সাহাদাৎ রানা

  ০৯ এপ্রিল, ২০২৪

ইজি চেয়ার

ডুবে যাওয়া সূর্যকে কেউ কখনো স্যালুট করে না- প্রচলিত কথা হলেও তা যে মিথ্যা নয় সেটা ইদানীং উপলব্ধি করছেন ইসাক সাহেব। কয়েক দিন আগে সরকারি চাকরি থেকে অবসরে গেছেন। বিকেলে নিজের আটতলার ফ্ল্যাটের বারান্দায় ইজি চেয়ারে শুয়ে প্রায় ডুবে যাওয়া সূর্যের দিকে তাকিয়ে সে কথাই ভাবছেন তিনি। তার চাকরির সূর্যটাও ডুবে গেছে। ইসাক সাহেব এই কদিনে একটা বিষয় বুঝতে পেরেছেন অবসরে চলে যাওয়ার পর তাকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে না, তার মতামত জানতে চায় না- এক কথায় তার মূল্য আর আগের মতো নেই।

ইসাক সাহেব চাকরি জীবনে ছিলেন তৃতীয় গ্রেডের কর্মকর্তা। অবসরের আগ পর্যন্ত কর্মজীবনে প্রচণ্ড দাপটের সঙ্গে কাজ করেছেন। অর্ধস্তন কর্মকর্তারা তাকে মান্যগণ্য করতেন- তারা ভয়ে তটস্থ থাকতেন। কারণে-অকারণে সালাম দিতেন তাকে। কিছু মানুষ নানা কাজের তদবিরে সব সময় তোষামোদ করতেন। নিজেকে তখন খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হতো ইসাক সাহেবের। তাকে ঘিরে মানুষজনের এসব তোষামোদি, তোয়াজ করার বিষয়গুলো তিনি খুব উপভোগ করতেন।

অবসর নেওয়ার পর আজ কেউ তার কোনো খেঁাঁজখবর নেন না। ইসাক সাহেব চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন প্রায় ছয় মাস হলো। অবসর নেওয়ার আগে তিনি অনেক কিছু ভেবে রেখেছিলেন। কীভাবে সময় কাটাবেন, কী করবেন, কী করবেন না- সব হিসাব করে রেখেছিলেন। কিন্তু অবসরের পর সেভাবে আর কিছু করা হচ্ছে না। আগের মতো তেমন কিছুই ভালো লাগে না তার।

ইসাক সাহেবের তিন সন্তান। দুই ছেলে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে দেশের বাইরে থাকে। একমাত্র মেয়েরও বিয়ে হয়েছে। সে-ও স্বামী-সন্তান নিয়ে ভিনদেশে ভালো আছে। ইসাক সাহেবের স্ত্রী দেড় বছর আগে মারা গেছেন। অবসরের পর বিদেশে ছেলে ও মেয়ের বাসায় ঘুরে বেরানোর পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন। প্রথম তিন মাসে অবশ্য এর কিছুই হয়নি। ছেলেমেয়েরা বারবার তাকে যেতে বললেও ইসাক সাহেবের দেশের বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে না।

ইজি চেয়ারে শুয়ে-বসে ঢাকায় নিজের ফ্লাটেই তার সময় কাটছে। তাকে দেখাশোনার জন্য সাতাশ-আটাশ বছরের একজন কাজের লোক আছে। জয়নাল তার নাম। জয়নাল রান্না থেকে শুরু করে সব কাজই করে। বলা যায় ইসাক সাহেবকে দেখে রাখার কাজ করছে জয়নাল।

দিনের চব্বিশ ঘণ্টার বেশির ভাগ সময় ইসাক সাহেবের কাটে পুরোনো ইজি চেয়ারে শুয়ে-বসে। ইজি চেয়ারটা তার কাছে বিশেষ কিছু। ইসাক সাহেবকে তার প্রয়াত নানা এটি উপহার দিয়েছিলেন। তখন ইসাক সাহেবের বয়স ছিল বারো-তেরো। বয়সের হিসাব করলে ইজি চেয়ারের বয়স ইসাক সাহেবের চেয়েও অনেক বড়! বয়সের তুলনায় চেয়ারটি এখনো বেশ মজবুত।

তাই ছোটবেলা থেকেই চেয়ারটি তার কাছে অনেক প্রিয়। কত দিন তিনি এই ইজি চেয়ারে শুয়ে শুয়ে কতকিছু ভেবেছেন। এখানে শুয়ে ঘুমিয়েছেন- হালকা দোল খেয়ে অলস সময় পার করেছেন।

ইজি চেয়ারটি ইসাক সাহেবের কাছে অনেকটা লাকি গ্রাউন্ড। যখনই তিনি কোনো সমস্যায় পড়েছেন তখনই ইজি চেয়ারে বসে সমাধানের পরিকল্পনা করেছেন এবং সফলও হয়েছেন তিনি। মনে আছে, চাকরির ইন্টারভিউ দেওয়ার আগে তিনি ইজি চেয়ারে বসে আলাদা প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন। এ কারণে এই চাকরিটা হয়েছিল। এমনটাই বিশ্বাস তার।

প্রত্যেক মানুষের জীবনে একটা সময় আসে যখন আর কোনো কিছুই ভালো লাগে না। ইসাক সাহেব এখন সেই সময় অতিক্রম করছেন। এ সময় এসে এখন তার আর কোনো কিছুই ভালো লাগে না। কী করলে ভালো লাগবে তাও ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি। ইসাক সাহেব মাঝে মাঝে ভাবেন, খুঁজে খুঁজে পুরোনো বন্ধুদের কাছে গিয়ে তাদের সঙ্গে আড্ডা দেবেন। তাদের কাছে যাবেন বলে প্রস্তুতিও নেন কিন্তু তার আর যাওয়া হয় না। ইসাক সাহেব কোথাও যান না। তিনি সারাদিন ইজি চেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়েন। কাগজ পড়তে ভালো না লাগলে ইজি চেয়ারেই ঘুমিয়ে থাকেন। কখনো কখনো অনেক রাত পর্যন্ত সেখানে ঘুমিয়ে থাকেন।

ভাইজান, স্যার অনেক রাত পর্যন্ত ইজি চেয়ারে শুয়ে আছিল। সকালের দিকে ডাকতে গিয়া দেখি কোনো সাড়াশব্দ নেই। ঘুমের মধ্যে কখন যে স্যারে মারা গেছে বুঝতে পারি নাই- ইসাক সাহেবের বড় ছেলে হাসনাতকে ফোনে এ কথা বলতে বলতে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে জয়নাল।

মানে ইসাক সাহেব মারা গেছেন। নীরবে, নিঃশব্দে বিদায় নিয়েছেন ইসাক সাহেব। বিদায় বেলায়ও তার সেই প্রিয় লাকি গ্রাউন্ড, ইজি চেয়ার!

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close