বাসস

  ২৭ মে, ২০২২

ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনায় মিলছে হয়রানি থেকে মুক্তি

কুমিল্লা সদর উপজেলার চম্পকনগর গ্রামের সাধারণ কৃষক আরব আলী। আট বছর আগে তিনি ৩২ শতক জমি কিনেছিলেন। সেই জমির নামপত্তন ছিল না। দুর্গাপুর ইউনিয়ন ডিজিটাল তথ্যসেবা কেন্দ্রে গিয়ে তিনি জানতে পারেন অনলাইনে নামপত্তনের আবেদন করা যায়। নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে অনলাইনে আবেদন করেন তিনি। এরপর চারধাপ মোবাইল ফোনে মেসেজের (এসএমএস) মাধ্যমে জানতে পারেন কাজের অগ্রগতি। সর্বশেষ এসএমএস পেয়ে উপজেলা ভূমি অফিস থেকে গ্রহণ করেন নামপত্তনের কাগজ। সরকার নির্ধারিত ফির বাইরে একটি টাকাও দিতে হয়নি তাকে। ঘুষ, দুর্নীতি ও দালালের হয়রানি ছাড়াই ২৮ কর্মদিবসের মধ্যেই কাজ সম্পন্ন হওয়ায় খুশি আরব আলী। তার মতো আরেক সেবাগ্রহীতা জেলার বুড়িচং উপজেলার ময়নামতি গ্রামের ফারুক আহমেদ। ক্রয়সূত্রে ১৪ শতক জমির মালিক। নামপত্তনের জন্য স্থানীয় ইউনিয়ন ডিজিটাল তথ্যসেবা কেন্দ্রে গিয়ে আবেদন করেন। তিনিও ভোগান্তি ছাড়াই সহজেই সেবা পেয়েছেন।

গত ২ বছরে কুমিল্লা সদর উপজেলায় অনলাইনে নামজারির সেবা পেয়েছেন ২৬ হাজার ২১১ জন। ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনায় বিপ্লব এনেছে ই-নামজারি পদ্ধতি। ভরাসার ইউনিয়ন ডিজিটাল তথ্যসেবা কেন্দ্রের উদ্যোক্তা এস এম মনিরুজ্জামান বলেন, গ্রামে বসে ডিজিটাল সেন্টার থেকে ভূমি সেবা পাচ্ছেন সাধারণ নাগরিক। ভূমি অফিসে গেলে অচেনা লোকের কাছে সেবা নিতে হয়রানির শিকার হতে হতো। আমরা গ্রামবাসীর পরিচিতজন। আমাদের সেবামূল্য নির্ধারিত। সে কারণে বাড়তি টাকা গচ্চা দিতে হয় না। প্রতিটি অনলাইন আবেদন দ্রুততম সময়ের মধ্যে দাখিল করে দেওয়া হয়। যে কারণে তাদের অর্থের সঙ্গে সময়ও বেঁচে যাচ্ছে। সদর ইউনিয়ন ডিজিটাল তথ্যসেবা কেন্দ্রের উদ্যোক্তা মোক্তার হোসেন জানান, ই-নামজারি চালু হওয়ায় সচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত হয়েছে।

কুমিল্লা সদর উপজেলা ভূমি অফিসের ভূমিবিষয়ক ই-সার্ভিস সেন্টারের উদ্যোক্তা আমিন মাহমুদ বাবু বলেন, আগে সেবা নিতে আসা মানুষ দালালের খপ্পরে পড়ত। এখন সেই সুযোগ নেই। সেবাগ্রহীতার ভোগান্তি কমেছে। অর্থ ও সময়ও সাশ্রয় হচ্ছে। বুড়িচং উপজেলার ভূমি কর্মকর্তা মো. শাহআলম জানান, ২০১৯ সালের শেষের দিকে এই উপজেলায় অনলাইনে নামজারির আবেদন গ্রহণ ও নিষ্পত্তি কার্যক্রম ই-নামজারি চালু হওয়ার পর থেকে প্রত্যেক মাসে গড়ে এক হাজারের বেশি আবেদন পড়েছে। অনলাইনে আবেদন নেওয়ায় মানুষের ভোগান্তি লাঘব হয়েছে। হাজার টাকার কাজ এখন ২৭ টাকায় হয়ে যাচ্ছে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. শাখাওয়াত হোসেন রুবেল বলেন, ই-নামজারি চালু করায় হাতের নাগালে ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্র থেকে সহজেই সাধারণ মানুষ আবেদন করছে। ভোগান্তি ছাড়াই পাচ্ছে সেবা। এতে দুর্নীতিমুক্ত হয়েছে ভূমি অফিস। এতে সাধারণ মানুষের ব্যাপক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ভূমি ব্যবস্থাপনা ডিজিটাল হওয়ায় বেড়েছে গ্রাহকসেবার মান। কমেছে দুর্নীতি আর গ্রাহকদের ভোগান্তি। ভলিউম, রেকর্ডপত্র ও পর্চা, নকশাসহ প্রয়োজনীয় নথি এখন যথাযথভাবে সংরক্ষিত হচ্ছে। যে পর্চা উত্তোলনে আগে মাসের পর মাস সময় লাগত, তা উত্তোলনে এখন সময় লাগছে এক সপ্তাহ। আগে একটি পর্চা তুলতে এক হাজার থেকে পনেরশো টাকা লাগত। সেখানে এখন মাত্র ২৭ টাকায় পর্চা ও নকশা উত্তোলন করা যাচ্ছে। এর জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ইনফরমেশন সেলে পর্চা বা নকশার জন্য নির্ধারিত সবুজ কাগজে ২৭ টাকা কোর্ট ফিসহ আবেদন করতে হয়। আবেদন করার পর ওই শাখা থেকে পর্চা উত্তোলনে সময় দেওয়া হয় ৭ দিন।

জানা যায়, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে ভূমি সংস্কার বোর্ড ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রোগ্রাম পরিচালিত ই-মিউটেশন (নামপত্তন) সেবা চালু করা হয়। ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্রে গিয়ে নির্ধারিত দুই শ টাকা দিয়ে অনলাইনে আবেদন করতে হয়। এরপর সেই অনলাইন আবেদন ও নথিপত্র চলে যায় ইউনিয়ন ভূমি অফিসের প্রতিবেদনের জন্য। ইউনিয়ন ভূমি অফিসের প্রতিবেদন হয়ে সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে চলে যায় শুনানির জন্য। শুনানি শেষে সরকার নির্ধারিত ১ হাজার ১৫০ টাকা ব্যাংকে জমা দিতে হয়। প্রত্যেকটি ধাপেই সেবাগ্রহীতাকে টেলিটকের ১৬৩৪৫ নম্বর থেকে এসএমএস দেওয়া হয়। শেষ ধাপে ই-নামজারির তথ্য নিশ্চিত করা হয়। সর্বোচ্চ ২৮ কার্যদিবসের মধ্যেই আবেদন নিষ্পত্তি হয়। এসএমএস পেয়ে আবেদনকারী উপজেলা ভূমি অফিস থেকে নামপত্তনের কাগজ সংগ্রহ করতে পারেন। আগের মতো ঘাটে ঘাটে ঘুষ, দুর্নীতি ও দালালের দৌরাত্ম্যের শিকার হতে হয় না।

সরকার ভূমি ব্যবস্থাপনাকে ডিজিটাল করতে ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও সামরিক শাসনামলের পুরোনো ভূমি আইনসমূহ সংস্কারপূর্বক সেগুলোকে যুগোপযোগী করাসহ তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগ ও উন্নয়ন চাহিদার প্রয়োজনে নতুন কিছু আইনপ্রণয়ন করেছে। ভূমি-সংক্রান্ত অপরাধ আইন, কৃষিজমি সুরক্ষা ও পরিকল্পিত ভূমি ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য ভূমি ব্যবহার আইন, হয়রানিমুক্তভাবে অনলাইনে জমির খাজনা প্রদানের জন্য ভূমি উন্নয়ন কর আইন, ভূমির সর্বোচ্চ উৎপাদনশীলতা নিশ্চিত করতে ভূমি সংস্কার আইন ইত্যাদি নতুনভাবে প্রণয়ন করেছে। অর্পিত সম্পত্তি ব্যবস্থাপনায় জটিলতা নিরসনে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়ে ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া আরো স্বচ্ছ ও জনবান্ধব করার জন্য বিধিমালা করা হয়েছে।

ভূমি অফিসে হয়রানি ও কাজের দীর্ঘসূত্রতার উল্লেখযোগ্য কারণ দালালের দৌরাত্ম্য, দলিলপত্রের জাল-জালিয়াতি এবং প্রচলিত এনালগ সেবা পদ্ধতি। এসব অনিয়ম দূর করার অন্যতম উপায় হচ্ছে সেবাসমূহের অটোমেশন। আর সে লক্ষ্যেই একটি উচ্চ মানসম্পন্ন ইন্টার অপারেটেবল সফটওয়্যারের মাধ্যমে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সমজাতীয় সেবার সঙ্গে সমন্বয় করে সব ধরনের ভূমিসেবাকে অটোমেশন করা হয়েছে।

সিএস রেকর্ড অনেক পুরোনো হওয়ায় এগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, যেগুলো আছে সেগুলো এত দুর্বল যে, ধরা বা নাড়াচাড়া করা যায় না। তাই প্রায় সাড়ে ৪ কোটি খতিয়ান ডিজিটাইজড করা হয়েছে। এখন নাগরিকরা অনলাইনে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে তাদের জমির খতিয়ান দেখতে পারছেন এবং প্রয়োজনীয় ফি পরিশোধ সাপেক্ষে অনলাইনেই তা সংগ্রহ করতে পারছেন। অনলাইনে ভূমি উন্নয়ন কর বা খাজনা প্রদানও করতে পারছেন কোনো হয়রানি ছাড়াই।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close