এ এফ এম মমতাজুর রহমান, আদমদিঘী (বগুড়া)

  ০২ ডিসেম্বর, ২০২২

মুক্তিযুদ্ধে সান্তাহারে বীর বাঙালির সাহসী ভূমিকা

পশ্চিম বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার সান্তাহার ছিল তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের (আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ) অবাঙালি তথা বিহারি অধ্যুষিত শহরের অন্যতম জংশন শহর। এ শহরকে মুক্ত করতে অনেক বাঙালি সপরিবারে শহীদ হয়েছেন। সে সময় এ শহরে অবাঙালির সংখ্যা ছিল ৩০ হাজারের অধিক।

নিরীহ-শান্তিপ্রিয় বাঙালিদের ওপর অবাঙালিদের নির্যাতন-নিপীড়ন ছিল বর্ণনাতীত। কথায় কথায় অশ্লীল গালাগাল দেওয়া ছিল তাদের মজ্জাগত অভ্যাস। শহরের চারপাশের গ্রাম থেকে কৃষক-গ্রহস্থ ও ব্যবসায়ীদের হাটে-বাজারে বিক্রি করতে আনা বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী নিয়ে দাম না দিয়ে চলে যাওয়া, দাম চাইলে মারধর করা এমনকি ছুরিকাঘাত করতে উদ্যত হওয়াও ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। মোটকথা স্বাধীনতা অর্জনের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত বর্বর অবাঙালিদের এরূপ নানা নির্যাতন নিপীড়ন মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু দুঃখের বিষয়, স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে সান্তাহারের প্রথম শহীদ পরিবারের সদস্যদের খোঁজ কেউ রাখে না বলে জানিয়েছেন সেসব পরিবারের সদস্যরা। তাদের ভাগ্যে এখনো মেলেনি শহীদ পরিবারের মর্যাদা।

সান্তাহারের পশ্চিম ছাতনী গ্রামের সমাজসেবক জাহাঙ্গীর আলম খান ও তৎকালীন সান্তাহার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক মজনু বলেন, প্রথমে শহীদ হন সান্তাহারের ঢেকড়া গ্রামের এক সন্তানের জনক মহাতাব হোসেন। তার পরপরই গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন একই এলাকার পানলা গ্রামের আখের আলী। এর কিছুক্ষণ পর গুলিতে শহীদ হন পশ্চিম ছাতনী গ্রামের বাসিন্দা নওগাঁ ডিগ্রি কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র এস এম আবু জালাল, পুরাতন বাজার সোনারপাড়া এলাকার বাদেশ মুন্সি ও তার ছেলে নিজাম প্রামাণিক। নিজের চোখে বাবা-বড় ভাই ও পাশের দুই গ্রামের তিনজনের শহীদ হওয়ার বর্ণনা দেন শহীদ জালালের ছোট ভাই এস এম আবু জাহেদ ও পুরাতন বাজার এলাকার বাদেশ মুন্সির ছেলে হেলাল উদ্দিন। তারা বলেন, বিহারিদের নির্বিচারে গুলি ও বোমা হামলায় টিকতে না পেরে শহরে মিছিলকারী বাঙালিরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পিছু হটে যায়। সবাই পিছু হটলে বিহারিরা ওই পাঁচ শহীদের মরদেহ নিয়ে গিয়ে রেলওয়ে ইয়ার্ড কলোনি মসজিদের সামনে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে আনন্দ-উল্লাস করে।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই বজ্রকণ্ঠে ভাষণের পর সারা দেশের মতো সান্তাহারের স্বাধীনতাকামী বাঙালিরাও উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন। পক্ষান্তরে বিহারি জনগোষ্ঠীও আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল মরণ কামড় দেওয়ার জন্য। ৭ মার্চের পর প্রতিদিন বিহারিরা যখন তখন শহরের যত্রতত্র বাঙালিদের ওপর হামলা চালাতে থাকে। প্রাণভয়ে শহরে বসবাস করা বাঙালিরা বাসাবাড়ি ছেড়ে আশপাশে গ্রামে আশ্রয় নেন। বিহারিদের এসব কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে প্রায় প্রতিদিনই শহরের চারপাশের গ্রামের মানুষ লাঠিসোটা হাতে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শহরে প্রবেশের চেষ্টা চালান। কিন্তু সশস্ত্র বিহারিদের গুলি ও বোমা হামলার মুখে বারবার পিছু হটতে বাধ্য হন। এরকম টানটান উত্তেজনার মাঝে ২৫ মার্চ ঢাকার মতো জংশন সান্তাহারেও নেমে আসে কালরাত। সে সময় ছাত্রলীগের আদমদীঘি থানা শাখার সভাপতি আজিজুল হক ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোরশেদ খানের আহ্বানে প্রতিবাদ সভা করা হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় বিহারিদের এই হত্যাকাণ্ডের সমুচিত জবাব দেওয়া হবে।

সে সময় আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া নেতাদের অন্যতম গোলাম মোরশেদ খান বলেন, যুগীপুকুর ও গো-ভাঙ্গার ঘটনায় আমরা যেমন বিচলিত হয়ে পড়ি তেমন বিক্ষুব্ধও হয়ে উঠি। আমরা যোগাযোগ করি পাশের রানীনগর থানা সদরের ইউপি চেয়ারম্যান ফিরোজ খান, আওয়ামী লীগ নেতা মীর হোসেন মাস্টার ও অন্য নেতাদের সঙ্গে। কথা হয়, বিহারিদের মোকাবিলা করতে হলে রাইফেল ছাড়া উপায় নেই। তারা জানান, এজন্য যা করার তা করা হবে। কথামতো ২৭ মার্চ মিছিলে গুলি চালিয়ে পাঁচজনকে হত্যা করার প্রেক্ষাপটে রানীনগরের সহযোগিতা চেয়ে ওই নেতাদের পত্র লিখি। হেঁটে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরের রানীনগরে পত্রটি বহন করে নিয়ে যান সান্দিড়া গ্রামের আবদুল গফুর জোয়ারদারসহ কয়েকজন।

অন্য দিকে সান্তাহার সওজ কারখানা বিভাগ থেকে এক বাঙালি চালককে রাজি করিয়ে জিপ গাড়ি নিয়ে সড়কপথে রানীনগর যায় সান্তাহারের পশ্চিমছাতনী গ্রামের ইউনুছ আলী মোল্লাসহ কয়েকজন। তারা রানীনগরের ওই নেতাদের নিয়ে থানার বাঙালি ওসির সঙ্গে আলোচনা করেন রাইফেল দিয়ে সহযোগিতা করতে। তিনি সহযোগিতা করতে রাজি হলেও তা স্বাভাবিক উপায়ে সম্ভব নয় বলে জানান। এক্ষেত্রে থানা লুটের ঘটনা ঘটাতে হবে। ঘটনার সময় তিনি ও থানার অন্য দারোগা ও সিপাহিরা যাতে তেমন প্রতিরোধ না করে সে সহযোগিতা করতে তিনি রাজি হন। কথামতো ওই দিন দুপুরে থানা লুটের জন্য আক্রমণ করা হয়। ওসি, দারোগা ও সিপাহিদের কিলঘুষি দিয়ে অস্ত্রাগার ভেঙে লুট করা হয় ৪৩টি থ্রি নট থ্রি রাইফেল। সেই রাইফেলের সঙ্গে আশপাশ গ্রামের বড় বড় গৃহস্থ বাড়িতে থাকা প্রায় সমসংখ্যক বন্দুক নিয়ে এবার বিহারিদের পাল্টা জবাব দেওয়ার জন্য শহরের চারদিক থেকে আক্রমণ শুরু করলে কোণঠাসা হয়ে পড়ে বিহারিরা। তাদের আগ্নেয়াস্ত্র ও বোমা শেষ হয়ে যাওয়ায় কাবু হয়ে পড়ে। তারা নিজেদের বাসা-বাড়ি ছেড়ে কিছু পালিয়ে যায়। অধিকাংশরা তাদের কয়েক নেতার বাড়িতে, স্কুল-কলেজ ও মসজিদে আশ্রয় নেয় সপরিবারে। ফলে শহরের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় বাঙালিদের হাতে। এ সময় কয়েকশ বিক্ষুব্ধ ও দুর্র্ধর্ষ প্রকৃতির বাঙালি নেমে পড়েন সপরিবারে বিহারি নিধনে। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে একসময়ের প্রতাপশালী সব বিহারির নিধন করে। এ খবর তখন বিবিসি লন্ডনের বাংলা বিভাগ থেকে ব্যাপক প্রচার করা হয়। এর মাধ্যমে সান্তাহার ঠাঁই পায় স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের পাতায়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close