শিহাব শাহরিয়ার

  ০৯ এপ্রিল, ২০২৪

নববর্ষ : হালখাতা ও রবীন্দ্রনাথ

হালখাতা, চৈত্র-সংক্রান্তি, পহেলা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ- এসবের ইতিহাস আমার আব্বার কাছ থেকেই প্রথমে শুনি ও জানি। তখন অত ভালো করে বোঝার বয়স হয়নি। তবে প্রতি বছর উৎসব-অনুষ্ঠান, মেলা-পার্বণ দেখে বড় হয়েছি। আব্বা খুবই আদর্শিক মানুষ। অঞ্চলের শিক্ষা-সংস্কৃতি-রাজনীতি নিয়ে ভাবতেন এবং খুব ভালো ধারণা রাখতেন। ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে তার অনুরাগ অসাধারণ। আকবরের আমলে কীভাবে বাংলা সনের প্রবর্তন হলো তিনি জানেন এবং সে সময় গ্রামের আগ্রহী মানুষদের বলতেন। দেখা যেত, সন্ধ্যায় আমাদের বাড়ির বৈঠকখানার সামনে রাখা খালি বেঞ্চে এসে বসতেন গ্রামের বিভিন্ন বয়সের লোকজন। মূলত অধিকাংশ কৃষক, যারা মাঠের ও খেত-খামারের কাজ শেষ করে এসে এখানে দেশের খবর, সংস্কৃতির খবর শুনতে আসতেন আব্বার কাছে। আব্বাও ধীরে ধীরে, গুছিয়ে, সহজ করে বেশির ভাগ নিরক্ষর সরলপ্রাণের মানুষের আমাদের লোকসংস্কৃতির কথা এক এক করে বলতেন।

এক দিন বললেন, হালখাতা কীভাবে হয়? কেন হয়? কোন দিন হয়? কারবালা কী? পুঁথি, কিচ্ছা, কাহিনি, পালা, মুরশিদি-মারফতি কী? বাংলা নববর্ষ কী? কেন ও কবে নববর্ষ প্রবর্তন হলো? এ সময় আব্বাকে প্রশ্নও করতেন। একজন জানতে চাইলেন মেলা কবে থেকে এবং কেন শুরু হয়েছে? উত্তরে আব্বা জানালেন, অতি আদিকালে মানুষ কীভাবে ভয় থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে ধর্ম পালন, উৎসব-অনুষ্ঠান, পূজা-অর্চনা শুরু করল। পরে কৃষিজীবী মানুষরা নানা পালা-পার্বণ পালন শুরু করল এবং তারও পরে আধুনিকতার স্পর্শে এসে মানুষ তার পূর্ব-পুরুষের ইতিহাস ও কৃৎকর্ম ধরে রাখার প্রয়াস এবং নিজেদের কাজের প্রয়োজনে সময়কে গুরুত্ব দিতে এগিয়ে এলো সেই ইতিহাস।

বলতে বলতে বৈশাখী মেলার ইতিহাস বললেন। বললেন, সম্রাট আকবরের সময় থেকে বাংলা সনের প্রবর্তন হলে, প্রথমে জমিদাররা তাদের খাজনা আদায় অর্থাৎ আগের বছরের পাওনা-দাওনা আদায়ের উদ্দেশ্যে নতুন বছরের প্রথম দিন হালখাতা করতেন এবং এজন্য প্রজাদের আমন্ত্রণ করতেন। তাদের মিষ্টিমুখ ও খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করতেন। পরে জমিদারি প্রথা উঠে গেলে বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও দোকানিরা হালখাতার প্রথা চালু রাখেন। অর্থাৎ পুরোনো বছরের খাতায় ক্রেতা-সাধারণের যে বাকি-বকেয়া থাকে, তা পরিশোধ করে নতুন বছর থেকে নতুন খাতায় নাম উঠান। ব্যবসায়ী বা দোকানিরাও লাল বা সবুজ মলাটের নতুন খাতা খোলেন এবং ক্রেতাদের জন্য নানা রকম খাবার-দাবারের আয়োজন করেন। এ উপলক্ষে গান-বাজনারও আয়োজন করা হয়। সবাই মিলে আনন্দ-ফুর্তি করে যার যার বাড়ি ফিরে যান। এটি মূলত মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত সমাজের সাংস্কৃতিকচর্চা বলা যেতে পারে, যা জাতিগত বৈশিষ্ট্যেরই অংশ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, অর্থাৎ যাকে আমরা বলতে পারি বাঙালির হাজার বছরের নিজস্ব ঐতিহ্যিক উৎসবেরই অংশ।

কবে থেকে বাংলা নববর্ষ উদযাপন শুরু হয়েছে, সঠিক বলা মুশকিল। তবে গবেষক জাহারাবী রিপন বলেছেন, ‘প্রাথমিকভাবে ৫৯৩-৯৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে বাংলা অব্দ বা বঙ্গাব্দের সূচনাকে স্বীকার করা হয়ে থাকে। পণ্ডিত সিলভ্যাঁ লেভি ৫৯৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে বাঙ্গালা অব্দের শুরুর সঙ্গে ‘সন’ কথাটির ব্যুৎপত্তি তিব্বতি নৃপতি রি-স্রঙ-সন অথবা তদীয় পুত্র সঙসনগামণ্ডপোর নামের আধারে অনুমান করেন। পিতার রাজ্যাভিষেক কিংবা পুত্রের জন্ম উপলক্ষে এই অব্দের আরম্ভকাল বিবেচনা করা হয়ে থাকে। তবে উভয়ের নামের একাংশের সঙ্গে বঙ্গাব্দের সঙ্গে ব্যবহৃত ‘সন’র সাযুজ্য বিদ্যমান। উল্লেখ্য, আরবি ‘সন’ অর্থাৎ বছরের সঙ্গে বঙ্গাব্দে ব্যবহৃত ‘সন’র ঐক্যসূত্র আছে বলেও ধারণা করা হয়। তবে পণ্ডিতদের অনুসন্ধানে জানা যায়, গৌড় বঙ্গের রাজা শশাঙ্কের আমলেই বঙ্গাব্দের সূচনা হয়েছিল। কিন্তু এতে মতান্তর লক্ষ করা যায়। কারণ মহামতী আকবরের রাজত্বের পূর্বে বাংলা সন বা বঙ্গাব্দের প্রচলন সম্পর্কিত নিশ্চিত কোনো প্রমাণ নেই। আকবর রাজ্যবর্ষকে সৌরবর্ষ হিসেবে গণনা করেছিলেন খুব সম্ভব রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে। সে কারণে এই বাংলা সনের শুরু এবং বৈশাখের সঙ্গে বাংলার কৃষ্যভূমির সম্পর্ককেও অনিবার্য জ্ঞান করি।’

এখন বাংলা নববর্ষের যে গৌরবময় ও জাঁকজমক উৎসব আয়োজন আমরা রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে দেখছি, এটি মূলত বাংলা অঞ্চলের কৃষিভিত্তিক সমাজের ফসল। এই সমাজের মানুষরা আদিকাল থেকেই নববর্ষের অনুষ্ঠান করে আসছেন। তাদের মাঠের ফসল ওঠা, নতুন ধানের পিঠাণ্ডপুলি তৈরি ও আহার, যাকে নবান্নের উৎসব হিসেবে এখনো দেখা যায়। সারা বছরই বিভিন্ন পালা-পার্বণ কৃষক পরিবারগুলো করে থাকেন। তেমনি বৈশাখী মেলারও কালের প্রবাহে প্রচলন ঘটেছে। বর্তমানে পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ উদযাপন বাঙালির জীবনে সবচেয়ে বড় ঘটনা হয়ে দেখা দিয়েছে।

বাঙালির এই মহা-উৎসবের দিনটিকে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকরা পালন করতে দেয়নি। তাদের মতে, এটি হিন্দুয়ানি বা ইসলাম পরিপন্থী উৎসব। সে কারণে পহেলা বৈশাখ পালনে তারা নানা সময় বাধা দিয়েছে। কিন্তু তাতে তারা সফল হয়নি। আসলে এই ভৌগোলিক অঞ্চল বা নদীবিধৌত এই বাংলা অঞ্চলের সহজ-সরল বাঙালিরা সব সময়ই নিজস্ব কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে লালন করেছে যুগে যুগে, যে কারণে পাকিস্তানি স্বৈরচার ও সাম্প্রদায়িক শক্তি পহেলা বৈশাখসহ বাঙালির নানা উৎসবকে বন্ধ করে দিতে পারেনি বরং তারা এ বিষয়ে পরাজিত হয়েছে। পাশাপাশি বাঙালি বীরের জাতি, প্রতিবাদী, লড়াকু এবং গৌরবময় ইতিহাসের অংশীদার, তাই তারা আত্মপরিচয়কে তুলে ধরতে কখনো প্রতিবাদী, কখনো লড়াকু, কখনো রক্তদানেও পিছপা হয়নি। এ কারণে পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে পহেলা বৈশাখসহ বাঙালির অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির ওপর যখনই আঘাত এসেছে, তখনই তারা প্রতিবাদ করেছে। রমনার বটমূলে যখন পহেলা বৈশাখ অর্থাৎ নববর্ষ উদযাপনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়, তখন থেকে নানা পাঁয়তারা চলেছে এটিকে বন্ধ করে দিতে, কিন্তু একই চেতনায় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করে বাঙালি উদীপ্ত হয়ে ওঠে এবং রুখে দিয়ে ধীরে ধীরে চারাগাছ থেকে মহীরুহ করে তুলেছে নববর্ষের অনুষ্ঠানকে। আজ পহেলা বৈশাখ সরকারি ছুটির দিন। নববর্ষ উদযাপনে ওইদিন লাখ লাখ মানুষ বেরিয়ে আসে। রমনার বটমূলসহ সারা দেশ আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। তাই নববর্ষের প্রথম দিন আজ বাঙালির মহা-উৎসবের দিন, মহা-মিলনের দিন। সারা পৃথিবীতেই প্রত্যেক ভাষা ও জাতিগোষ্ঠী তাদের নিজস্বতায় পালন করে নতুন বছরের প্রথম দিনটিকে। বাঙালিরাও তাদের জাতীয় জীবনে যে কটি গুরুত্বপূর্ণ দিবস উদযাপন করে পহেলা বৈশাখ অর্থাৎ বাংলা নববর্ষ অন্যতম একটি।

বাংলা নববর্ষের পহেলা বৈশাখ সত্যিকার অর্থেই বাঙালিদের প্রাণের উৎসব। কারণ এই উৎসবে কোনো বিদেশিপনা নেই। শুধু আছে বাঙালির নিজস্ব ঐতিহ্য, আত্মপরিচয় ও আপন উপাদান। এই দিন নতুন পোশাকে, নতুন সাজে, বর্ণাঢ্য মঙ্গলযাত্রায়, সব অশুভকে তাড়িয়ে কল্যাণ কামনায়, অসাম্প্রদায়িক চেতনায়, পুরাতনের জরা-জীর্ণ মুছে ফেলে, আগামী নতুনকে সুন্দর করে গ্রহণ করার মহা-আয়োজন চলে সবার মধ্যে। ছোট-বড় সবারই কণ্ঠে তাই উচ্চারিত হয় বিশ্বকবির সেই চির ভাস্বর পঙ্ক্তিমালা : ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো/ তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে...’।

বাঙালির চেতনার স্রোত থামায় কে? কালবৈশাখীও এই চেতনাকে, এই বেগকে থামাতে পারে না। কারণ রবীন্দ্রনাথ তার অমর বাণীর মাধ্যমে বৈশাখের চেহারাকে আলোকোজ্জ্বল করে দিয়ে গেছেন। এই বাণী বাঙালি কি চির দিন ভুলতে পারবে- আমি এই গানের ব্যাখ্যায় যাব না। আমি বলব চেতনার কথা। চেতনা হলো ভেতরের বিষয়। ভেতর বলতে অন্ধকার নয়। কৃষ্ণচূড়ার মতো টকটকে। এই ফুল যেন ফুটছে অহরহ। পহেলা বৈশাখের পর, বর্ষা উৎসব, শরৎ উৎসব, হেমন্ত উৎসব, ফাল্গুন উৎসব ও চৈত্র-সংক্রান্তি এখন খুব ঘটা করেই পালন করা হচ্ছে। এমন পালনে শুধু মনে পড়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে- ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত।

বসন্তের পরেই আসে নতুন বছর। গাছের দিকে তাকালে নতুন টের পাই। কঁচি পাতাগুলো ঝিরঝির বাতাসে দোল খায় ‘গভীর চোখের তারায় তারায়’। আমরা পুরোনো স্মৃতিকে ভুলে নব জাগরণে উদীপ্ত হই। সবুজ পাতা যখন পুবালি বাতাসে দোলে, তখন আমার মন ভরে যায়, চোখ নেচে ওঠে। মনে হয়, এমন সুখের দেশ আর কোথায় আছে? পহেলা বৈশাখ পালন করার দেশ আর কোথায় আছে? নেই। নেই। নেই। সত্যি বাংলাদেশ আমার ভালোবাসার দেশ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close