রাশেদ নাইব

  ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আল্লাহর পথে ব্যয়, রয়েছে পুরস্কার

যারা আল্লাহর রাস্তায় ধন সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উদাহরণ একটি বীজের মত- যা থেকে সাতটি শীষ জন্মায়। প্রত্যেকটি শীষে একশ করে দানা থাকে। আল্লাহ অতি দানশীল, সর্বজ্ঞ। ‘যারা স্বীয় ধন সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে, আর ব্যয় করার পর সে অনুগ্রহের কথা প্রকাশ করে না এবং কষ্টও দেয় না, তাদেরই জন্যে তাদের পালনকর্তার কাছে রয়েছে পুরস্কার এবং তাদের কোন আশংকা নেই’- (সূরা বাকারা: ২৬১-২৬২)।

ইনফাক ফী সাবিলিল্লাহ; আল্লাহর পথে ব্যয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আল্লাহর পথে খরচ বলতে কি বুঝানো হচ্ছে। এক কথায় আল্লাহ খুশী হন এমন কাজে অর্থ ব্যয় করাই হচ্ছে ইনফাক ফী সাবিলিল্লাহ বা আল্লাহর পথে খরচ। আল্লাহকে খুশী করার জন্য, নিজের জন্য, পরিবার পরিজন, আত্মীয় স্বজন, সমাজ ও মানবতার কল্যাণ এবং সর্বপরি আল্লাহর দ্বীন এর প্রচার, প্রসার ও প্রতিষ্ঠার কাজে যে অর্থ ব্যয় হয় সবই ইনফাক ফী সাবিলিল্লাহর অন্তর্ভুক্ত। এক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে খরচ হতে হবে শুধুমাত্র আল্লাহকে খুশী করার জন্য। খ্যাতিলাভ, প্রদর্শনেচ্ছা কিংবা জাগতিক কোন স্বার্থে দ্বীন প্রতিষ্ঠার কোন কাজে অর্থ খরচ হলেও তা ইনফাক ফী সাবিল্লিাহ হিসেবে আল্লাহর কাছে গৃহীত হবে না। অপরদিকে আল্লাহকে খুশী করার জন্য নিজের বা পরিবার পরিজনের জন্য খরচ করা হলেও ইনফাক এর সওয়াব আল্লাহ দান করবেন বলে সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।

শব্দটির সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা : ইনফাক শব্দটির মূল ধাতু নাফাক যার অর্থ সুড়ঙ্গ। সাধারণত সুড়ঙ্গের এক দিক দিয়ে প্রবেশ করে আরেক দিক দিয়ে বের হওয়া যায়। আর এই নাফাক শব্দটির সাথে মাল শব্দটি যোগ হলে এর অর্থ হয় সম্পদ খরচ করা, শেষ করা। এর মানে হচ্ছে সম্পদ কারো হাতে কুক্ষিগত থাকার বস্তু নয়। সম্পদ এক দিক দিয়ে আসবে আবার আরেক দিক দিয়ে খরচ হবে। তবে কুরআনে যে ইনফাক এর কথা বলা হয়েছে সেই ইনফাক এর সাথে আয় ও ব্যয়ে বৈধতার প্রশ্ন রয়েছে। অবৈধ উপায়ে আয় করে অবৈধ খাতে খরচ করলে কুরআনে বর্ণিত ইনফাক হবে না। ইনফাক হতে হলে সম্পদ বৈধভাবে আয় করতে হবে এবং আল্লাহকে খুশী করার জন্য বৈধ খাতেই ব্যয় করতে হবে।

সুতরাং দান করতে হবে সর্ব অবস্থায়: আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন,‘ তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা এবং জান্নাতের দিকে ছুটে যাও যার সীমানা হচ্ছে আসমান ও যমীন, যা তৈরী করা হয়েছে পরহেযগারদের জন্য। যারা স্বচ্ছলতায় ও অভাবের সময় ব্যয় করে, যারা নিজেদের রাগকে সংবরণ করে আর মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে, বস্তুত আল্লাহ সৎকর্মশীলদেরই ভালবাসেন’- (সূরা আলে ইমরান: ১৩৩-১৩৪)।

প্রিয় বস্তুকে দান করতে হবে : সূরা আলে ইমরানের ৯২ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,‘তোমরা প্রকৃত পুণ্য লাভ করতে পারবে না যে পর্যন্ত না তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্তুগুলো আল্লাহর পথে ব্যয় না করবে। এই সব আয়াতের দাবি পূরণের জন্য খাঁটি মুমিনগণ অত্যুজ্জ্বল উদাহরণ স্থাপন করে থাকেন। সূরা আল আহযাবের ৩৫ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁদেরকে, (ইনফাককারী পুরুষ ও ইনফাককারী মহিলা) বলে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ তাঁরা আল্লাহর পথে অকাতরে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করেন। সমাজের অভাবী ব্যক্তিদের প্রতি তাঁদের সহযোগিতার হাত প্রসারিত হয়। আর আল্লাহর দ্বিনের আওয়াজ বুলন্দ করার কাজে তাঁরা উদারভাবে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে থাকেন।

প্রয়োজন বিশুদ্ধ নিয়ত : খালেস নিয়তে, দায়িত্ব মনে করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে যদি দান করা হয়, তাহলে তার ব্যাপক ফযীলত রয়েছে। এসব ফযীলতের কিছুটা পার্থিব এই পৃথিবীতেও লক্ষ্য করা যায়, তবে বেশিরভাগ ফযীলতই পরবর্তী জীবনের পাথেয় হিসেবে জমা থাকে। এছাড়াও এ জন্য আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারও পাবেন দানকারীরা। এ কারণেই দয়াময় আল্লাহ কুরআনে কারিমে দান-খয়রাতের ওপর ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছেন এবং সেই সঙ্গে দানের ব্যাপারে নিয়তের স্বচ্ছতার কথা বলেছেন।

দান করার নীতিমালা : দান করার কিছু নীতিমালা আল্লাহ তায়ালা কুরআনে কারিমে ঘোষণা করেছেন। যেমন, দান করতে হবে শুধু আল্লাহ তায়ালার জন্য। কাউকে দেখানোর জন্য নয়। দান-খয়রাত করে ভবিষ্যতে কোনো স্বার্থ হাসিলের নিয়ত করা যাবে না। আত্মপ্রদর্শনের উদ্দেশ্য কৃত দানকে নিকৃষ্টতম দান বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে ইসলামে। এছাড়া যাকে দান করা হলো তার কাছ থেকে এর বিনিময়ে কোনো সুযোগ-সুবিধাও গ্রহণ করা যাবে না।

আর ইসলামের ইতিহাসের শুরু থেকেই দাওয়াতী কাজকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ইসলামের হেফাজতের জন্য আর্থিক সহযোগিতার প্রয়োজন দেখা দিয়ে আসছে। এই জন্য স্বয়ং রাসূল (সা.) তাবুকের যুদ্ধের জন্য সাহাবীদের কাছ থেকে দান নিয়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন সময় রাসুল (সা.) সাহাবিদেরকে দান করতে উৎসাহিত করেছেন। এমনকি খেজুরের এক টুকরা দান করে হলেও জাহান্নামের আগুন থেকে নিজেকে বাঁচাতে বলেছেন। ধন-সম্পদের প্রকৃত মালিক আল্লাহ তাআলা। তিনি যাকে ইচ্ছা উহা প্রদান করে থাকেন। এজন্য এ সম্পদ অর্জন ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে তাঁর বিধি-নিষেধ মেনে চলা আবশ্যক। সৎ পন্থায় সম্পদ উপার্জন ও সৎ পথে উহা ব্যয় করা হলেই তার হিসাব প্রদান করা সহজ হবে।

দানে সম্পদ কমে না : অধিকাংশ মানুষ দান-খয়রাত করতে চায় না। মনে করে এতে সম্পদ কমে যাবে। তাই সম্পদ সঞ্চিত করে রাখতেই সর্বদা সচেষ্ট থাকে, এমনকি নিজের প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রেও খরচ করতে কৃপণতা করে। প্রকৃত পক্ষে দান-ছাদকা করলে সম্পদ কমে না। আবু কাবশা আল আনমারী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা.)কে বলতে শুনেছেন, ‘ছাদকা করলে কোন মানুষের সম্পদ কমে না’- (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক এরশাদ করেন,‘ যারা আল্লাহর রাস্তায় সম্পদ ব্যয় করে তার উদাহরণ হচ্ছে সেই বীজের মত যা থেকে সাতটি শীষ জন্মায়। আর প্রতিটি শীষে একশতটি করে দানা থাকে। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অতিরিক্ত দান করেন। আল্লাহ সুপ্রশস্ত সুবিজ্ঞ’- (সূরা বাকারা-২৬১)।

সন্দেহ নেই ধন-সম্পদ নিজের আরাম-আয়েশ এবং পরিবারের ভরণ-পোষণের ক্ষেত্রে ব্যয় করার অনুমতি ইসলামে আছে এবং অনাগত সন্তানদের জন্য সঞ্চিত করে রাখাও পাপের কিছু নয়। কিন্তু পাপ ও অন্যায় হচ্ছে, সম্পদে আল্লাহর দ্বীন বিজয়ের ক্ষেত্রে ব্যয় না করা ও গরীব-দুঃখীর হক আদায় না করা। অভাবী মানুষের দুঃখ দূর করার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করা। অথচ আল্লাহ বলেন, ‘এবং তাদের সম্পদে নির্দিষ্ট হক রয়েছে। ভিক্ষুক এবং বঞ্চিত (অভাবী অথচ লজ্জায় কারো কাছে হাত পাতে না) সকলের হক রয়েছে’- (মাআরেজ- ২৪-২৫)।

রাসূল (সা.) বলেন, ‘মানুষ বলে আমার সম্পদ! আমার সম্পদ!! অথচ তিনটি ক্ষেত্রে শুধু ব্যবহৃত সম্পদই তার। ১, যা খেয়ে শেষ করেছে, ২,যা পরিধান করে নষ্ট করেছে এবং ৩, যা দান করে জমা করেছে । আর অবশিষ্ট সম্পদ সে ছেড়ে যাবে, মানুষ তা নিয়ে যাবে’- (মুসলিম)। রাসূল (সা.) বলেন,‘যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে কোন কিছু ব্যয় করবে তাকে সাতশত গুণ ছওয়াব প্রদান করা হবে’- (আহমাদ, সনদ ছহীহ)।

যে ব্যক্তি হালাল কামাই থেকে একটি খেজুর সমপরিমাণ সদকা করবে (আর আল্লাহ তা‘আলা তো একমাত্র হালাল বস্তুই গ্রহণ করে থাকেন) আল্লাহ তা‘আলা তা ডান হাতে গ্রহণ করবেন। অতঃপর তা তার কল্যাণেই বর্ধিত করবেন যেমনিভাবে তোমাদের কেউ একটি ঘোড়ার বাচ্চাকে সুন্দরভাবে লালন-পালন করে বর্ধিত করে। এমনকি আল্লাহ তা‘আলা পরিশেষে সে খেজুর সমপরিমাণ বস্তুটিকে একটি পাহাড় সমপরিমাণ বানিয়ে দেন’- (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৪১০)।

শেষ কথা : দান করতে হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে, তাহলেই কেবল আখেরাতে এর ফায়দা লাভ করা সম্ভব হবে। আল্লাহতালা আমাদেরকে তার পথে ব্যয় করার তাওফিক দান করুন। আল্লাহুম্মা আমিন।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আল্লাহর পথে ব্যয়,রয়েছে পুরস্কার
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close