয়, সহজ হয়। মানুষ কেন ভালো বা মন্দ চিন্তা করেÑএর প্রধানতম কারণ তার দৃষ্টিভঙ্গি। অতীতের কোনো পরিস্থিতি বা ঘটনাকে কী বিশ্বাসে গ্রহণ করে রেখেছে এবং বর্তমান ঘটনা প্রবাহ কী বিশ্বাসে গ্রহণ করছেÑতা থেকে তার বর্তমান ভালো বা মন্দ চিন্তার সৃষ্টি হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, একজন মানুষ প্রতিদিন ভালোমন্দ মিলিয়ে প্রায় ৩০ হাজার চিন্তা করে। মনে রাখবেন একটি ভালো চিন্তা আপনার এমনকি চারপাশের সুখ-প্রশান্তি বাড়িয়ে দিতে পারে। পক্ষান্তরে বাজে বা নেতিবাচক চিন্তা আপনার সুখ-শান্তি ধ্বংস করে দেয়। কিন্তু আপনি অবাক হবেন, প্রতিটি মানুষ যা কিছু করে তার পেছনে তার জুতসই যুক্তি এমনকি কারণও তৈরি করা থাকে। কারণ ছাড়া মানুষ কোনো কাজ করে না। বাস্তবতা হলোÑপ্রতিটি মানুষ তার নিজের যুক্তি ও বুদ্ধিতে চলে সেটা বিচারের মানদ-ে সঠিক হোক বা না হোক। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষ কষ্ট পায় না, কষ্ট তৈরি করে। তবে কে কেমন কষ্ট তৈরি করবে সেটা তার বেড়ে ওঠা পরিবেশ, শিক্ষা, বিশ্বাসের ভিত্তির ওপর নির্ভর করে। আপনি কি জানেন, পৃথিবীতে যত মানুষ রোগে মারা যায় তার মধ্যে শীর্ষে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, ক্যানসার রোগের প্রধানতম কারণ নিরানন্দ, দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা, মানসিক চাপ, রাগ এবং এসব নেগেটিভ সাইকিক ইমপ্রেশননির্ভর করে আপনার দৃষ্টিভঙ্গির বা আপনার চিন্তার ধরনের ওপর। মানুষ ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা নিয়ে যে নেতিবাচক কষ্টদায়ক চিন্তা করে তা ৯০ ভাগ চিন্তা অর্থহীন বা অযথাই। মানুষ কোনো একটি ঘটনাকে নেতিবাচকভাবে চিন্তা করতে করতে পাহাড় সমান কষ্ট তৈরি করে। অথচ এসব নেতিবাচক চিন্তা করে নিজেকে কষ্ট দেয় এবং জীবনে কষ্টের জগৎ তৈরি করে। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, মানুষ যেসব নেতিবাচক চিন্তা তৈরি করে তার মধ্যে ৯০ ভাগই বাস্তবে ঘটে না। পৃথিবীর যত আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে তা তার তৈরি করা কষ্ট থেকেই। অথচ একই ঘটনা বা বিষয়কে ইতিবাচক দৃষ্টিতে ভালো অর্থে চিন্তা করে জীবনকে সফল ও আনন্দময় করাও সম্ভব।
লেখক : সমাজবিশ্লেষক ও কলামিস্ট
"