কাজী আবুল মনসুর, চট্টগ্রাম

  ২৮ এপ্রিল, ২০২৪

সাগরে সম্পদ আহরণে বিদেশিদের আগ্রহ

বাংলাদেশের ৭৫ মাইল দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত বিপুল পরিমাণ খনিজসম্পদ। এ সম্পদ আহরণে আগ্রহ রয়েছে বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগীদের। এ সম্পদ পরিকল্পিতভাবে আহরণ করা হলে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ সম্পদের মূল্য হাজার হাজার কোটি টাকা। এ সম্পদ দিয়ে দেশকে বিকল্প জ্বালানি শক্তিতে রূপ দেওয়া যায় বলেও মত দিয়েছেন তারা। অস্ট্রেলিয়া এ সম্পদ আহরণের ইচ্ছা প্রকাশ করে আসছে বলে জানা গেছে।

সূত্রমতে, সমুদ্রের এসব সম্পদ ব্যবহার নিয়ে আমাদের দেশের বিশেষজ্ঞরা কোনো সময় একমত হতে পারেননি। কেউ এসব সম্পদ তোলার পক্ষে, অনেকে বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তবে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বিদেশিদের নজর বাংলাদেশের সমুদ্র সম্পদের প্রতি রয়েছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব সম্পদ ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেন। গত ২২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনকন্দ্রে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ‘টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মরিটাইমজানস অ্যাক্ট-১৯৭৪’ প্রণয়নের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘আমাদের অনেক দায়িত্ব রয়েছে, সমুদ্র সম্পদ কীভাবে ব্যবহার করব। আমাদের সমুদ্রের মৎস্যসম্পদ, সামুদ্রিক উদ্ভিদ, সামুদ্রিক সম্পদ; বিশেষ করে আমাদের খনিজসম্পদ, তেল-গ্যাস উত্তোলন করতে হবে। এটা আমাদের দেশের জন্য প্রয়োজন।’

১৯৬১ সালে পাকিস্তান আমলে সমুদ্রসৈকতের এ খনিজসম্পদের বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর শুরু হয়। এ সময় তৎকালীন পাকিস্তান ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের (বর্তমানে বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর) গবেষণায় সমুদ্রসৈকতে মূল্যবান তেজস্ক্রিয় ও ভারী ধাতু রয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তি কমিশন গবেষণা করে বিপুল পরিমাণ খনিজসম্পদের অস্তিত্বের বিষয়টি জানান দেয়। মূলত এ সময় থেকে বিদেশিদের নজরে আসে এদেশের সৈকতের মূল্যবান পদার্থগুলো। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর আজও এ সম্পদগুলো আহরণের ব্যাপারে অগ্রগতি হয়নি। গত ২০০২ সালে ‘অস্ট্রালেশিয়ান ইনস্টিটিউট অব মাইনিং অ্যান্ড মেটারলজি’ জার্নালে ‘কেমিক্যাল অ্যান্ড মিনেরালজিক্যাল ইনভেস্টিগেশন অন বাংলাদেশ জিরকন’ নামের একটি প্রতিবেদন দেশ-বিদেশে আলোচনায় আসে।

ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে প্রাপ্ত জিরকনের বিশুদ্ধতা প্রায় ৯৫.৮৯ শতাংশ। খাদ হিসেবে যা আছে, সেটাও বেশ দামি এক আকরিক, টাইটেনিয়াম অক্সাইড। গবেষকরা এক্স-রে ডিফ্র্যাকশনের সাহায্যে এ উপাত্ত পেয়েছেন, যা নির্ভরযোগ্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। আনুমানিক হিসেবে বাংলাদেশের এ কোস্টাল অঞ্চলে প্রায় ১৬০ হাজার টন জিরকন, ৭০ হাজার টন রুটাইল, বিপুল পরিমাণ ইলমেনাইট, ২২৫ হাজার টন গার্নেট, ১৭ হাজার টন মোনাজাইট ও প্রায় ৮১ হাজার টন ম্যাগনেটাইট মজুদ আছে।’ আন্তর্জাতিকভাবে এ প্রতিবেদন প্রকাশের পর বাংলাদেশের এ সেক্টরে বেশ হইচই হয়। এ সময় দেশের একটি সাপ্তাহিক গণমাধ্যম ২০০২ সালে ৮ ফেব্রুয়ারি ‘বিলিভ ইট অর নট’ নামে একটি কাভার স্টোরি করে। তাতে তুলে ধরা হয়, ‘এ বালুতে আছে ১৪৫ লাখকোটি টাকারও বেশি সম্পদ।’

উল্লেখ করা হয়, এখানে থাকা রুটাইল, যা রঞ্জক পদার্থের কাঁচামাল, ওয়েল্ডিং রডের বহিরাবরণ ও টাইটেনিয়াম মেটাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ইলমেনাইট, টাইটেনিয়াম মেটাল তৈরিতে এর গুরুত্ব সর্বাধিক। টাইটেনিয়াম মেটাল লোহার চেয়ে ৪-৫ গুণ শক্ত অথচ লোহার চেয়ে অর্ধেক হালকা। বিভিন্ন যানবাহনের যন্ত্রাংশ; এমনকি উড়োজাহাজের গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ তৈরিতেও এর চাহিদা বিশ্বব্যাপী। লিউকক্সেনের কার্যকারিতা অনেকটাই রুটাইলের মতো। কায়ানাইট একটি অ্যালুমিনিয়াম খনিজ। গারনেট, এটিলাহা, অ্যালুমিনিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ ও সিলিকা মিশ্রিত ধাতু। গারনেটের গহনার চাহিদা উন্নত বিশ্বে সমধিক। মোনাজাইট, এটি একটি তেজস্ক্রিয় খনিজ। পারমাণবিক চুল্লিতে জ্বালানি হিসেবে তা বটেই; এমনকি এটম বোমার কাঁচামাল হিসেবেও এটি ব্যবহার হয়। তাছাড়া ম্যানাজাইট ব্যবহৃত হয়ে থাকে গ্যাসপ্লান্ট ও কালার টেলিভিশনেও। ম্যাগনেটাইট, আকরি লৌহ। বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রের চুম্বক তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। তেজস্ক্রিয় বিকরণের ঢাল হিসেবেও সর্বত্র এর প্রচুর চাহিদা। জিরকন এমন এক খনিজ, যা সিরামিক কারখানায় ও গহনা তৈরিতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় জিরকন দিয়ে সিনথেটিক ডায়মন্ড তৈরি হচ্ছে। এ জিরকন দিয়ে তৈরি ১০০ গ্রাম কৃত্রিম হীরার দাম শত শত ডলার।

সূত্রমতে, ২০০৯ সালের দিকে বিষয়টি নিয়ে আবারও নাড়াচাড়া শুরু হয়। বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশন কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে ১৭টি মূল্যবান ভারী খনিজসম্পদের বিষয় তুলে নিয়ে আসে। বলা হয়, টাকার অঙ্কে এগুলোর মূল্য হাজার হাজার কোটি টাকা। এ বিষয়ে গঠন করা হয় একটি কমিটি। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি বিভাগের তৎকালীন যুগ্ম সচিব আশরাফ আলীকে প্রধান করে গঠিত কমিটিতে অন্যদের মধ্যে ভূমি, বিমান, বিজ্ঞান, পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর, পরমাণু কমিশন, খনিজসম্পদ ব্যুরো ও প্রিমিয়ার মিনারেল কোম্পানির প্রতিনিধি ছিলেন।

তবে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে দেওয়া কমিটি প্রতিবেদনে সৈকতের এসব সম্পদ না তোলার পক্ষে মত দেওয়া হয়। পর্যটনের কথা বিবেচনা করে এ মত দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। কমিটির দেওয়া প্রতিবেদনে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে কিছু এলাকায় খনিজসম্পদ তোলা যায় বলে মন্তব্য করা হয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সাগরের কুতুবদিয়া, মহশেখালী, কক্সাবাজার সৈকত, উখিয়া ও টেকনাফ- এ ছয়টি এলাকার প্রায় ৮ হাজার হেক্টর সৈকতজুড়ে বিভিন্ন খনিজসম্পদ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে।

বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের এ সময়ের গবেষণা মতে, সমুদ্রসৈকতে জিরকন, রুটাইল, মানাজাইট, কায়ানাইট ইলমেনাইট, ম্যাগনেটাইল, গারনেট ও লিউকক্সেনের মতো মূল্যবান ভারী খনিজসম্পদ আছে। বিশ্বে এসব ধাতু বা পদার্থের ব্যাপক চাহিদা আছে। উল্লেখ করা হয়, সাগর উপকূলের বদরমোকাম, সাবরুম, টেকনাফ অঞ্চলে ৪ লাখ ৫০ হাজার টনেরও বেশি ইলমোনাইট, প্রায় ৭১ হাজার টন জিরকন, ৬৫ হাজার টন গারনেট, ১৯ হাজার টন রুটাইল, সাড়ে ২২ হাজার টন ম্যাগনেটাইল, ৫২ হাজার টন লিউকক্সেন, ২০ হাজার টন কায়ানাইট, ১২ হাজার টনেরও বেশি মোনাজাইট রয়েছে।

সাগরজুড়ে যে কাঁচা বালু রয়েছে তার পরিমাণ ২ কোটি ৫ লাখ টন। আর ভারী খনিজ রয়েছে প্রায় ৪৪ লাখ টন। সূত্রমতে, অস্ট্রেলিয়ার প্রিমিয়ার মিনারেল কোম্পানি লিমিটেড একটি কোম্পানি এ সময় সরকারের কাছে সমুদ্রসৈকতের সম্পদ তোলার আবেদন করে। আবেদনে কোম্পানিটি ৫ ভাগে ভাগ করে কাজের অনুমতি চাইলে তাদের অনুসন্ধানের জন্য অনুমতি দেওয়া হয়। কোম্পানিটি ৫০ কেজি বালু অস্ট্রেলিয়ার নিয়ে গবেষণা করে ভারী খনিজসম্পদের অস্তিত্ব পায়। এরপর তারা এগুলো উঠানোর আগ্রহ প্রকাশ করে। তাদের প্রস্তাবটি নিয়ে বসে কমিটি। শেষ পর্যন্ত অনেক আলোচনার পর কমিটি তাদের প্রতিবেদনে এখনই পুরো এলাকা থেকে খনিজসম্পদ তোলা সমীচীন হবে না বলে জানালে সবকিছু থমকে যায়।

বিষয়টি নিয়ে তৎকালীন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক ২০০৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর জ্বালানি বিভাগে একটি প্রতিবেদন দেন। তাতে উল্লেখ করা হয়, ‘সমুদ্রসৈকত থেকে খনিজসম্পদ তোলা হলে পর্যটকের ক্ষতি হবে। একটি নির্দিষ্ট এলাকায় সাধারণ মানুষের যাতায়াত বন্ধ করে দিতে হবে। সৈকতের খনিজসম্পদ তোলার অনুমতি দিলে এলাকার লোকজন জমি হারাবে, জীব, পরিবেশের ক্ষতি হতে পারে। তাছাড়া জমি অধিগ্রহণ করলে পর্যটনের ক্ষতি হবে।’ মূলত এরপর থেকে এ বিষয়ে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত এ-সংক্রান্ত বিষয়ের প্রতিষ্ঠানগুলো হাত গুটিয়ে বসে থাকে। যদিও অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানিটি জানিয়েছিল, যে বালি তোলা হবে, তা থেকে ৭ থেকে ১০ শতাংশ আলাদা করা হবে।

সূত্রমতে, অস্ট্রেলিয়ার ইস্টকাস্ট, এনিয়েব্বা, ভারতের কুইলন, আমেরিকার ফ্লোরিডা, নিউজার্সি, শ্রীলঙ্কার পালমুড্ডি, কলম্বো, ব্রাজিলের এসপ্রিটো, সান্তো, রিউ ডিজনেরিউ, সাউথ আফ্রিকার রিচার্ডব এবং তানজানিয়ার দার-এ-সালামের চেয়ে বাণিজ্যিক দিক দিয়ে কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয় বাংলাদেশের কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত। কারণ বিশ্বে উল্লেখিত সমুদ্রসৈকতগুলোর সঙ্গে নাম এসেছে কক্সবাজারের। বিশ্বের বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে বিশ্বের উপরোক্ত সৈকতগুলোয় মূল্যবান খনিজ রয়েছে তার চেয়েও বেশি রয়েছে বাংলাদেশের ১ লাখ ২০ হাজার বর্গকিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ২০০ নটিক্যাল মাইলের বঙ্গোপসাগরে। সাগরের সৈকতে এবং সাগরের তলদেশের খনিজসম্পদ নিয়ে বিভিন্ন দেশ উপকৃত হলেও আধুনিক যন্ত্রপাতি ও গবেষণার অভাবে বাংলাদেশের সমুদ্র সম্পদগুলো কাছে লাগানো যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামুদ্রিক সম্পদগুলো অবহেলায় ফেলে না রেখে কাজে লাগানো দরকার। দেশি-বিদেশি পরামর্শকের সহযোগিতা নিয়ে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close